বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

আইসিজে’র তাৎপর্যপূর্ণ আদেশ

| প্রকাশের সময় : ২৬ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম

জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) রোহিঙ্গা গণহত্যা ইস্যুতে গাম্বিয়ার করা মামলায় অন্তর্বর্তী পদক্ষেপের আদেশ প্রদান করেছেন, যা যে কোনো বিবেচনায় অত্যন্ত গুরুত্ববহ ও তাৎপর্যপূর্ণ। ন্যায় ও মানবতার দৃষ্টিকোণ থেকে এ আদেশ একটি মাইলফলক। আদেশে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। মিয়ানমার সরকারকে অবশ্যই সামরিক, আধাসামরিক বাহিনীসহ যে কোনো শক্তির দ্বারা রোহিঙ্গা নিধন ঠেকাতে হবে। আদেশে আরো বলা হয়েছে, হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের আলামত ও প্রমাণ নষ্ট করার যাবতীয় তৎপরতা রোধ করতে হবে এবং আদালতের আদেশ বাস্তবায়নে কী কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তা মিয়ানমারকে নিয়মিতভিত্তিতে আইসিজে’কে অবহিত করতে হবে। অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ বলতে সাধারণত এমন এক জরুরি পদক্ষেপ বুঝায়, যা মামলার কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভুক্তভোগীদের সুরক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। এ ক্ষেত্রেও উদ্দেশ্য অভিন্ন। আইসিজে’র তরফে জানানো হয়েছে, মামলা চলবে। তবে কবে নাগাদ শেষ হবে, তা উল্লেখ করা হয়নি। পর্যবেক্ষদের মতে, অন্তত কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। এখনো মিয়ানমারে ৬ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। এই সময়কালে তারা যাতে হত্যা, নির্যাতন ও বিতাড়নের শিকার না হতে পারে, সেটা নিশ্চিত করাই অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কিত আদেশের প্রকৃত লক্ষ্য। গাম্বিয়া এরকম একটি আদেশেরই প্রত্যাশা করেছিল। দেখা গেছে, আদালতের ১৭ জন বিচারকের সবাই আদেশের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। এটা কম তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা নয়। বিচারকদের মধ্যে মিয়ানমারের নিয়োগকৃত বিচারক ছাড়াও চীন, ভারত, রাশিয়া ও জাপানের নিয়োগকৃত বিচারকরাও আদেশের পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। এরূপ সার্বজনীন সিদ্ধান্ত বা আদেশ সচরাচর দেখা যায় না। স্মরণ করা যেতে পারে, চীন, ভারত, রাশিয়া ও জাপান রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারের অবস্থানকে সমর্থন করে। তা সত্তে¡ও তাদের বিচারকরা আদেশের পক্ষাবলম্বন করায় বাস্তব পরিস্থিতির সত্যতা ও আদেশের ন্যয়সঙ্গতা বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

আইসিজে’র অন্তর্বর্তী পদক্ষেপের আদেশ নিঃসন্দেহে গণহত্যার শিকার এবং অমানবিক ও বর্বরোচিতভাবে নির্যাতিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির পক্ষে গেছে। রাখাইনে গণহত্যা হয়েছে কিনা, সেটা আদালতের চূড়ান্ত রায়ে জানা যাবে। তবে অন্তর্বর্তী আদেশে যে পদক্ষেপগুলো মিয়ানমারকে নিতে বলা হয়েছে, তা নেয়া হলে রোহিঙ্গারা কিছুটা হলেও সস্তি ও নিরাপত্তার মধ্যে থাকতে পারবে। অন্তত এটা বলা যায়, ভবিষ্যতে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ওপর যে মাত্রায় দমন-দলন চালাতে উদ্যত হতে পারতো, এখন সেটা সেই মাত্রায় নাও চালাতে পারে। মিয়ানমার, তার সরকার, সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনী এবং উগ্র বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের নৈতিক পরাজয় নির্ণীত হয়েছে এই আদেশে। অন্যদিকে গাম্বিয়ার প্রাথমিক বিজয় হয়েছে। আফ্রিকার এই ছোট্ট দেশটি, বিশেষত এর আইনমন্ত্রী আবু বকর মারি তামদাদুর ঐকান্তিক আগ্রহ ও প্রচেষ্টার ফলেই মামলাটি আদালতে গেছে এবং আদালত থেকে আলোচ্য আদেশ প্রদান সম্ভবপর হয়েছে। আমরা গাম্বিয়ার সরকার ও তামদাদুকে এ জন্য আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। রোহিঙ্গা ও গাম্বিয়ার মতো বাংলাদেশও এই বিজয়ের অংশীদার হয়েছে। রাখাইন থেকে হত্যা ও নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা অন্তত ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্ববাসীকে এটা বুঝাতে চেষ্টা করেছে যে, রাখাইনে নির্বিচারে রোহিঙ্গা হত্যা হয়েছে। হত্যা ও নির্যাতনের কারণেই লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসতে ও বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়েছে। বার বার বিভিন্ন উপলক্ষে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের পক্ষে কথা বলেছে এবং স্বঅধিকারে মিয়ানমারে তাদের প্রত্যাবাসনের দাবি জানিয়ে এসেছে। আইসিজে’র অন্তর্বর্তী আদেশে বাংলাদেশের অভিমত ও প্রচেষ্টার যৌক্তিকতা প্রতিফলিত হয়েছে। অন্যদিকে এযাবৎ মিয়ানমার রোহিঙ্গা ইস্যুতে যে প্রচার-প্রপাগাÐা, যুক্তি ও তত্ত¡ উপস্থাপন করেছে, তার অসত্যতা ও অসারতা এই আদেশে স্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন হয়েছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন আইনী বাদ্যবাধকতা অনুযায়ী, আইসিজে’র আদেশ অবিলম্বে ও নিঃশর্তভাবে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে মিয়ানমারের প্রতি আহŸান জানিয়েছে। কমিশনের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এটি রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচারের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সম্ভাব্য দায় আইনীভাবে নিরূপণের পথ খুলে দিয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের তরফ থেকে তার এশিয়া ও প্রশান্ত মহসাগরীয় বিষয়ক মন্ত্রী হিদার হুইলার বলেছেন, আইসিজে’র নির্দেশনা মানতে আমরা মিয়ানমারের প্রতি আহŸান জানাই। এই আদেশ মানার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। জাতিসংঘ ও যুক্তরাজ্যের আহŸানের প্রতি বিশ্বের বিবেকবাদী ও মানবিক সব রাষ্ট্রই সমর্থন জানাবে বলে আশা করা যায়। অথচ মিয়ানমার আগের মতোই একগুঁয়েমি প্রর্দশন করছে। সে এই আদেশ প্রত্যাখ্যান করেছে এই বলে যে, তা নাকি পরিস্থিতির বিকৃত চিত্র উপস্থাপন করেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, অন্তর্বর্তী আদেশ প্রত্যাখ্যান করার মধ্য দিয়ে মিয়ানমার তার নিযুক্ত বিচারকসহ তার পক্ষের দেশ চীন, ভারত, রাশিয়া ও জাপানের বিচারদেরও অবমূল্যায়ন করেছে। পর্যবেক্ষকদের অভিমত, এভাবে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের আদেশ প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যমে এক ধরনের হটকারিতার পরিচয় দিয়েছে মিয়ানমার। তার সত্য ও বাস্তবতা স্বীকার করে নেয়া উচিৎ। দীর্ঘ মেয়াদে সেটাই হতে পারে তার জন্য কল্যাণলকর। এটা ঠিক, আন্তর্জাতিক আদালতের আদেশ বা রায় যাই হোক, তার বাস্তবায়নের দায় মিয়ানমারের। এ ক্ষেত্রে তার আন্তরিকতা ও সদিচ্ছাই আসল। প্রকৃত প্রস্তাবে রোহিঙ্গা সংকটের ন্যায়োচিত সমাধান হতে পারে তখনই, যখন রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিকত্ব, নাগরিক ও রাষ্ট্রীয় অধিকার, নিরাপত্তা এবং স্বদেশে ফেরার অভয়-সুযোগ লাভ করবে। এই সমাধানকেই মিয়ানমারের মেনে নেয়া সঙ্গত ও উচিৎ। আমরা আশা করি, তার শুভবুদ্ধির উদয় হবে। এবং তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলো এক্ষেত্রে তাকে যথোচিত প্রভাবিত করার দায়িত্ব পালন করে প্রকৃত বন্ধুর দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। সত্য বটে, আইসিজে’র অন্তর্বর্তী আদেশ মিয়ানমারের ওপর চাপ বৃদ্ধি করবে। বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের উচিৎ, যথেষ্ট চাপ বৃদ্ধির মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে মিয়ানমারকে বাধ্য করা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন