শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ভোটিং মেশিন নয় সমস্যা ক্ষমতার অপব্যবহার ও রাজনৈতিক সদিচ্ছায়

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০২ এএম

ভাষা শহীদদের স্মৃতি বিজড়িত মাস ফ্রেব্রুয়ারীর প্রথম দিনে অনুষ্ঠিত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন উত্তর ও দক্ষিণের মেয়র-কাউন্সিলর নির্বাচন দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার ইতিহাসে নতুন মাইলফলক হয়ে থাকবে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের এক সিনিয়র নেতা এই নির্বাচনকে গত একশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন বলে দাবী করেছেন। একশ বছর নয় চিরায়ত বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে এই প্রথম লাখ লাখ ভোটার অধ্যুষিত বৃহত্তম কোনো স্থানীয় নির্বাচনে একসঙ্গে হাজার হাজার ভোটকেন্দ্রের সবগুলোতে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন(ইভিএম) ব্যবহার করা হয়েছে। বিশ্ব যতই তথ্যপ্রযুক্তিতে অগ্রসর হোক, যত বেশি রাষ্ট্র ও সমাজ ডিজিটালাইজড হোক না কেন জনপ্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচনী ব্যবস্থায় ইভিএমকে আস্থায় নিতে পারছে না মানুষ। এখন পর্যন্ত কোনো ম্যাকানাইজড ভোটিং পদ্ধতিই ত্রæটিমুক্ত হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। এ কারণে উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ইভিএম মেশিনকে নির্বাচনের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেনি। মেশিনগুলো যতই নিখুঁত, ত্রæটিমুক্ত কিংবা স্বচ্ছ হোক, মেশিনের পশ্চাতে থাকা মানুষগুলো যদি, দক্ষ, নিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন না হন ত্রæটিমুক্ত উন্নত প্রযুক্তির অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা দূর করা সম্ভব নয়। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আড়াই হাজারের বেশি ভোট কেন্দ্রে ইভিএম মেশিন ব্যবহারের মধ্য দিয়ে যে নির্বাচনী চিত্র দেখা গেলো তাতে মেশিনের চেয়ে মেশিন ব্যবহারকারী মানুষগুলোর বিরূপ ভ’মিকা দেখা গেছে। এর আগের(২০১৫) সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন এবং গত জাতীয় নির্বাচনে প্রথাগত নির্বাচন পদ্ধতিতে ব্যালট পেপার নিয়ে যে সব ঘটনা ঘটেছে, ব্যালট বই ছিনিয়ে নিয়ে একহাতে শত শত ব্যালটে সিল মেরে বাক্স বোঝাই করা, কিংবা ভোটের সকাল হওয়ার আগেই রাতের বেলায় ব্যালটে সিল মেরে বাক্স বোঝাই করে ভোটের সারাদিন মক ইলেকশন করার যে সব অভিযোগ ও কান্ডকারখানা দেখা গেছে,তাতে আমরা প্রথাগত ভোটিং ব্যবস্থাকে দায়ী করতে পারিনা। শত বছর ধরে বিশ্বের শত শত দেশের কোটি কোটি মানুষ ব্যালট পেপারে ভোট দিয়ে সরকার পরিবর্তনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধরে রেখেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারত পর্যন্ত বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে যে সব অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা এবং পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছে তা প্রযুক্তিগত দুর্বলতার কারণে নয়, ঘটেছে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রশাসনের সাথে সংশ্লিষ্টদের নৈতিক স্খলন, মানবিক দুর্বলতা ও কায়েমী স্বার্থবাদী প্রভাব থেকে। আমেরিকায় ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার গোপণ হস্তক্ষেপ অথবা চলতি বছরের নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রতিপক্ষকে বেকায়দায় ফেলতে ইউক্রেন সরকারের উপর মার্কিন প্রেসিডেন্টে কথিত চাপ সৃষ্টির অভিযোগ শেষ পর্যন্ত মার্কিন সিনেটে প্রেসিডেন্টের ইমপিচমেন্টের বিচারে গড়িয়েছে। ইমপিচমেন্ট সম্পর্কিত আইনের দুর্বলতা, হাউজ ও সিনেটে ক্ষমতার ভারসাম্য এবং পার্টিজান পলিটিক্সের কারণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শেষ রক্ষা হলেও ক্ষমতার অপব্যবহারের যে সব অভিযোগ তোলা হয়েছে, তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ হুমকির মুখে পড়েছে। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল প্রবক্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা বৃহত্তম আঞ্চলিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের গণতন্ত্র যদি সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবাদ কিংবা কর্পোরেট পুঁজিবাদের দ্বারা আক্রান্ত-নিয়ন্ত্রিত হয়, বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো তার বিরূপ প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।

জাতীয় নির্বাচনে সারাদেশে ব্যাপক ভোট জালিয়াতি এবং রাতের বেলায় ব্যালটে সিল মারার অভিযোগ যে কোনো সরকারের জন্য অস্বস্তিকর বিষয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কথিত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে দেশের বিরোধী পক্ষের সব রাজনৈতিক দল, জোট এবং আন্তর্জাতিক মহলের প্রত্যাশা ও দাবীকে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। এরপর রাতের আঁধারে ব্যালট বাক্স বোঝাই করে ক্ষমতা ধরে রাখার নজিরবিহীন তৎপরতা ধামাচাপা দিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। মূলত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর ভোটারবিহীন একপাক্ষিক দশম জাতীয় নির্বাচনের পর থেকেই স্থানীয় ও জাতীয় প্রতিটি নির্বাচনে নতুন নতুন নিয়ন্ত্রণমূলক নির্বাচনী কৌশল গ্রয়োগ হতে দেখা গেছে। নির্বাচনের মাঠকে বিরোধী পক্ষের জন্য বিপদসঙ্কুল করে তোলা, সম্ভাব্য সব প্রার্থীর বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দিয়ে তার স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকান্ড রুদ্ধ করে দেয়া। এরপরও যারা প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী হিসেবে থাকবে তাদেরকে নানাভাবে হুমকি দিয়ে বিরত রাখা, মনোনয়নপত্র বাতিলের ন্যুনতম সুযোগ কাজে লাগানো কিংবা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমাদানে বিরত রাখতে নানাবিধ উপায় ও পদ্ধতি অবলম্বন করতে দেখা গেছে। বিগত ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন থেকে এবারের ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদলের একশ্রেণীর চেয়ারম্যান-মেম্বার ও কাউন্সিলর প্রার্থীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠতে দেখা যায়। সিটি নির্বাচনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইভিএম নিয়ে বিএনপি যে সব অপব্যবহারের ও আশঙ্কা করেছিল ভোটের মাঠের বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে ইভিএম ছাড়া কাগুজে ব্যালটেও এই চিত্রের তেমন কোনো হেরফের হতো না। এক কথায় একে একটি পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন বলে অভিহিত করা যায়। সহজে ও কম সময়ে ভোটদান, দ্রæততম সময়ে ভোট গণনা ও ফলাফল প্রকাশ ইভিএমে ইত্যাদি সুযোগ সুবিধার কথা বলা হলেও ঢাকা সিটি নির্বাচনে এর ব্যতিক্রম চিত্রই বেরিয়ে এসেছে। খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের হাতের আঙুলের ছাপ না মিলায় ভোটাই আইডি কার্ড ব্যবহার করে ভোট দিতে হয়েছে তাঁকে। সংবিধান প্রণেতা এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড.কামাল হোসেনের ভোট দিতে আধাঘন্টা সময় লেগেছে। আর ভোটের পর ফলাফল পেতে সময় লেগেছে ১০ ঘন্টার বেশি, কাগুজে ব্যালটেও এত সময় লাগেনা। ভোটের মাঠে ইভিএম কি সুফল দিল এখন আর তা দেখাতে পারছে না নির্বাচন কমিশননির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বেশ কিছু কেন্দ্র পরিদর্শন করে বিএনপির এজেন্ট খুঁজে পাননি। পোলিং অফিসার, প্রিজাইডিং অফিসারসহ হাজার হাজার নির্বাচনী কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছিল দলীয় পরিচয় ও পক্ষপাত নিশ্চিত করে। সেখানে বিরোধি পক্ষের পোলিং এজেন্ট না থাকলে এবং সরকারী দলের ক্যাডাররা সুনিদ্দির্ষ্ট অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে অধিক সংখ্যায় উপস্থিত থাকলে গোবেচারা ভোটারদের অবস্থা যা হবার তাই হয়েছে। মূল ধারার গণমাধ্যমে এসব তথ্য প্রচারে নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিবন্ধকতা থাকলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভোটকেন্দ্রের অনিয়ম-দখলদারিত্বের অসংখ্য ভিডিও ভাইরাল হয়ে ঘুরছে। শত বছরের মধ্যে সবচেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের দিন শহরের নানা প্রান্তে বিচ্ছিন্ন সংর্ঘষের ঘটনায় পোলিং এজেন্ট ও গণমাধ্যম কর্মীদের রক্ত ঝরেছে। মোহাম্মদপুরে একজন পোলিং এজেন্ট ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত হয়েছেন। নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সরকারী দলের পক্ষ থেকে নজিরবিহীন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে বলে দাবি করা হলেও নির্বাচনী সংঘাত-গোলযোগের ঘটনাও নেহাত কম নয়। হতাহতের সংখ্যাও শতাধিক। তবে একতরফা ভোটগ্রহণের পরও ভোটার টার্নআউটের হার শতকরা প্রায় ২৫ ভাগ।

গত ১০ জানুয়ারী আনুষ্ঠানিক প্রচারনার শুরু থেকে নির্বাচনের মাঠ একতরফাভাবে নৌকা সমর্থকদের দখলে থাকে। নানা আশঙ্কায় এমনিতেই বিরোধি দলের প্রচার-প্রচারনায় যুক্ত হতে সাধারণ মানুষ ভয় পায়। অসমতল মাঠে নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমে ধানের শিষের প্রার্থী ও সমর্থকরা প্রতিদ্বন্দী প্রার্থীর অস্ত্রধারি ক্যাডারদের হাতে আক্রান্ত হওয়া ছিল একেকটি সিম্বলিক সর্তক সঙ্কেত। অথচ আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতারা সিটি নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও বিতর্কমুক্ত রাখার প্রতিশ্রæতি ব্যক্ত করেছিলেন। নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার ৩দিন পর ২৫ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে বলে প্রথম মন্তব্য করেছিলেন। তিনি যখন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি অবাধ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে চান। সেই নির্বাচনে যেই জিতুক কিছু আসে যায় না। সিটি কর্পোরেশন ইলেকশনে হেরে গেলে সরকারের উপর আকাশ ভেঙ্গে পড়বে না। সুষ্ঠু সুন্দর একটি ইলেকশন উপহার দেয়ার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনকে সরকারের পক্ষ থেকে স্বাধীন ও কর্তৃত্বপূর্ণ ভ’মিকা রাখার তাগিদ দেয়া হবে বলেও ওবায়দুল কাদের প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন। বিগত জাতীয় নির্বাচনসহ পরবর্তি স্থানীয় নির্বাচনগুলোর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় দেশের রাজধানী শহরের মেয়র নির্বাচনটিকে সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য করতে সরকারের এই প্রতিশ্রæতিকে বিএনপি কিছুটা হলেও বিশ্বাস করেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। তবে তফশিল ঘোষণার পর থেকে সরকারী দল ও নির্বাচন কমিশনের নানা তৎপরতা ও ভ’মিকার কারণে ভোটের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা চরমভাবে প্রকাশ পায়। নির্বাচনের সব অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা, একচেটিয়া ক্ষমতা, পেশিশক্তি ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার পরও দুই সিটির নির্বাচিত মেয়রদ্বয় মোট প্রায় ৫৪ লাখ ভোটারের মধ্যে সাকুল্যে ভোট পেয়েছেন প্রায় সাড়ে ৮ লাখ, শতকরা হিসাবে যা ১৫ ভাগের কম। এর মানে হচ্ছে শতরা ৮৫ ভাগ ভোটারের সমর্থন তাদের পক্ষে নয়। এটি দেশের কোনো প্রত্যন্ত দারিদ্র্য পীড়িত অঞ্চলের স্থানীয় নির্বাচন নয়। প্রায় ২ কোটি নাগরিকের সমস্যাপীড়িত শহরের মেয়র-কাউন্সিলর নির্বাচনে মাসব্যাপী হাজার হাজার প্রার্থী ও সমর্থকের জমজমাট প্রচারণার পর আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তির নির্বাচন। যেখানে ভোটারদের প্রায় অর্ধেকই তরুন ভোটার। স্বাভাবিকভাবেই ইভিএম মেশিন নিয়ে এসব ভোটারের কৌতুহল এবং বিগত নির্বাচনে ভোট দিতে না পারার কারণে বাড়তি মনোযোগ থাকার কথা। আদতে তার কোনো প্রতিফলন ভোটের দিন দেখা যায় নি। এমন একটি সিটি নির্বাচনে বিরোধিদলের অংশগ্রহণ সত্তে¡ও ভোটার উপস্থিতি নজিরবিহীন কম হওয়াকে নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি ভোটারদের অনাস্থার বহি:প্রকাশ বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ও নেতাকর্মীদের ভোটকেন্দ্র দখলে রাখার মহড়া, অব্যাহতভাবে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘিত হওয়ার পরও অভিযক্ত কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের কোনো ব্যবস্থা নেয়ার দৃষ্টান্ত না থাকা, ইভিএম মেশিনে ভোটদানের বিড়ম্বনা, ভোটের ফলাফলের স্বচ্ছতা নিয়ে সংশয় ইত্যাদি কারণে এই ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় বেশিরভাগ ভোটার। ২০১৪ সালের পর থেকেই এ প্রবণতা শুরু হলেও ক্ষমতাসীন সরকার এবং নির্বাচন কমিশন স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনার কার্যকর উদ্যোগের বদলে স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রশাসনিক ক্ষমতার ব্যবহার ও ভীতি সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রতি মানুষকে অনাগ্রহী করে তোলা হয়েছে। দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য এ অবস্থাকে অশনি সংকেত বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

ফরাসি মার্ক্সবাদি লেখক-অর্থনীতিবিদ সামির আমিন বলেছেন,‘উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে হলে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের প্রতি জনসমর্থন প্রয়োজন’। এ জন্য গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ শাসক ও ক্ষমতাসীনদের মনের মধ্যে ও মনোজগতে বিদ্যমান ও সদা ক্রিয়াশীল থাকতে হবে। সিটি নির্বাচনের আগে পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতদের যৌথ বিবুতি এবং মার্কিন দূতাবাসের ফেইজবুক স্টাটাসেও অর্থনৈতিক উন্নয়ণের স্বার্থে গণতন্ত্রের অপরিহার্যতার কথা বলা হয়েছিল। গণতন্ত্র একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া যা বৃহত্তর সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমন্ডলে ভিত্তি ও বিকাশ লাভ করে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও অবনমনের শেষ ধাপে এসে দেশে দেশে একটি শাসকশ্রেণী গণতন্ত্রকে সীমিত ও গন্ডিবদ্ধ করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। এরা শুধুমাত্র অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল স্তম্ভ হিসেবে প্রতিপন্ন করছে। কোনো কোনো দেশে যেনতেন প্রকারে নির্বাচনের মধ্যদিয়ে ক্ষমতার পালাবদলের ধারাক্রমকেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলে দাবী করা হচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এসব দেশের প্রতি নজর রেখে এসব দেশের শাসনব্যবস্থাকে র‌্যাংকিংয়ে মাত্রাভেদে কার্যকর গণতন্ত্র, ক্রটিপূর্ণ গণতন্ত্র, হাইব্রিড রিজিম এবং কর্তৃত্ববাদি বা একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার তালিকায় স্থান দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে বৃটেনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) জরিপে বাংলাদেশ কখনোই আশিটি দেশের উপরে উঠতে পারেনি। অর্থাৎ বাংলাদেশ এখনো হাইব্রিড রিজিমের তালিকাভুক্ত। আশার কথা হচ্ছে ২০১৮ সালের বাংলাদেশ ৮৮তম স্থ্ান থেকে গত বছরের জরিপে ৮ ধাপ উন্নতি করে ৮০ নম্বরে উঠে এসেছে। গত সপ্তাহে প্রকাশিত এই জরিপ রিপোর্টটি দেশের পত্রিকাগুলো বেশ গুরুত্বের সাথে ছেপেছিল। এবার যেমন ৮ ধাপ উন্নতি ঘটেছে একইভাবে মাত্র দুই বছর আগেও ইআইইউ জরিপে বাংলাদেশ ৮৪ থেকে ৯২ তে নেমেছিল। সেখানে এবার আবার ৮ ধাপ উন্নতির পর ঢাকায় হাই প্রোফাইল সিটি নির্বাচনে নানাবিধ অনিয়ম-অস্বচ্ছতার পর রাজধানী শহরের মেয়র নির্বাচনে ভোটারদের অনুপস্থিতি দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে নতুন প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। ঢাকা সিটি নির্বাচনের পর চলতি বছরে অনুষ্ঠিতব্য বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সরকারের আচরণ, গণমাধ্যম ও নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে সরকারি সংস্থাগুলোর ভ’মিকা ইত্যাদি বিষয়গুলো আগামী দিনে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে নি:সন্দেহে বাংলাদেশের নতুন অবস্থান নির্ধারণ করবে। বিদেশি গবেষনা সংস্থা বা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ শাসনব্যবস্থা ও গণতন্ত্র সম্পর্কে কি ধরনের মতামত পোষণ করে তা যেমন যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে, রাষ্ট্র ও সরকারের ভ’মিকা সম্পর্কে বাংলাদেশের গণমানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও মতামত তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শুধু ভোটের আয়োজন দিয়ে গণতন্ত্র পরিমাপ করার বাস্তবতা এখন আর কাজে আসছে না। ব্যাংক জালিয়াতি, শেয়ারবাজার কারসাজি, ঘুষ-দুর্নীতি, কমিশন বাণিজ্য, মাদক ব্যবসা, ক্যাসিনো জুয়া, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, ভ’মিদস্যুতাসহ নানাভাবে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে। এসব টাকার অংশ জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে ব্যবহৃত হচ্ছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং কালোটাকার মালিকরা ভোটের মাঠকে প্রভাবিত করে যে ক্ষমতার মৌরসি পাট্টা গড়ে তুলেছেন তাকে গণতন্ত্র বলা চলে না। যত ত্রæটিপূর্ণ হোক না কেন, মার্কিন সিনেটররা বিপুল ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্টকে বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে অভিসংসিত করতে পারেন। কিছুদিন আগে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীকে থেরেসা মে পদত্যাগ করে নতুন নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছেন। গত দশকে ২০০৭ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জাপানে ৫ বছরে ডেমোক্রেটিক ও লিবারেল ডেমোক্রেটিক দলের ৬জন প্রধানমন্ত্রীর গদি বদল ঘটেছে। সেখানেও প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল ঘটতে দেখা যায়। ২০০৬ সালে জাপানের লিবারেল ডেমোক্রেটিক দলের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ক্ষমতা গ্রহণের পর শিনজো আবে একবছর দায়িত্ব পালন শেষে প্রতিক’ল পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর ৫ বছরে ৬ জন দায়িত্ব পালনের পর শিনজো আবে তিনদফায় ৭ বছর ধরে জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অধিষ্ঠিত আছেন। চলতি বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকলে তিনিই হবেন জাপানের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় দায়িত্বে থাকা প্রধানমন্ত্রী। অবশ্য প্রথমবারের এক বছরকে হিসাবে ধরলে দেড়শ বছরের মধ্যে শিনজো আবে ইতিমধ্যেই সবচে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেকর্ড গড়েছেন। অনৈতিক বা অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় যাওয়া বা আঁকড়ে থেকে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির ইতিহাস জাপানে নেই। গণতন্ত্রের দাবিতে অস্ত্র হাতে নিয়ে লড়াই করে লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিচ্যুতি ও অবমূল্যায়ন মানুষ মেনে নিচ্ছে না। অসমতল মাঠে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা জানাচ্ছে এ দেশের সাধারণ মানুষ। সরকার ও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে এ বিষয়ে দ্রæত সিদ্ধান্তে আসতে হবে। সমঝোতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার সুষ্ঠু পরিবেশ ছাড়া সুষ্ঠু অবাধ ও জনগণের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব নয়। বাংলাদেশে এটা বার বার প্রমানিত হয়েছে।

bari_zamal@yahoo.com

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
আকাশ ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ২:৪৭ এএম says : 0
একদম খাঁটি কথা বলেছেন
Total Reply(0)
M ismail Kabir Ahmed ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১০:৫৬ পিএম says : 0
kintu awamileager jonno ei shob possible no problem
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন