সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্ব›িদ্বদের বিরোধ ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। যার নেপথ্যে কাজ করছে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীরা। আনন্দ-আনুষ্ঠানের নামে কোনো কোনো এলাকায় প্রকাশ্যে মহড়া দিচ্ছে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীরা। এ নিয়ে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত।
সূত্র জানায়, নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ড, পলাতক, সন্ত্রাসীরা তৎপর ছিল। দেশের বাইরে অবস্থানরত এবং পলাতক অনেক সন্ত্রাসী সম্ভাব্য প্রার্থীদের পক্ষে নানাভাবে কাজ করেছে। এমনকি, জেলে বন্দী সন্ত্রাসীদেরও অনেকে অনুসারীদের নির্দেশ দিয়েছিল তাদের পছন্দের প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করতে। কোনো কোনো এলাকায় সন্ত্রাসীদের আনাগোনা নির্বাচনের আগে উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর তৎপরতায় নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেনি। তবে বিকল্প পথে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা তাদের পক্ষের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে সক্ষম হয়েছে বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে।
সূত্র জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসী খন্দকার তানভীরুল ইসলাম জয়, জিসান, সুব্রত বাইন, হারেস, মানিক, শাহাদাত, রাজু, খোরশেদ, প্রকাশ কুমার, বিকাশ, আশিক, ওমর ফারুক কচি, মহি আলম মহিদ, বুদ্দিন, মোবারক, নিজাম, লেংরা শরিফ, ইলিয়াস, নান্নু, কালু, আনোয়ার, ফারুক, শওকত, তপন, খোরশেদ, কামাল, আলমগীর, উজ্জ্বল, তুরান, সান্টু, রুবেল, সাগর, রানা, আলী রেজা খান, অয়ন, ইমরান, হৃদয়, আলমগীর হোসেন, তাপু, ডাকাত সাগর, কালা মামুদ, প্রিন্স মোহম্মদ, রাজু, সুন্দর শরিফসহ অনেক সন্ত্রাসীই এই নির্বাচনকে সামনে রেখে তৎপর ছিল। বিভিন্ন এলাকায় নিজ নিজ প্রার্থীর পক্ষে তারা নানাভাবে কাজ করেছেন। এমনকি তাদের সমর্থিত বেশ কয়েকজন প্রার্থী নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। শপথ নেয়ার আগেই এখন তাদের কেউ কেউ বেপরোয়া। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সাগরেদ বা সহযোগীদের নিয়ে চলাফেরা করছেন। বিভিন্ন আনন্দ, উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে তারা নিজেদের শক্তি জানান দেয়ার মহড়া দেখাচ্ছেন। তাতে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১২ নং ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত কাউন্সিলর মামুনুর রশিদ শুভ্রের সমর্থকদের বিরুদ্ধে এলাকায় আতঙ্ক ও হুমকী দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। গত মঙ্গলবার রাতে বিজয় উৎসবের নামে তার সমর্থকরা প্রতিদ্ব›িদ্ব আওয়ামীগ সমর্থিত প্রার্থী গোলাম আশরাফ তালুকদারের সমর্থকদের হুমকি-ধমকী দিয়ে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর এলাকায় বেপরোয়া হয়ে উঠেন শুভ্রর সমর্থকরা। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় গুলবাগ এলাকায় গুলবাগ যুব কল্যাণ সমিতির কার্যালয়ে বিজয় উৎসবের আয়োজনের নামে একটি অনুষ্ঠান করেন তার সমর্থকরা। গভীর রাত পর্যন্ত চলা ওই অনুষ্ঠান থেকে শুভ্র সমর্থিত লিটন, টুটুল, শিপু, সজিব, হাবিবসহ বেশ কয়েকজন ওই এলাকায় বসবাসকারী পরাজিত প্রার্থীর লোকজনকে হুমকি-ধমকী দেয়। যদিও কাউন্সিলর শুভ্র এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। জানা গেছে, ১২ নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীকে বিজয়ী করতে সক্রিয় ছিলেন শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও তার অনুসারীরা।
ঢাকা দক্ষিণের ৪৭ নং ওয়ার্ড গেন্ডারিয়া এলাকায় কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন এক সময়ের আলোচিত সন্ত্রাসী শহীদ কমিশনারের মেয়ে শাহানা আক্তার। স্থানীয়দের অভিযোগ, ভোটের ফলাফলের পর সন্ত্রাসীদের ভয়ে চুপসে গেছেন বর্তমান কাউন্সিলর আওয়ামী লীগের নাসির আহমেদ ও তার অনুসারীরা। দিনে দুপুরে তালিকাভুক্ত ও চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের আনাগোনা এলাকার মানুষকেও আতঙ্কিত করে তুলেছে। ৫৩ নং ওয়ার্ডে পরাজিত আওয়ামী লীগের প্রার্থী নাসিম শিকদারের অনুসারীরাও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। মুরাদপুর এলাকার কয়েকজন জানান, কর্মদোষে মানুষ আওয়ামীলীগের প্রার্থী নাসিমকে ভোট দেয়নি। কারণ এলাকায় মাদক বিস্তারের জন্য মূলত কাউন্সিলরের আত্মীয়-স্বজনের সিন্ডিকেটই জড়িত। ভোটে পরাজিত হওয়ার পর সেই সিন্ডিকেট বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কয়েকদিন আগে এলাকার স্বনামধন্য সমাজকর্মী মরহুম হুমায়ুন কবীর শিকদারের বাড়িতে চুরির ঘটনাকেও রহস্যজনক বলে দাবি করেছেন স্থানীয়রা। তাদের মতে, পুরো এলাকাতেই এখন চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ীদের আনোগোনা। এর মধ্যে বিজয়ী রুহুল আমীনের সমর্থকদের সাথে নাসিমের সমর্থকদের কয়েক দফা বাকবিতন্ডার ঘটনাও ঘটেছে। অভিযোগ রয়েছে রাজিব নামের একজন নিয়ন্ত্রণ করছে মাদক ও সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট। নারায়ণগঞ্জের এক এমপির ভাগ্নে রাজীব নিজেকে ক্ষমতাধর প্রমান করার জন্য থানার ওসি থেকে শুরু করে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে নিজের ক্ষমতা জানান দিয়ে থাকে। ৫৪ নং ওয়ার্ডে বিজয়ী আওয়ামী লীগের প্রার্থী হাজী মাসুদের হয়ে কাজ করেছে শীর্ষ সন্ত্রাসী ওমর ফারুক কচির সহযোগীরা। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মাসুদের হয়ে অনেক টাকাও খরচ করেছে শীর্ষ সন্ত্রাসী কচি। নির্বাচনে যারা মাসুদের বিরোধীতা করেছে তারা এখন কচি বাহিনীর ভয়ে আতঙ্কিত। পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া এলাকায় ৪৫ নং ওয়ার্ডে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী শামসুদ্দোহা। কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী জোহার বিজয়ে নেপথ্যেও মাদক ও সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট কাজ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নির্বাচনে জোহার বিরোধীতা করেছেন মূলত আওয়ামী লীগের সমর্থকরাই। এলাকায় সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন তাদের অনেকেই আতঙ্কিত। ডেমরার ৬৮ নং ওয়ার্ডেও বিজয়ী প্রার্থীর পক্ষে সন্ত্রাসীদের তৎপরতায় আতঙ্কিত পরাজিত প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা। ঢাকা উত্তরের ৪৯ নং ওয়ার্ডে বিজয়ী হয়েছেন আনিছুর রহমান নাঈম। তার হয়েও সন্ত্রাসীরা কাজ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিজয়ী হওয়ার পর প্রতিনিয়ত শোডাউন করে চলেছেন নাঈম। সেই বহরে থাকে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীরা। এ নিয়ে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত। মোহাম্মদপুরে বিতর্কিত বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই তাদের সহযোগী সন্ত্রাসীরা তৎপর হয়ে উঠেছে। দক্ষিণের খিলগাঁও এলাকাতেও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মদদপুষ্ট একজন কাউন্সিলরের সমর্থকদের তৎপরতা অনেককেই ভাবিয়ে তুলেছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদ ওরফে মন্টি, ওমর ফারুক কচি, শাহাদত, সুব্রত বাইনসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী। এর মধ্যে কচি তার কালো টাকা সাদা করার জন্য চুটিয়ে দেশেই ব্যবসা করে চলেছে। বুড়ীগঙ্গা সেতুর ইজারার নেপথ্যেও রয়েছে কচি। জিসান, শাহাদত, কচিসহ আরও একাধিক পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী নির্বাচন ঘিরে আন্ডারওয়ার্ল্ডে নতুন মেরুকরণের চেষ্টায় তৎপর ছিল। তবে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর তৎপরতায় নির্বাচনে কোনো ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেনি। এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অপারেশন) কৃষ্ণপদ রায় বলেন, নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত রাখতে সব ধরনের প্রস্তুতি ছিল পুলিশের। কেউ যাতে দেশে-বিদেশে বসে অপতৎপরতা চালাতে না পারে সে দিকে নজর রাখা হয়েছিল।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, কোনো অপরাধীচক্র যাতে নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে না পারে সে ব্যাপারে র্যাবের একাধিক টিম কাজ করেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন