স্টাফ রিপোর্টার : শুক্রবার রাত ৯টা থেকে পরবর্তী ১৫ ঘণ্টা কেটেছে আতঙ্ক, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর এক অজানা শঙ্কায়। দেশে তো বটেই, বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরাও নির্ঘুম কাটিয়েছেন। সকলেরই দৃষ্টি ছিল টেলিভিশনের পর্দায়Ñকী ঘটছে রাজধানী ঢাকার অভিজাতপাড়া গুলশান ৭৮ নম্বর সড়কের স্প্যানিস রেস্টুরেন্ট হলি আর্টিসানে? কী পরিণতি ঘটেছে দুর্বৃত্তদের হাতে দেশি-বিদেশি জিম্মিদের? সকল প্রশ্ন ও শঙ্কার অবসান ঘটে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নৌ, বিমান, বিজিবি, পুলিশ ও র্যাবকে নিয়ে যৌথভাবে পরিচালিত অপারেশন থান্ডার বোল্ডের মাধ্যমে।
শুক্রবার রাত ৯টা। গুলশান-২, ৭৯ নম্বর রোড লেক সংলগ্ন স্প্যানিস রেস্টুরেন্ট হলি আর্টিসান তখন খদ্দেরে ভরপুর। হঠাৎই রেস্টুরেন্টটিতে প্রবেশ করে ৭ জনের সন্ত্রাসী দল। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই আল্লাহু আকবর বলে তাদের এলোপাতাড়ি ফাঁকা গুলি শুরু হয়। খবর পেয়ে ছুটে যান ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান জোনের সহকারী উপ-কমিশনার (এডিসি) আহাদুল ইসলাম, বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহ উদ্দিন খান ও গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল ইসলামসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা।
রাত ১০টায় পুলিশ জানতে পারে রেস্টুরেন্টে হামলা চালিয়ে বিদেশি নাগরিকসহ বেশ কিছু লোককে জিম্মি করে রেখেছে সন্ত্রাসীরা। রাত সাড়ে ১০টার দিকে সেখানে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ও গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়। পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাউদ্দিন নিহত এবং ৫০ জনেরও বেশি ব্যক্তি আহত হন। তাদের উদ্ধার করে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল ও ইউনাইটেড হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। পুলিশের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবরে অতিরিক্ত পুলিশ, র্যাব, ডিবিসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থল ঘিরে ফেলেন।
রাত সোয়া ১১টায় ঘটনাস্থলে যান র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজীর আহমেদ। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এ ঘটনার শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। ভেতরে বেশ কয়েকজনকে জিম্মি করা হয়েছে। বেনজীর আহমেদ যখন কথা বলছিলেন তখন ঘটনাস্থলে পৌঁছায় স্পেশাল উইপন্স অ্যান্ড ট্যাক্টিকস (সোয়াট) টিম। এর আগে বন্ধ করে দেওয়া হয় কাকলী, বনানী, গুলশান ১নং মোড়, নতুন বাজার, নর্দা থেকে গুলশান এলাকায় প্রবেশের সব পথ। র্যাবের ডিজি টেলিভিশনে ঘটনাটি সরাসরি সম্প্রচার না করতে অনুরোধ করেন।
রাত ১২টায় ওসি সালাহ উদ্দিন ও ডিবির এসি রবিউলের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে ডিএমপি।
রাত সাড়ে ১২টায় ঘটনাস্থলে পৌঁছায় পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল, ৪টি এপিসি কার। উপস্থিত হন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। তখন জানানো হয়, রেস্টুরেন্টটির ভেতরে বিদেশি নাগরিকসহ ৩০ জনের বেশি মানুষকে সন্ত্রাসীরা জিম্মি করেছে। তার আগে রাত সোয়া ১২টার দিকে রেস্টুরেন্ট পর্যবেক্ষণকারী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এক সদস্য জানান, বেকারিটি সম্পূর্ণ অন্ধকারে। ভেতরে ঢুকে প্রথমেই আলো নিভিয়ে দেয় জিম্মিকারীরা। অন্ধকার থাকায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না।
রাত পৌনে ১টায় রেস্টুরেন্ট থেকে পালিয়ে আসা এক কর্মী জানান, রেস্টুরেন্টের ভেতরে থাকা অতিথিদের বেশিরভাগই বিদেশি। রাত দেড়টার দিকে সাইট ইনটেলিজেন্স গ্রুপ এক টুইট বার্তায় জানায় যে এই হামলার দায় স্বীকার করেছে আইএস।
রাত সোয়া ১টার দিকে অভিযান পরিচালনার উদ্দেশ্যে ওই এলাকায় আলো জ্বালায় ফায়ার সার্ভিস। এর মধ্যে শুরু হয় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতনদের বৈঠক। এর মিনিট দশেক পর ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক। রাত পৌনে ২টার দিকে রেস্টুরেন্টের বাইরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে ভেতরের অবস্থার বিবরণ দেন কর্মচারী সুমন রেজা। তিনি জিম্মি সংকট থেকে পালিয়ে বেঁচে আসেন। সুমনই জানান, ভেতরে ৭-৮ জন সন্ত্রাসীর হামলার কথা এবং সেখানে বেশ কিছু লোকের জিম্মি হওয়ার কথা।
রাত পৌনে ৩টার দিকে রেস্টুরেন্টটির পাশের বাড়ি থেকে আটকে পড়া দু’জনকে উদ্ধার করে সোয়াট টিম। উদ্ধার হওয়া দু’জন রেস্টুরেন্টের আর্জেন্টাইন ডিয়াগো ও বাংলাদেশি বেলারোস।
রাত ৩টার দিকে সন্দেহভাজন হিসেবে রেস্টুরেন্টের সামনে থেকে দু’জনকে আটক করে ডিবি। সে দু’জন হলেন রেস্টুরেন্টের সিকিউরিটি গার্ড হায়দার ও রান্নার সহকারী নাসির। প্রায় ৮ ঘণ্টা পর রাত ৪টার দিকে অভিযানে নামে র্যাবের নেতৃত্বে যৌথবাহিনী। এ সময় অন্তত পাঁচটি সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ শোনা যায়। ভোর ঠিক ৪টায় ভেতর থেকে গুলিবিদ্ধ একজনকে বের করে আনা হয়। এরপর ৪টা ৫ মিনিটে আরও একটি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়। গতকাল শনিবার ভোর সাড়ে ৪টায় গুলশানে হামলার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে অবস্থানরত নাগরিকদের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার পরামর্শ দেয় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের দূতাবাস। ভোর সাড়ে ৫টায় ঢাকাজুড়ে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়। নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয় রেস্টুরেন্টকেন্দ্রিক ৪ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে।
সকাল সাড়ে ৭টার দিকে মাঠে আসে সেনাবাহিনীর বিশেষ কমান্ডো দল। আসে সেনাবাহিনীর ১১টি এপিসি, ১৬টি জিপ ও ৩টি ভ্যানসহ বেশ কিছু সাঁজোয়া যান। দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় মিলিটারি পুলিশকে। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনী ফের অভিযানে নামে। গুলি-গ্রেনেডে প্রকম্পিত হতে থাকে গুলশান এলাকা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এয়ার কমান্ডোর নেতৃত্বে কমান্ডো অভিযান সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে শুরু হয়। ১২ থেকে ১৩ মিনিটের মধ্যেই সব সন্ত্রাসীকে নির্মূল করে ওই এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীতে অপারেশনের অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন করে সকাল আটটায় অপারেশনের সব কাজ সম্পন্ন করা হয়।
১৫ ঘণ্টার এই জিম্মি ঘটনায় ২০ বিদেশি, ছয় সন্ত্রাসী ও দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ মোট ২৮ জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ২০ জন পুলিশ সদস্য। আর ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। এদের মধ্যে শ্রীলঙ্কার দুজন ও জাপানের এক নাগরিক রয়েছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন