শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

যে রায়ের মধ্যে রয়েছে একটি বিশেষ বার্তা

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০২ এএম

গত ২০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালত প্রায় বত্রিশ বছর আগে (এরশাদ আমলে) বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার গাড়িবহরে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ২৪ জনের হত্যা করার মামলায় অভিযুক্ত পাঁচজন পুলিশের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দলের প্রতি আমার নিজের সমর্থন না থাকলেও যেকোনো রাজনৈতিক সভায় বা চলার পথে গাড়িবহরে বা জনসভায় জাতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা নেতাকর্মীকে পুলিশের গুলি করে হত্যা করা কোনো মতেই ন্যায়সঙ্গত ও সমর্থনযোগ্য নয়।
পুলিশের একমাত্র দায়িত্ব শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা এবং অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা। বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের হত্যা বা হেনস্থা করা তাদের দায়িত্ব নয়। কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতি বেশি আনুগত্য প্রকাশ করতে গিয়ে পুলিশ জনগণের টাকায় কেনা গুলি-বন্দুক জনগণের বুকের ওপরেই চালিয়ে দেয়। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, অধিক মাত্রায় সরকারের আস্থাভাজন হয়ে প্রমোশন ও সুবিধামতো লোভনীয় পোস্টিং আদায় করে বিপুল বিত্তবৈভরের মালিক হওয়া। একই কারণে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের পুলিশ জনগণের সাথে যে আচরণ করেছে, স্বাধীন বাংলাদেশের পুলিশ অনুরূপ করছে, বরং ক্ষেত্র বিশেষে ‘অধিক পারদর্শিতা’ দেখাচ্ছে। এ কারণেই সব আমলে পুলিশ থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের বিত্তবৈভবের দিকে দুদকের চোখ সাধারণত পড়ে না। ফলে স¤প্রতি জাতীয় সংসদে পুলিশের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি উঠেছে। পুলিশ সবসময় সব সরকারের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে বিধায় তারা অপ্রতিরোধ্য এবং তাদের আইনের আওতায় আনা খুবই দুরূহ। এ জন্যই অনেকে বলে, ‘মাছের রাজা ইলিশ ও দেশের রাজা পুলিশ।’

চট্টগ্রামে ওই ২৪ জনকে হত্যার হুকুমদাতা আসামিরা অনেকেই জীবিত নেই। তাদের মধ্যে জীবিত পাঁচজনের ফাঁসি হয়েছে। যারা নিহত হয়েছে তাদের পরিবারের সাথে আমিও ব্যথিত, দুঃখিত এবং মর্মাহত। যে পুলিশের প্রধান দায়িত্ব মানুষের জীবন রক্ষা করা সেই পুলিশ স্বাধীন বাংলাদেশের ২৪ জন মানুষকে হত্যা করবে, এটা মেনে নেয়া যায় না মোটেও। পাশাপাশি এটা আশার বাণী যে, ওই ফাঁসির রায় পুলিশ কমিনিউটির প্রতি একটি বার্তা দিয়েছে যে, পুলিশ বলেই তারা জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে ভাবার কোনো কারণ নেই। পুলিশের হাতে নির্যাতিত মানুষ, বিশেষ করে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের মনে একটি আশার বাণী সঞ্চারিত হয়েছে এ কারণে যে, দীর্ঘদিন পরে হলেও আদালত পুলিশের অযাচিত ও নির্বিচারে গুলিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে তাদের ফাঁসি দিয়েছেন।
অন্য দিকে, একটি কথা থেকে যায়, শেখ হাসিনা যদি বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী না থাকতেন তাহলে এহেন রায় পাওয়া যেত কি না সন্দেহ। এরশাদ যদি ক্ষমতায় থাকতেন, তবে এ বিচারের নথি বিচারকের এজলাসে উপস্থিত হতো কি না তা নিয়েও সংশয় প্রকাশের অবকাশ থেকে যায়। কাগজকলমে যাই থাকুক না কেন, আমাদের দেশের বিচারব্যবস্থা কার্যত সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন রয়ে গেছে। তাই চলমান বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে পাবলিক পারসেপশন খুব ভালো নয়। সরকারবিরোধীদের বিচার বিভাগ যেভাবে দেখে, সরকারি দলের লোকদের সেভাবে দেখে না বলেই লোকজনের অভিযোগ।

বিচারকের রায় একটি পাবলিক ডকুমেন্ট। ফলে এর আলোচনা-সমালোচনা ‘আদালত অবমাননা’ হতে পারে না। যা হোক, চট্টগ্রামে ২৪ জন হত্যার পেছনে শুধু অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারই কি দায়ী, নাকি যাদের নির্দেশে এ গুলি চলেছে তারাও দায়ী? এ ধরনের কর্মকান্ডে তদন্ত কমিশন করে পর্দার আড়ালে যারা ছিল বা থাকে তাদের মুখ আদালতের রায়ে উন্মোচিত হওয়া দরকার। পুলিশ নিজেকে পেশাগতভাবে ব্যবহার করার জন্য সচেতন হতে হবে। পুলিশের অযাচিত কর্মকান্ডকে ‘বৈধ’ করার জন্য সবক্ষেত্রেই তারা (পুলিশ) বলে থাকেন, ‘উপরের নির্দেশে করছি।’ কিন্তু একটি স্বাধীন দেশে উপরের কোনো বেআইনি নির্দেশ পালন করতে নিম্নপদস্থ কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা বাধ্য নন। কারণ, আমাদের সংবিধানের ২১(২) অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ অথচ, জনগণের অর্থে লালিত হচ্ছে সরকারের বিভিন্ন বাহিনী, যাদের একাংশ সদস্য জনগণের সাংবিধানিক অধিকারকে অনেক সময়ে পদদলিত করছে।

পুলিশের একশ্রেণির এখন নিজ পেশাগত দায়িত্ব পালনের চেয়ে সরকারের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নানা কৌশলে হেনস্থা করায় বেশি লিপ্ত। ক্ষমতাহীন রাজনৈতিক কর্মীদের গুম ও খুনের অভিযোগে তারা অভিযুক্ত। আরো দুঃখজনক হচ্ছে, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ভোটারবিহীন একটি জাতীয় নির্বাচন করার জন্য পুলিশকে স্ট্রাইকারের ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে সরকার দিয়ে পুলিশ এমনিভাবে ক্ষমতাবানদের নীতিআদর্শ বাস্তবায়নের হাতিয়ারে পরিণত হয়ে এসেছে।

এই আমলে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে যে ‘অত্যাধুনিক অস্ত্র’ পুলিশ ব্যবহার করেছে তা হলো, ‘গায়েবি মোকদ্দমা’, যা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কলঙ্কতুল্য, যার বোঝা বইতে হয় যুগ যুুগান্তর। চট্টগ্রামে ২৪ জনকে হত্যার দায়ে যদি ৩২ বছর পর ফাঁসি হতে পারে, স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও যদি স্বাধীনতাবিরোধীদের মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডের অভিযোগে ফাঁসি হতে পারে, তাহলে গায়েবি মামলার রচয়িতা, পরিকল্পনাকারী ও বাস্তবায়নকারীদের বিচারের দাবিতে একদিন আওয়াজ উঠবে, এটা অস্বাভাবিক নয়। এ রায়টিতে যেমন দুঃখ-বেদনা রয়েছে, অনুরূপ আশার বাণী রয়েছে। তাহলো, রাষ্ট্রীয় কর্মচারীরা যতই ক্ষমতাবান হোন না কেন, তারা জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নন।

স্মর্তব্য, ১৯৮৮ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের আমলে চট্টগ্রামের লালদীঘি এলাকায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে গুলি চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যা এবং তাকে হত্যা প্রচেষ্টার মামলায় তৎকালীন পাঁচজন পুলিশসদস্যের মৃত্যুদন্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। ২০ জানুয়ারি বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারকের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ ইসমাইল হোসেন এ রায় দেন। রায়ে দন্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারায় মৃত্যুদন্ডের পাশাপাশি প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। এ ছাড়া দন্ডবিধির ৩২৬ ধারায় প্রত্যেকের আরো ১০ বছর করে কারাদন্ড দেয়া হয়। তারা হলেন, তৎকালীন প্যাট্রল ইন্সপেক্টর গোবিন্দ চন্দ্র মন্ডল (মামলার বিচার শুরু হওয়ার পর থেকেই পলাতক), সাবেক কনস্টেবল মোস্তাফিজুর রহমান, তৎকালীন হাবিলদার প্রদীপ বড়ুয়া, মো. আবদুল্লাহ এবং মমতাজ উদ্দিন। ঘটনাটি চট্টগ্রাম গণহত্যা হিসেবে অভিহিত। এ সময় নিহত হন হাসান মুরাদ, মহিউদ্দিন শামীম, স্বপন কুমার বিশ্বাস, এথেলবার্ষ গোমেজ কিশোর, স্বপন চৌধুরী, অজিত সরকার, রমেশ বৈদ্য, বদরুল আলম, ডি কে চৌধুরী, সাজ্জাদ হোসেন, আবদুল মান্নান, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন, বিকে দাশ, পঙ্কজ বৈদ্য, বাহার উদ্দিন, চান্দ মিয়া, সমর দত্ত, হাশেম মিয়া, মো. কাশেম, পলাশ দত্ত, আবদুল কুদ্দুস, গোবিন্দ দাশ, মোহাম্মদ শাহাদাত। এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ থেকে আইনজীবী শহীদুল হক বাদি হয়ে চট্টগ্রাম মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে একটি মামলা করেন। মামলায় হত্যাকান্ডের সময় চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি) কমিশনারের দায়িত্বে থাকা মীর্জা রকিবুল হুদাকে প্রধান আসামি করা হয়। এতে তাকে ‘হত্যার নির্দেশদাতা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এই মামলার রায়ে বাংলাদেশের বিচারিক এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থার একটি চিত্র ফুটে উঠেছে। পুলিশ কর্তৃক ২৪ জন হত্যার ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি। কিন্তু পুলিশ নিজ উদ্যোগে কোনো মামলা করেনি অথবা এ মর্মে কোনো জিডি হয়েছে কি না, তাও দেখা যায় না। অথচ ১৯৯২ সালে ৫ মার্চ, অর্থাৎ এরশাদ সরকারের পতনের পরে, একজন আইনজীবী এ মামলাটি করেছেন। এ দেশের বিচার বিভাগ যদি সরকারের কব্জায় না থাকত তবে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ২৪ জন নাগরিক হত্যার দিনই রাষ্ট্র বাদি হয়ে খুনের মামলা দায়ের করতো। যিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকেন তিনি আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে- এ ধারণাটি আমাদের রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত বিধায় যখন যিনি ক্ষমতায় থাকেন তখন তিনিই যেভাবে খুশি আইন ব্যবহার করেন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত, তখন তাদের নতজানু ভূমিকা ‘আইন’ নামক অস্ত্রটিকে ভোঁতা করে দেয়। এ স্বাক্ষরই বহন করেছে এই রায়। এরশাদ সরকারের আমলে শেখ হাসিনার ২৪ জন লোককে হত্যা করা হয়েছে। অথচ, এই এরশাদকে সাথে নিয়েই তিনি ক্ষমতায় এসেছেন। ফলে ‘রাজনীতিতে শেষ কথা নেই’ বলে যে বিশ্বাস রয়েছে, তাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

তৎকালীন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদা মরে গিয়ে বেঁচে গেছেন, নতুবা ফাঁসির দন্ড তাকে ছাড়ত না, বিশেষ করে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল সরকারে থাকাবস্থায় আপিলে খালাস হওয়ার সম্ভাবনা নেই সঙ্গত কারণেই। এ অভিযুক্ত ব্যক্তি পরে পুলিশের সর্বোচ্চ পদ তথা ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশে উন্নীত হয়েছিলেন। অবশ্য তার প্রমোশন দিয়েছে পরবর্তী সরকার। এর পেছনেও কি অন্ধ আনুগত্য কাজ করেছিল?

চট্টগ্রামের আইনজীবী শহীদুল হককে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কারণ অন্যায় অবিচারের, বিশেষ করে প্রভাবশালী ক্ষমতাসীনদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করতে চায় না- এটাই আমাদের দেশ ও জাতির শিষ্টাচারে পরিণত হয়েছে। ২৪ জন হত্যার বিচারে যেখানে রাষ্ট্র এগিয়ে আসেনি, সেখানে একজন আইনজীবী নিজের উদ্যোগে এগিয়ে এসেছেন, তা এ দেশের জন্য একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন