শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

হাজার বছরের পুরনো গাছ

প্রকাশের সময় : ৪ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সৈয়দ টিপু সুলতান
খিলখিল করে হাসতে হাসতে পথচলা ছোট্ট নদীর। নদী কেমনÑ লম্বা লাফ দিয়ে যেন পার হওয়া যায়। অশান্ত এই ছোট্ট নদী শত নুড়ির বাঁধন ছিন্ন করে মিশে গেছে বিশাল প্রশান্ত মহাসাগরে। আমি ও আমার সহধর্মিণী হেঁটে চলেছি নদীর পাশ দিয়ে সহস্র বছরের পুরনো গাছ ‘রেড উড’ দেখতে দেখতে। মাঝে মাঝে দু’চারটে মাছ কিশোর বালকের পানি নিয়ে খেলার মতো চকিতে পানি ছিটিয়ে চলছে উজান পানে। আমরা এসেছিলাম সানফ্রানসিসকোর এপিএইচএ কনভেনশনে প্রায় ৬ হাজার ফার্মাসিস্টের মিলনমেলায়। সপ্তাহব্যাপী কনভেনশনের শেষদিনে হোটেলে ফেরার পথে এক বাঙালি গাড়ি চালকের সাথে কথা হচ্ছিল। দাদা আপনাদের গোল্ডেন গেট দেখিয়ে আনতে পারি। উৎসাহের তেমন সাড়া না পেয়ে আবার বলল, ‘তবে গাছ-টাছ পছন্দ করলে গঁরৎড়িড়ফং, ঘধঃরড়হধষ গড়হঁসবহঃ-এ যেতে পারেন, সেখানে ২/৩ হাজার বছরের পুরনো গাছও দেখতে পাবেন। ওটি সাজানো বাগান কিনা জানতে চাইলে খুব নিচু স্বরে বলল ‘তা নয়Ñ অনেকটা অগোছালো জঙ্গলের মতো’। তড়িৎগতিতে মনটা উৎসাহ-উদ্দীপনায় ভরে গেল। গাড়ির চালক অবাক অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমরা যতই দেখছি বিস্ময়ে আনন্দে আপ্লুত হচ্ছি। এক জায়গায় দেখি একটি ডোবার মতো। গাছের ডাল ভেঙে পড়ে আছে পানিতে। চারদিকে ঝোপ-ঝাড়। ছোট ছোট মাছ মাটি কামড়ে দলবেঁধে চলছে। মনে পড়ে গেল এমনি ডোবায় শৈশবে বৃষ্টির মাঝে পা দিয়ে পানি ঘোলা করে বড়শি দিয়ে শিং মাছ ধরার কথা। ছায়া ঘন ছাড়াবাড়ির জঙ্গলের মাঝে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে কুড়িয়েছি কুল, আম, জাম, জামরুল, কাউ, বেতফল আরো কত কি! সারাটা শরীর-মন নষ্টালজিয়ায় কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে উঠলো। এত দূরে এসে ২৫ বছর প্রবাস জীবন-যাপনের পরও প্রতিক্ষণ মন পড়ে থাকে ধূলায় মাখা ধোঁয়ায় ভরা, শাপলা তোলা চিরসবুজ অনিন্দ্য-সুন্দর বাংলাদেশ। শীত শীত লাগছে। ছায়াঘেরা গঁরৎড়িড়ফং-এ দিনের বেলায়ও ৪০/৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা থাকে। কুরী একটা গরম পুল ওভার কিনে নিয়ে আবার যাত্রা শুরু। পৃথিবীর দীর্ঘতম ও প্রাচীনতম গাছ সমৃদ্ধ মনুমেন্টের জায়গায় জায়গায় বিধৃত করা আছে। ১৯০৮ সালে ২৯৫ একর জমি ও গাছসহ উইলিয়াম কেন্ট প্রেসিডেন্ট থেয়ডর রুজভেল্টকে একটা চিঠির মাধ্যমে সরকারকে উপহার হিসেবে দেয়ার প্রস্তাব করেন। কেন্ট এত উদারমনা ছিলেন যে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের মতের বিরুদ্ধে নিজের নাম মনুমেন্টের নাম না রেখে আর এক মনীষী গাছ প্রেমিক ঔড়যহ গঁরৎ-এর নাম প্রস্তাব করেন। প্রেসিডেন্ট থেয়ডর রুজভেল্ট তাই মনুমেন্টের নামকরণ করেন ঃ গঁরৎড়িড়ফং ঘধঃরড়হধষ গড়হঁসবহঃ. ঔড়যহ গঁরৎ- ডরষষরধস কবহঃ-কে দেয়া চিঠির এক জায়গায় লিখেন ঃ “ঝধারহম ঃযবংব ড়িড়ফং ভৎড়স ঃযব ধীব ্ ংধ,ি ভৎড়স সড়হবু পযধহমবৎং ধহফ ধিঃবৎ-পযধহমবৎং ্ মরারহম ঃযবস ঃড় ড়ঁৎ পড়ঁহঃৎু ্ ঃযব ড়িৎষফ রং রহ সধহু ধিুং ঃযব সড়ংঃ হড়ঃধনষব ংবৎারপব ঃড় এড়ফ ্ সবহ” সর্বোচ্চ গাছের উচ্চতা ৩৬৮ ফুট ও সবচেয়ে পুরনো গাছের বয়স ৩০০০ বছর। এ সময়ের মধ্যে পৃথিবীর কত পরিবর্তন হচ্ছেÑ কত জনপদ সময়ের গর্ভে বিলীন হচ্ছে কিন্তু গাছগুলো ঠিকই মানুষের সুখ-দুঃখ, বিরহ-মিলন, যুদ্ধ-বিগ্রহ, প্রেম-ভালোবাসা, কামনা-বাসনার নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনির্বাণ শিখার মতো।
পাহাড়ের উপর থেকে সমুদ্র দর্শনের পথে ওঠতে ওঠতে ভাবলামÑ বাংলাদেশে যদিও গাছ লাগানোর কিছুটা প্রবণতা বেড়েছে কিন্তু সংরক্ষণ মোটেই করা হচ্ছে না। সরকারি রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অভাবে সুন্দরবনের কাঠ কেটে অসুন্দরবনে পরিণত করা হচ্ছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার ফলে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে।
আঁকাবাঁকা রাস্তা ধাপে ধাপে ওঠে গেছে ঙপবধহ ারবি ঞৎধরষ-এর দিকে। প্রাকৃতিক নিয়মে বিভিন্ন স্তরে স্তরে গাছগুলো সজ্জিত। প্রায় ৮০০ ফুট উপরে ওঠার পর গঁরৎড়িড়ফংসহ প্রশান্ত মহাসাগরে অপরূপ দৃশ্য মন কেড়ে নেয়। মানুষের দ্বারা নয় প্রকৃতির সাজানো সৌন্দর্য যেন নিজস্ব মহিমায় ভাস্বর। এই এরকম গভীর বনে গেলেই যেন মনে হয়Ñ গাছে গাছে কথা কয়। গাছেরও জীবন আছে, অনুভূতি আছে। গাছেরা কত নিঃস্বার্থভাবে বিলিয়ে দেয় নিজেকে মানুষের কল্যাণে। ফুল দেয়, ফল দেয়Ñ সৌরভ ছড়ায় চারদিকে, সৌন্দর্য দেয়, সজীবতা দেয়, ছায়া দেয় ক্লান্ত পথিককে, এমনকি নিজেকে পুড়িয়ে নিঃশেষে উত্তাপ দিয়ে যায় মানুষকে। কয়লা এবং ভস্মও কাজে আসে মানুষের।
নামতে নামতে মনটা এবার বিষণœতায় ভরে গেলো। মনে হলো দেশে আমার তিনটা বাগানের কথা। প্রায় ১৫০ রকমের কয়েক হাজার গাছের সমারোহ বিক্রমপুরের কুসুমপুরে ও কাঁচপুরে। ভাই ও বোনসহ প্রায় সবাই এখানে। ছেলেমেয়েরা এদেশে বড় হয়ে কি দেশে যাবে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য? এবার ভাবলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে হয়তো কবহঃ-এর মতো উপহার দিয়ে দিব। না তা হলে হয়তো গাছগুলো অব্যবস্থাপনায় কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। আমার সুপারি গাছগুলো গত এক বছরে কত বড় হয়েছে? ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। কবে যাবো দেশে? বুঝলাম অক্ষমতা-অপারগতা ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলছে আমাকে। গাছগুলোর কথা মনে হলে হৃদয়ের গহীন কোণে কোথায় যেন মোচড় দিয়ে ওঠলো। হয়তো ওরাও আমাকে দেখার জন্যে ব্যাকুল হয়ে আছে, কিন্তু দুর্ভাগ্য ওদের অনুভূতি ওরা প্রকাশ করতে পারছে না।
অন্য কোনো (ট্রেইল)-এ না গিয়ে সোজা পার্কিং লটে চলে এলাম। চালক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। কারণ ওর শিফ্ট বদলাচ্ছে। গাড়ি চলার পথে সেল ফোনের আওয়াজে নীরবতা ভাঙলো। চালক বললো ছেলে তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে বলেছে। কারণ পরের শিফট ছেলের। জিজ্ঞেস করলাম এই কচি বয়সে ছেলেকে ড্রাইভিং-এ লাগালেন! দাদা গাড়ি চালানোতেই কাঁচা পয়সা। তাছাড়া গাড়িটা লিজে নেয়া। অর্ধেক বেলা বাবা, অর্ধেক চালাবে ছেলে। বেশ চলে যাবে। পড়ন্ত বিকেল। নীল আকাশে মেঘের ভেলা উড়ে চলছে দ্রুত। গাড়ির কাঁচ খুলতেই একরাশ হাওয়া এসে মনের অনেক অব্যক্ত ব্যথা উড়িয়ে নিয়ে গেল। হয়তো রেখে গেল অন্যকিছু।
মনে হলো জাতিসংঘের প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেল উঅউ ঐঅগ- গঅজঝকঔঙখউ-এর কথা। ১৯৫৫ সালে গঅটওজডঙঙউঝ দেখে বলেছিলেন “চবৎংড়হং ডযড় ষড়াব ঘধঃঁৎব ভরহফ ধ ঈড়সসড়হ ইধংরং ভড়ৎ টহফবৎংঃধহফরহম চবড়ঢ়ষব ড়ভ ড়ঃযবৎ ঈড়ঁহঃৎরবং, ঝরহপব ঃযব ষড়াব ড়ভ ঘধঃঁৎব রং টহরাবৎংধষ অসড়হম গবহ ড়ভ ধষষ ঘধঃরড়হং” আরও মনে হলো বিভূতি ভূষণের পথের পাঁচালীর কথা। অপু ও দুর্গার প্রকৃতিকে দুর্বার ভালোবাসার কথা। বিভূতি ভূষণ আজ নেই। কিন্তু তাঁর অমূল্য সৃষ্টি রেখে গেছেন পথের পাঁচালী। তাঁর সাথে যেন কথা হয়, ভাববিনিময় হয়। অপু হয়ে যেন পুনর্জন্মে ফিরে আসি। সর্বজয়ার অভাবক্লিষ্ট সংসার। দুর্গাকে নিয়ে ঘুরে ফিরি বনে-জঙ্গলে কিন্তু তখন যেন মৃত্যু না হয় দুর্গার অকালে।
লেখক : গবেষক ও আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির সভাপতি

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন