শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

খেলাধুলা

নেপথ্যের নায়কেরা

মো. জাহিদুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম

বাংলাদেশ অন‚র্ধ্ব-১৯ দলের ম‚ল শক্তি ব্যাটিং, বোলিং নাকি ফিল্ডিং? উত্তরটা চমকে দেওয়ার মতোই। এর কোনোটিই নয়। সতীর্থদের ওপর আস্থা, নিজের আগে দলকে রাখার সংস্কৃতি, ব্যক্তিগত লক্ষ্য স্থির না করে দলীয় লক্ষ্যে অবিচল থাকা-এগুলোই বাংলাদেশকে জিতিয়েছে যুব বিশ্বকাপ। পৃথিবীতে আচমকা,অযৌক্তিক কোন কিছু হয় না। সব কিছুর পেছনেই থাকে যৌক্তিক কারণ। এই বিশ্বজয়ের সম্মুখ নায়কদের আড়ালেও লুকিয়ে আছে অনেক নেপথ্য নায়ক। কিভাবে তারা দল গড়লেন, সফলতাই বা এল কিভাবে? পাঠককে আজ নিয়ে যাব তাদের কাছে। যারা আজ আসছেন দেশে। বিশ্বজয়ীদের বীরোচিত সংবর্ধনা দিতে সকল প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে বিসিবিও।

তিলে তিলে গড়ে উঠেছে এই আত্মবিশ্বাসী মানসিকতা। বাংলাদেশের হৃদয় ভাঙার এক গল্পের পর এর শুরু। দেশের মাটিতে ২০১৬ বিশ্বকাপের যুব দলটি নিয়ে অনেক আশা ছিল। তরতর করে সেমি-ফাইনালে পৌঁছে গিয়েছিল মেহেদী হাসান মিরাজ-নাজমুল হাসান শান্তদের দল। এরপরই স্বপ্ন ভঙ্গ। ঘরের মাঠে আগে যাদের বলে-কয়ে হারাতো, সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেমি-ফাইনালে হেরে যায় বাংলাদেশ।
এবার বাংলাদেশ শুরু থেকেই ভাবনাটা রেখেছে চ‚ড়ায়। তাই প্রস্তুতিটাই ছিল আলাদা ধাঁচের। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিসিবির গেম ডেভপালাপমেন্ট কমিটি তুখোড় পরিকল্পনা করেই নিয়ে এসেছে এমন সাফল্য। বিসিবিতে ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটি যেমন দেখভাল করে জাতীয় দলের, তেমনি গেম ডেভলাপমেন্ট কমিটির দায়িত্ব বয়সভিত্তিক দলগুলোকে শান দিয়ে তৈরি করা। অন‚র্ধ্ব-১৩, ১৫, ১৭ ও ১৯ দলের খেলোয়াড় সংগ্রহ, যাবতীয় প্রস্তুতি, ম্যাচ পরিকল্পনার ভার তাদের উপরই ন্যস্ত।

এই কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ সুজন। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে প্রথম বড় কোন জয়ের নায়ক সুজন। তবে খেলোয়াড়ি জীবন ছাড়ার পর সংগঠকের ভ‚মিকায় একই সঙ্গে নন্দিত এবং নিন্দিত তিনি।

বাংলাদেশের আরেকজন আছেন এই গর্বের ভাগীদার। ফয়সাল হোসেন ডিকেন্স। দেশের জার্সিতে একটি টেস্ট ও ছয়টি ওয়ানডে ও ঘরোয়া ক্রিকেটের নিয়মিত পারফরমার। যুবাদের ফিল্ডিং কোচের দায়িত্ব নেন ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে। টাইগারদের সাবেক এই ক্রিকেটার লম্বা সময় ধরে কাজ করেছেন তরুণদের নিয়ে।

অস্ট্রেলিয়ায় থিতু শ্রীলঙ্কান কোচ নাভিদ নওয়াজকে আনা হয় যুব দলের কোচ করে। পেসাররা কঠোর পরিশ্রম করেন আরেক লঙ্কান কোচ চাম্পাকা রামানায়েকের অধীনে। ইংলিশ ট্রেনার রিচার্ড স্টয়নারের অধীনে ক্রিকেটাররা হয়ে ওঠেন আরও ফিট। পাল্লা দিতে পারেন যে কোনো অ্যাথলেটের সঙ্গে। ফুটবলার কিংবা অ্যাথলেটরা যে মানের ফিটনেস অনুশীলন করেন, আকবর-হৃদয়রা করতেন সেই ধরনের অনুশীলন। সেই ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকেই পথচলা শুরু আজকের বিশ্বজয়ের।

সেই বিশ্বজয়ের অন্যতম অগ্রদূত হোয়াইটমোরের সাবেক ক্রিকেটার স্টয়নার। যিনি বাংলাদেশে দেড় বছর ধরে কাজ করছেন। দলের শক্তিমত্তা, দৃর্বলতা ও সক্ষমতা নির্নয় করে নিরলস পরিশ্রম করে এনে দিয়েছেন বিশ্বকাপ। পাকিস্তান ঘরোয়া ক্রিকেটেও ফিটনেসের উন্নয়নেও আগে কাজ করেছেন তিনি। তার সমগ্র কাজের প্রতিফলন দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত তিন সপ্তাহের টুর্নামেন্টে। তার বিচক্ষণতায় আকবরদের পথ হয়েছে মসৃণ। ৩৫ বছর বয়সী এই কোচ বলেন, ‘ছেলেরা এককথায় অসাধারন খেলেছে। আমি তাদের নিয়ে গর্ববোধ করি। সবশেষ ১২ মাস সত্যিই ছিল একটি অসাধারন যাত্রা। খেলোয়াড়রা যে পরিশ্রম করেছে, তাতে তারা বিশ্বকাপের যোগ্য দাবিদার ছিল। বেশিরভাগ সময়ই তারা ছিল পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন।’

সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি ও চরম অর্থনৈতিক সঙ্কট নিয়েও মনোবল হারায়নি যুবার বলে মন্তব্য করেন তিনি। তবুও দেখেছেন লড়াইয়ের মানসিকতা, ‘অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ও অবকাঠামোগত নানাবিধ সমস্যার সঙ্গে লড়াই করেছে ছেলেরা। কিন্তু কঠোর পরিশ্রম করে সব প্রতিকূলতাকে জয় করেছে তারা। সময়টা আরও কঠিন হয়ে ওঠে ছেলেদের পরিবারের অর্থনৈতিক দুর্বলতাকে কেন্দ্র করে। কখনও কখনও তারা একধাপ পিছিয়েও পড়ত। পরিবারকে সমর্থন দেয়ার জন্য দৈনিক হারে ভাতাও নিত তারা।’

বাংলাদেশের সাফল্য হয়তো অনেককেই বিস্মিত করেছে। কিন্তু ক্যাম্পে অবস্থানকালে তারা বিশ্বাস করত, তারা পারবে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল স্টোকসিটির একজন ভক্ত স্টয়নার। তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশে আছি ২০১৮ সালের জুলাই থেকে। প্রাথমিকভাবে ‘এ’ দল নিয়েই কাজ করতাম। কিন্তু অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিশ্বকাপকে সামনে রেখে ১২ মাস আগে থেকেই আমি প্রস্তুতি নেয়া শুরু করি।’

দলের অন্যান্য কোচিং স্টাফকে সবাই ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করলেও আমাকে তারা ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করে। এতে বোঝা যায়, তারা কতটা ভরসা করে আমার ওপর।’

এই বিশ্বকাপে সেরা প্রস্তুতি নিয়ে দল পাঠাতে দেশে ও দেশের বাইরে আয়োজন করা হয় সাতটি দ্বিপাক্ষিক ও ত্রিদেশীয় সিরিজ। বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত এই সময়ে বাংলাদেশের ছেলেরা ৩৬টি যুব ওয়ানডে খেলেছে, জিতেছে ২১টিতে, হেরেছে মাত্র ৮ ম্যাচ। টাই হয়েছে এক ম্যাচ। ফল হয়নি তিন ম্যাচে, পরিত্যক্ত হয়েছে বাকি তিন ম্যাচ। বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া আর কোন দল এত ম্যাচ খেলেনি। এমনকি ফাইনালে বাংলাদেশের কাছে হারা ভারতের যুবারাও খেলেছে ৩১ ম্যাচ, শ্রীলঙ্কা ৩০ ম্যাচ। বাকিরা বেশ খানিকটা পিছিয়ে। এই দীর্ঘ সফরে দলের প্রতিটি ক্রিকেটারকেই সম্মান করেন স্টয়নার, ‘নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ড সফরে সফলতার পর এশিয়া কাপের ফাইনাল। তারপর ইংল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ঘরের মাঠে সিরিজ। আমরা অনেক ক্রিকেট খেলেছি। প্রস্তুতিও নিতে পেরেছি পর্যাপ্ত। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয়। এই দলের অংশ হয়ে আমি গর্বিত। এই ১৫ জনের ক্রিকেটারের বাইরেও যারা দেশে অবস্থান করছে তাদের আমিসম্মান করি।’

বিশ্বকাপের আগে বগুড়ায় তিন সপ্তাহের একটি নিবিড় প্রস্তুতি ক্যাম্প করে বাংলাদেশ। প্রস্তুতি পর্বের একটা অংশে সিরিজ খেলে হাই পারফরম্যান্স ইউনিটের বিপক্ষে। যে দলে ছিলেন জাতীয় দলের বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়। বিশ্বকাপে নজর কেড়েছে বাংলাদেশের দুর্দান্ত ফিল্ডিং। আড়াল দিতে হবে এমন কোনো ফিল্ডার নেই দলে। বাংলাদেশের পেসারদের ফিল্ডিং সাধারণত ভালো হয় না। কিন্তু এখানে চিত্রটা ভিন্ন। শরিফুল ইসলাম, তানজিদ হাসানরাও ফিল্ডিংয়ে দারুণ। ফাইনালে দুটি দারুণ ক্যাচ নেন শরিফুল, করেন একটি রান আউট।

ফাইনালে হৃদয় জেতে বাংলাদেশ, শিরোপা জেতে প্রতিপক্ষ-ক্লিশে শোনালেও এটাই যেন ছিল বাস্তবতা। তবে সেই ধারা এবার বদলেছেন সোনার ছেলেরা। এই যুবারাই একসময় করে দেখাবে আরও বড় কিছু। বিশ্বাস করেন স্টয়নার, ‘দিনের পর দিন তারা নিজেদের উন্নয়ন ঘটিয়েছে। যখন আমি দলের দায়িত্ব নেই, তখন আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলাম তাদের একগ্রতা দেখে। বিশ্বকাপের ফাইনালে জিতেতো তারা ইতিহাসই রচনা করল। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই, এক সময় আমি তাদেরকে টেলিভিশনের পর্দায় বড় স্কোর করতে দেখব। উইকেট শিকার করতে ও দুর্দান্ত ফিল্ডিং করতে দেখব। এটা শুধুই সূচনা পর্ব। সামনে আরও বড় অর্জণ আসবে।’

এমন দুনিয়া মাত করা সাফল্যের পর শঙ্কার জায়গা থাকার কথা না। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা যে ভিন্ন। একটু উদাহরণ দিলেই পরিষ্কার হবে। ভারতের শিখর ধাওয়ান আর বাংলাদেশের আফতাব আহমেদ একই আসরে যুব বিশ্বকাপ খেলেন। শিখর এখন দুনিয়া সেরা ওয়ানডে ব্যাটসম্যানদের একজন। আর আফতাব খেলা টেলা ছেড়ে করাচ্ছেন ঘরোয়া কোচিং। ২০০৮ সালে একই যুব বিশ্বকাপে খেলেছিলেন ভারতের বিরাট কোহলি, বাংলাদেশের মোহাম্মদ মিঠুন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দুজনের অবস্থান আজ কোথায়, এই কথা বুঝিয়ে বলা অনর্থক। যুব দল থেকে জাতীয় দলে আসার প্রক্রিয়া যদি ঠিক না থাকে। আজকের আকবর ভবিষ্যতের মহেন্দ্র সিং ধোনির পর্যায়ে যেতে পারবেন তো? যদি না হয় তাহলে এই সাফল্য হয়ে থাকবে কেবলই ক্ষণিকের আনন্দ।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন