বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ঠিকানা

প্রকাশের সময় : ৪ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

খাতুনে জান্নাত কণা
ঃ মিসেস সালেহা, খাবার-দাবার কিছু গুছিয়ে দাও, বৃদ্ধাশ্রমে যাই।
সাদিক সাহেবের রসিকতায় তার স্ত্রী অবাক হন।
ঃ তুমি কেন যাবে বৃদ্ধাশ্রমে খোঁজ-খবর নিতে? আমাদের পরিশ্রম করে উপার্জনের বয়স এখনও শেষ হয়নি। ছেলে- ছেলেবৌ প্রতিটি কাজে আমাদের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেয়। ওরা এখন পর্যন্ত আমাদের উপর নির্ভরশীল।
ঃ সালেহা তুমি বুঝতে পারছো না। আমি নিজের জন্য খোঁজ নিতে যাবো, তাতো বলিনি। যারা ওখানে থাকে, তাদের খবরা-খবর জেনে আসবো।
ঃ বুড়ো বয়সে সাংবাদিকতা?
ঃ তা বলতে পারো। ছাত্র জীবনে কিছুদিন করেছিলাম। বাবার ব্যবসা পাহারা দেয়ার জন্য সব বাদ দিতে হলো। কিছু শুকনো খাবার তৈরী করে দাও, বুড়ো-বুড়িদের জন্য। খাইয়ে আসি।
ঃ হঠাৎ এই আগ্রহের কারণ?
ঃ কারণ তেমন কিছু নয়। পরিচিত একজনের খবর পেলাম। তাকে দেখতে গিয়ে বাকীদের খবরা-খবর জেনে আসবো। লোকটা আমাদের গ্রামের। পাশের বাড়ী থাকতো। বাবা-মা অনেক কষ্টে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করেছিলেন। বাকী গল্প তোমাকে ফিরে এসে বলবো।
ঃ তাহলে দুপুরের জন্যও কিছু রান্না করা খাবার দিয়ে দিই।
ঃ খুবই ভাল হয় তাহলে। আমার খাবারটাও তার সাথে দিয়ে দিও। ফিরতে ফিরতে বেলা গড়িয়ে যাবে।
ঃ ঠিক আছে।
সাদিক হোসেন যখন প্রবীণ নিবাসে পৌঁছলেন, তখন ঘড়িতে পৌনে একটা বাজে।
ঃ আহসান ভাই, কি করছেন?
ঃ আরে সাদেক তুমি? কি খবর ভাই? কেমন আছো?
ঃ আলহামদুলিল্লাহ্, ভাল আছি। আপনার কথা শুনলাম একজনের কাছে। তাই দেখতে এসেছি। আমার বৌ আপনাদের জন্য কিছু রান্না করা খাবার পাঠিয়েছে। হাত মুখ ধুয়ে আসুন। একসাথে বসে খাওয়া যাবে।
ঃ আমি এসেছি তাও তো গত এক বছর হলো। এখানে ভালোই আছি। মনটা একটু খারাপ লাগে। কিন্তু কি আর করা!
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন আহসান সাহেব। তোয়ালে হাতে বেড়িয়ে গেলেন। খানিক পর দু’জন বৃদ্ধ মানুষকে সাথে নিয়ে ভেজা হাত-মুখ মুছতে মুছতে রুমে ঢুকলেন। সাদিক হোসেন এতক্ষণে পুরো ঘরটাতে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েছিলেন। বাড়ীতে শোবার ঘর যতটা বড় হয়, তার চার ভাগের এক ভাগেরও কম হবে ঘরটার আয়তন। একদিকে একটা সিঙ্গেল বেড পাতা। হাসপাতালের বেডগুলোর সাইজ। তাতে পরিপাটি করে বিছানা পেতে রেখেছেন আহসান সাহেব। একদিকে একটা বুক শেলফে নানা রকম বই সাজিয়ে রাখা। বেডের পাশের ছোট্ট টেবিলে একটা রেডিও। পানির জগ, মগ আর একটা চায়ের কাপ। পাশে ছোট নোটবুক, কলম আর চশমা। টেবিলের পাশ ঘেঁষে প্লাস্টিকের একটা সিঙ্গেল ওয়ারড্রোব। মনে হয় তাতেই কাপড়-চোপড় আর টুক-টাক ব্যবহারের সরঞ্জামগুলো রাখেন। সেটার ড্রয়ার থেকে দুটো প্লেট বের করলেন। সঙ্গীদের একজনকে বললেনÑ
ঃ আপনাদের রুম থেকে প্লেটগুলো আনতে পারলে ভাল হতো।
ঃ বেশতো আসুন। প্লেট এনে একেবারে খেতে বসলেই হবে।
পর্যাপ্ত খাবার থাকায় সবাই বেশ তৃপ্তি নিয়ে খেল। আহসান তার সঙ্গীদের রুম থেকে আরো দুটো প্লেট এনেছিলেন। তাই চারজনে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই খাবার খেলেন। কিছুক্ষণ পর আহসান-এর সঙ্গীরা চলে গেলে সাদিক হোসেন জানতে চাইলেনÑ
ঃ ভাই, আপনার রাজা-বাদশার জিন্দেগী হঠাৎ বৃদ্ধাশ্রমে এসে থমকে দাঁড়ালো কেন ?
হু হু করে কেঁদে ফেললেন আহসান। কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেনÑ
ঃ ভাই, পাপ। পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না। আমি এক মহাপাপি। নিজের মা-বাপকে কষ্ট দিয়েছি। তাই আজ আমার এই পরিণতি।
আমার ছেলেকে আর্মিতে চাকরি হওয়ার পর, বিয়ে দিয়েছিলাম এক ধনী পরিবারের মেয়ের সাথে। মেয়ে বেশ সুন্দরী আর লেখাপড়া জানা। আমার আর তোমার ভাবীর তো ছেলেবৌ পেয়ে গর্বে মাটিতে পা পড়ে না অবস্থা। উচ্চশিক্ষিত, ধর্নাঢ্য ফ্যমিলির মেয়ে পেয়ে আমরা যেন আসমান ছুঁয়েছি। এমনই ছিল ভাব। আমার রিটায়ারমেন্ট এর টাকা দিয়ে একটা বাড়ী কিনেছিলাম ময়মনসিংহ শহরে। সেটা ভাড়া দিয়েছি। ঢাকার মিরপুরে যে ফ্ল্যাট আগেই কিনেছিলাম, সেটাতে সবাই থাকতাম। বিয়ের পর, ছেলে শ্বশুরবাড়ী থেকে ফ্ল্যাট পেল। বৌ নিয়ে সেখানেই থাকে। তোমার ভাবীর বাপের বাড়ীর টান সম্পর্কে তোমরা তো সবাই জানো। ওর ছোট ভাইটা চেষ্টা করেও কোনো কাজ জোটাতে পারেনি। শেষে বৌ-বাচ্চা নিয়ে আমার ফ্ল্যাটেই চলে আসে। ফ্ল্যাটটা তোমার ভাবীর নামে কিনেছিলাম। কিভাবে যেন সাদা কাগজে সই নিয়ে, তার ভাই ওটা নিজের নামে লিখে নেয়। শয়তানী কাজে ওরা খুব পারদর্শী ছিল। তোমার ভাবী এ শোক সইতে পারেননি। স্ট্রোক করে তিন বছর বিছানায় পড়েছিল। সে অবস্থাতেই তার মৃত্যু হয়। নিজের ফ্ল্যাটেই আশ্রিতের মত ছিলাম। কি করবো? ছেলে সব জেনে শুনে মায়ের ওপর ক্রুদ্ধ হয়। শেষের দিকে আমাদের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখেনি। মা অসুস্থ জেনে দু’একবার দেখতে এলেও বেশীক্ষণ থাকেনি। ওদের বাসায় গেলে যে বিরক্ত হতো, এটা বুঝতাম। ময়মনসিংহের বাড়ীর, ভাড়ার টাকায়ই আমার খরচ চালাতে হতো। ব্যাংকে জমানো টাকার পরিমাণ খুব বেশী ছিল না। তাই, শালার অত্যাচার সত্ত্বেও আশ্রিতের মত তাদের সাথেই ছিলাম। তোমার ভাবীর সেবা যতœ আমাকেই করতে হতো।
ঃ অনেক কষ্ট করেছেন দেখছি।
ঃ হ্যাঁ সাদেক। মন খুলে কথা বলার মত কাউরে পাই না। আজ তুমি আসছো। তাই তোমারে পেয়ে একটু দুঃখের কথা বললাম। ছেলেটা আমার মত অত খারাপ না যে বৃদ্ধ বাবাকে রাখতে চায়নি। ওর মা মারা গেলে আমাকে নিজের কাছে নিয়ে রাখছিল কয়দিন। ওদের আবার যখন তখন বিদেশ যেতে হয়। এখানে ওখানে পার্টি ফাংশান লেগেই থাকে। বাচ্চাকে সব জায়গায় নিলেও আমাকে সাথে রাখাটা ওদের জন্য বিব্রতকর। আমার জন্যও। এক সময়ের সরকারী কর্মকর্তা ছেলে- ছেলেবৌ এর পেছন পেছন এখানে সেখানে ফেউ ফেউ করে ঘুরছে, এটা একটা লজ্জা-শরমের ব্যাপার মনে হয়। মনে হলো আমারে নিয়ে ছেলে একটু মানসিক অশান্তির মধ্যে পড়ছে। না কইতে পারে। না সইতে পারে। আমি ওদের জন্য এক বাড়তি বিড়ম্বনা। কি খাবো-দাবো, কেমন করে থাকবো এসব নিয়ে ঝামেলা পোহাতে হয়। ওরা বাসায় না থাকলে আমারও লোনলি লাগে। তাই আমিই ছেলেরে প্রস্তাব দিয়ে বসলাম, “বাবা আমি বরং বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে থাকি। মাঝে মধ্যে তোরা একটু দেখা করে আসিস। তাইলেই চলবে।”ছেলে- ছেলেবৌ একটু দোনামোনা করলো নিজেদের স্ট্যাটাসে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে যদি, তাই। আমি বললাম, “কাউরেই কিছু জানাবো না।” একান্ত ঘনিষ্ট দুই একজন ছাড়া এ খবর কেউ জানেও না। তুমি ক্যামনে জানলে ভাই? আমার ছোট বোনের কাছে শুনছো? বোনটাই খালি বেঁচে আছে। বড় দুই ভাইতো আগেই মারা গেছে। তাদের ছেলে-মেয়েরাও সব দেশের বাইরে থাকে। তোমার পরিবারের সবাই কেমন আছে?
ঃ আলহামদুলিল্লাহ্। আপনাদের দোয়ায় ভাল আছে। আপনি ঠিকই বলেছেন। আপনার ছোট বোনের কাছে শুনেছি। আপনার মা কিন্তু তার কাছে বেশ যতেœ ছিলেন। যতদূর জানি, আপনার বোনের ছেলেরা সবাই একই বাড়ীতে থাকে। আলাদা ফ্লোরে বাস করে। রান্না-বান্না আলাদা হলেও, সবাই সবার খোঁজ-খবর রাখে। কারো ঘরে ভালো কিছু রান্না হলে, বেশী রান্না হয়। যা সবাই মিলে খায়। মা-বাবার খোঁজ-খবর যে যার মত করে রাখে। তাদের সহযোগিতায় বাজার-রান্না এসব কিছুতেই মা বাবার কষ্ট বা চিন্তা করতে হয় না। যার যার সুবিধামত বাজার করে মা-বাবার ঘরে পৌঁছে দিয়ে যায়। বাবা-মায়েও তাদের সুবিধা মত ছেলেদের সংসার বা কাজে সহযোগিতা করেন। গাছের ফল-মূল একবারে পেড়ে, সবার ঘরে ভাগ করে করে পৌঁছে দেয়া থেকে শুরু করে, মৌসুমের পিঠা-পায়েস বানিয়ে খাওয়ানোর কাজও তারাই করেন। আমাদের পাশাপাশি বাসা দেখে এত খবর জানি। আপনার জন্য সেদিন অনেক আফসোস করছিলেন। হঠাৎ মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন আপনি এখানে। পরে নিষেধ করে দিয়েছেন, যেন কাউকে না বলি। সালেহা, মানে আমার স্ত্রী বলছিল আপনাকে ক’দিনের জন্য বেড়াতে নিয়ে যেতে। সমস্যা না থাকলে আজই চলুন না। আপনার বোনের সাথেও এই সুযোগে দেখা হতো?
ঃ এখন সম্ভব না সাদেক। ময়মনসিংহ থেকে আগামী সপ্তাহে আমার বাড়ীর কেয়ার-টেকার দেখা করতে আসবে। কিছু টাকা-পয়সা লেন-দেনের ব্যাপার আছে। তুমি আসছো দেখে আমি অনেক খুশী হইছি ভাই। দোয়া কইরো আমার জন্য। ফোন নাম্বার দিয়ে যাও। সময় সুযোগ মতো ফোন দিলে বেড়াইতে নিয়ে যাইও।
ঃ ঠিক আছে। আমার একটা কার্ড রাখেন। এখন তাহলে উঠি ভাই।
ঃ আচ্ছা। আবার আইসো।
আহসানের সাথে কোলাকুলি করে বিদায় নিলেন সাদিক হোসেন। বের হতে হতে ঘড়ি দেখলেন। বেলা এখন আড়াইটা। বাসায় ফিরে প্রথমে জোহর নামাজটা সেরে নিতে হবে।
পাক্কা এক ঘণ্টা লাগলো বাসায় ফিরতে। সাড়ে তিনটার সময় জোহর নামাজ পড়ে বেডরুমে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। আছরের আগ পর্যন্ত একটু রেস্ট নিবেন ভাবলেন।
ঃ কি খবর? বাসায় ফিরে কিছু খেলে না যে?
ঃ তুমি যে খাবার দিয়েছো সালেহা, তা সবাই পেট ভরে খেয়েছি। একটুও খিদে পায়নি। তোমাকে তখন বলিনি। আজ যাকে দেখতে গিয়েছিলাম, তিনি আবিদের মেজ মামা। আহসান ভাই।
ঃ আমাদের পাশের বাসার আবিদ? কি বলছো এসব? ওর মাতো বেশ ভদ্রমহিলা। নিজের ছেলেদের নিয়ে কি চমৎকারভাবে যৌথ পরিবারের মতই থাকছেন। কেমন দেখলে?
ঃ আছেন আর কি। তুমি শুনলে অবাক হয়ে যাবে, ভদ্রলোক তার মা-বাবাকে কতটা কষ্ট দিয়েছে।
ঃ তাই নাকি?
ঃ হ্যাঁ। তারা বেশী ভাই-বোন থাকায় মা বাবাকে খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হতো। তারপরো তার মায়ের প্রচ- ধৈর্য্য এবং ঐকান্তিক আগ্রহ তাদের সমাজে উঁচু পদে আসীন করেছে। তার বাবা তাতে সাপোর্ট দিতে গিয়ে কম কষ্ট করেননি। অন্যান্য ভাইয়েরা নানাভাবে সুযোগ পেয়ে বিদেশে স্থায়ী হয়। সরকারী চাকরিজীবী আহসান ভাই দেশে থাকলেও মা বাবার প্রতি তেমন দায়িত্ব পালন করেছেন বলে আমার জানা নেই।
ঃ কেন? তার কি কোনো সমস্যা ছিল?
ঃ প্রথম দিকে মা-বাবাকে কিছু টাকা-পয়সা দিতেন। ভাই-বোন ছোটগুলোর লেখা-পড়ার খরচের কিছু শেয়ার করতেন বলে শুনেছি। কিন্তু নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সাথে সাথে বিয়ের জন্য ও উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। তার চিন্তা ছিল দেরীতে বিয়ে করলে ছেলে-মেয়ে মানুষ করবেন কবে! তার পরিচিত-বন্ধুরাও তাকে এমন পরামর্শ দিত। অথচ, তার দুই বোন ততদিনে বিয়ের উপযুক্ত হয়েছিল। তাদের ব্যাপারে তাকে সেভাবে ভাবতে দেখিনি। বোনদের বেশ ভালো ভালো বিয়ের প্রস্তাব আসছিল। তাদের দায়িত্ব নিয়ে বিয়ে দেয়ার বদলে একদিন নিজের এক আত্মীয় নিয়ে গিয়ে তিনবার মেট্রিক ফেল করা এক মেয়েকে আংটি পড়িয়ে এলেন। বাবা-মা খবর পেয়ে অনেক কষ্ট পেলেন। শেষে চক্ষু লজ্জার খাতিরে বিয়েতে অভিভাবক হিসেবে উপস্থিত হলেন। তখনও তাদের বড় ছেলে বিয়ে করেনি। এরপর বিয়ে করে সে শ্বশুরবাড়ীতে গিয়ে থাকা শুরু করে। মা-বাবার মনটা ভেঙ্গে যায়। কারণ, তার ছোট ছেলে-মেয়েদের লেখা-পড়া এবং অন্যান্য খরচ দিন দিন বাড়ছিল। দেশের বাইরে যারা ছিল, তারা তখনও বাবা-মাকে সহযোগিতা করার মত অবস্থায় ছিল না। একজন উচ্চতর ডিগ্রি নিতে গিয়ে, নিজের খরচ মেটাতেই ব্যস্ত ছিল। অন্যজন তখনও স্টুডেন্ট।
ঃ বৌ কি তার মায়ের বাড়ীতেই থাকতো?
ঃ কিছুদিন পর আহসান ভাই বৌসহ একটা ভাড়া বাসায় উঠে যায়। কিন্তু ভাই-বোন কাউকে সাথে রাখেনি। শালা-শালীরা সে বাসায় অবাধে যখন তখন এসে থাকতো। শ্বশুর বাড়ীর সাথেই তার সব সম্পর্ক ছিল। বাবা-মায়ের আর তেমন খোঁজ নিতো না। ওদের আর আমাদের বাড়ী পাশাপাশি ছিল। তাই তার বাবা-মার চব্বিশ ঘণ্টার খবরই আমরা জানতাম। একদিন তো সে আমার সামনেই মুখ ফসকে বলে ফেলেছিল, ছেলে-মেয়ে উপযুক্ত হয়ে গেলে বাবা-মায়ের মরে যাওয়াই উচিত। তার ঐ কথা শুনে আমার বুকটা ধক্ করে উঠেছিল। বলেছিলাম, আপনি উপযুক্ত হলেও আপনার অন্যান্য ভাই-বোনদের তাদের মা-বাবাকে দরকার আছে। আপনার মন্তব্যটা কোনো উপযুক্ত ছেলের বলে মনে হলো না। উনি কি বলেছিলেন জানো? বলেছিলেন, তুমি একটু বেশী ইমোশনাল। আমার শ্বশুরের বেশ টাকা-পয়সা আছে। আমার মা-বাবার যে টানাটানির সংসার, তাদের পোশাক-আষাকের কোনো চাকচিক্য নেই। তাই তারা দূরে থাকাই আমার জন্য সম্মানের। আল্লাহর কি বিচার দেখো। তার নিজের ছেলের সাথে অর্থ-সম্পদ থাকার পরও বাস করাটা এখন নিজেই বেমানান ভাবতে বাধ্য হয়েছেন। তাই তার জায়গা এখন ......
ঃ থাক। ওভাবে বলতে নেই।
ঃ উনি নিজেই বলছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘আমি পাপী। পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না।’
ঃ বুঝতে পেরেছি। এ কারণেই তার মা মেয়ের কাছে থাকতেন। তার মা-বাবা কিন্তু আত্মীয় পরিজনের মধ্যে থেকেই আল্লাহর কাছে গেছেন। তার মত নিঃসঙ্গ থাকতে হয়নি।
ঃ আরো মজার ব্যাপার আছে। বিয়ের পর পরই কিন্তু আহসান ভাই বাবা হয়নি। আট বছর পর তাদের সন্তান হয়।
ঃ তার মানে আগে বিয়ে করার যুক্তি কাজে লাগেনি।
ঃ ঠিক বলেছো।
মিসেস সালেহা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
ঃ আমাদের মেয়েটা শ্বশুরবাড়ী চলে গেল। ছেলে বিয়ে করিয়ে বৌ আনলে। তাকে তো আমাদের চোখের দিকে চেয়ে উঁচু গলায় কথা বলতেও শুনিনি। হয়তো আমরা এখনও কারো উপর নির্ভরশীল নই দেখে ব্যবহারে সমীহ আছে। একথা নিন্দুকেরা বলতেই পারে। কিন্তু আমি আমার শ্বাশুড়ীর সেবা করেছি। মায়ের করেছি। মুরুব্বী আত্মীয়দের সম্মান করি। তাই আমার সন্তান যদি কোনো কারণে ব্যর্থ হয়, কেউ না কেউ আমার কাছে থেকে আমার নিঃসঙ্গতার সঙ্গী হবে আশা করি।
ঃ আরে, শুধু নিজের কথাই বলছো?
ঃ কারণ আমি জীবিত অবস্থায়, সবল এবং সচল থাকলে, আপনার কোনো আলাদা সঙ্গীর দরকার আছে মনে হয় না জনাব।
ঃ ধন্যবাদ মহারানী। অধমকে ছেড়ে যাবেন না শুনে কৃতজ্ঞ হলাম।
ঃ সত্যি বলতে কি, আমাদের কর্ম অনেক সময় ঠিকানা ঠিক করে দেয়। অবশ্য নিয়তির ব্যাপারটাও উপেক্ষা করা যায় না। অনেকে ভাল কাজ করেও অনেক সময় কষ্ট পায়। সবই উপরওয়ালার ইচ্ছা।
ঃ ঠিকই বলেছো। আছরের আজান হয়ে গেছে। চলো নামাজ পড়ি।
ঃ আমি অজু করে আসছি। তোমার অজু থাকলে পড়তে বসে যাও।
মিসেস সালেহা আর সাদিক হোসেনের, দৈনন্দিন রুটিনের মতই আরেকটি দিন অতিবাহিত হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন