শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

চির বিরহের অভিসারে

প্রকাশের সময় : ৪ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জুবাইদা গুলশান আরা
বাতাসটা একলা একলা গুমরে বেড়ায়। বাতাসে কারো নাম লেখা নেই। কিন্তু কি একটা রহস্যময় আবেগ আছে। ধূধূ করে যে বালির সমুদ্র। তা ছুঁয়ে যায়, সেখানে লাফিয়ে ওঠে, ঘূর্ণিপাক তৈরি করে। কেউ যদি এ সময়ে বালিবাড়ির তীর ঘেঁষে চলাচল করে, তবে মুখের উপরে বাড়ি দিয়ে, বালির ছররা ছড়িয়ে তাকে নাস্তানাবদু করে ছাড়ে। মনে হয়, বেকায়দায় ফেলে দিয়ে বাতাসটা আদতে মহারসিকতা করছে মানুষজনের সঙ্গে।
এই এলাকার লোকে এখন ফুটি, বাঙ্গি আর তরমুজের চাষ করে। বালিবাড়ির ধার ঘেঁষে এখন টমটম, গরুরগাড়ি, এমনকি ঠেলাগাড়িও যাতায়াত করে মাঝে-মধ্যে। গত চার দশকের বেশি সময় ধরে আস্তে আস্তে নদীর ¯্রােত মৃত প্রায়, নির্জীব হয়ে পড়েছে। চর পড়বে কি? সারা বছর ধরে পানি শুকোয়। এ নিয়ে কম যুদ্ধ হয়নি। পাশের দেশের সঙ্গে দেনদরবার, চিঠি চালাচালি, অনুরোধ ও লেখালেখি চলে আসছে। সেই যে বছর দেশটা স্বাধীন হলো, তারপর থেকেই। কিন্তু নদীটা খুন হওয়ার আগে থেকেই তো নদীর তীর ঘেঁষা গ্রামগুলোর বুকের ওপর হাত পড়েছিল মহাক্ষমতাধর এক রাষ্ট্রপতির। আনবিক চুল্লি বসানো হবে চররূপপুর ও তার আশপাশের বসত গ্রাম নিয়ে। এক বছরের মাথায় শূন্য হয়ে গেল রূপপুর গ্রাম। আশপাশের বসতভিটা, ফলবতী বিশাল বিশাল আম কাঁঠালের বাগান। নদীটা কিন্তু বড় ভালোবাসে তার ঢেউ তোলা পানির উপরে খেলে বেড়ানো দুরন্ত বালকদের হৈ-হুল্লা। গ্রাম্যবধূদের ডুব-সাঁতার আর নোঙর ফেলা নৌকার মাঝির গলার দরদভরা গানের উথাল-পাথাল করা সুর।
ঈশ্বরদী জংশন ছিল বড়সড় এক ইস্টিশন। এখন থেকে রেলের গাড়ি যায় বিশাল নদীটা পার হয়ে। বিশাল এক লোহার ড্রাগন যেন। নদীর বুকের ওপর দিয়ে যখন ট্রেনটা যায়, তখন তার জানালা দিয়ে আলো পড়ে নদীর ছেলেমানুষী ঢেউগুলো ছোট ছোট ঘূর্ণি তুলে নাচতে থাকে। এই নদীর রাক্ষুসে ক্ষুধা কত মানুষের প্রাণ সংহার করেছে তার হিসাব নেই। নদীকে শাসন করার জন্যই তো সাহেবরা এক সময় তৈরি করেছিল পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের এক আশ্চর্য হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। প্রকা- এক সরীসৃপের মতো লোহার কাঠামো এ-মাথা ও-মাথা জুড়ে বিদ্যুতের আলো ঝলকায়। বছর দু’বছর ধরে ইঞ্জিনিয়ার, এক্সপার্ট কয়েকশ মজুর, কুলি, ওয়ার্কিং লেবারের চেষ্টা ও শ্রমের ফলে গড়ে ওঠে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম এই ব্রিজ।
শাফিয়ার দাদা তখন এই ব্রিজের কাজকর্মের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। নদীর গর্জন শুনে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যেত। জোয়ারের ধাক্কায় কেমন ওঁ-ওঁ-ওঁ-ওঁ করে শব্দ হতো আর প্রবল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ত তীর ভূমিতে। কোলের শিশুরা দাদি-নানীর গলা জড়িয়ে ধরে বলত ও এরকম করে কেন? ওর ভয় করে না?
Ñনা ওর ভয়-ডর কিছুটি নেই দাদু। খ্যাপা নদী না?
Ñখ্যাপা নদী কেন দাদু? মানুষকে ও ভালোবাসে না?
Ñবাসে দাদু। ভালোবাসে। ও যা করে, কেবল মানুষকে ভয় দেখানোর জন্যে। আচ্ছা, ওসব কথা পড়ে হবে। এখন ঘুমাতো দাদুÑ
নাতি-পুতিদের কোলের কাছে শুইয়ে পিঠে হাত দিয়ে আদর করে ঘুম পাড়াতেন নানু-দাদুরা।
নদীটা সারা দেশের সামনে বুক ফুলিয়ে বয়ে যেত। প্রত্যেক বছর নৌকাডুবিতে মারা যেত গ্রামীণ মানুষ। বৃদ্ধ মাঝি দোয়া কালাম পড়ে পানিতে ফুঁ দিয়ে গলুইতে ছিটিয়ে দিয়ে হাল ধরে ধর বসত। বিড় বিড় করে পীর বদর বাবার নাম পড়ে বলত ঠিক মতন পৌঁছাতে পারলে খই-বাতাসা-সিন্নি দেব বাবা। আল্লা রাসূল নাম নিয়ে বাবার নাম পড়ে রওনা দিলাম। বাবা তুমি রক্ষা কর।
সময় আর নদীর কোনো কূলকিনারা নেই। যুগের পরে যুগ চলে যায়। একেক দশক জুড়ে চলতে চলতে নদীর তীরঘেঁষা প্রাচীন পরিবারগুলোও জীবনের দৌড়ে বড় হয়ে ওঠে। বদলে যায় জীবনের গতি, কৈশোরের নদী বার বার এক এক রাজার মরজির ঘা খেয়ে মোচড় দেয়।
ভীষণ কষ্টে বুকটা ব্যথা করে ওঠে শাফিয়ার। স্বামী শাহেদ সংবেদনশীল, ইঞ্জিনিয়ার। জীবনে সব রকম ঘোরপ্যাঁচ দেখে বড় হয়েছে। শাফিয়ার মতো স্বপ্নমাখা শৈশব আর দাদির হাতের মুড়িমাখা খাওয়ার স্মৃতি তাকে তাড়িত করল না। বিয়ের পরে বিদেশের রোমাঞ্চকর দিনযাপন শেষে দেশে ফিরে দুজনেই স্থির করে একবার ফিরে আসবে তাদের প্রিয় নদীর কাছে। এক সময়ে সে ছিল তাদের ইতিহাসের অংশ। লোকে আদর সোহাগ করে ডাকত রাক্ষুসী নামে। প্রতিবছর তাকে ঘিরে গড়ে উঠত কত কাহিনী, কল্পকথা। ঘূর্ণিপাকে হারিয়ে যেত কত নৌকা। শাফিয়ার সঙ্গে অবশ্য নদীটার একটা আলাদা যোগসূত্র ছিল। খুব ছোটবেলায় কলকাতায় থাকত পুরো পরিবার। গরমের ছুটিতে বার কয়েক বাড়িতে যেতেন ওবায়েদ আহমেদ। বাড়িভর্তি আত্মীয় কুটুম। শিশুদের কলকাকলিতে ভরপুর থাকত সারা বাড়ি, বিকালে উঠোনজুড়ে হৈ-হুল্লোড়, মস্ত বড় কড়াই ভরা ঘরে তৈরি দুধের ক্ষীর মুড়ি নাড়– খই খাওয়ার মহাভোজ চলত। জ্যোৎ¯œায় পিছলে যেত ঝকঝকে উঠান। প্রাচীন দাই বুড়ি ছেলেমেয়েদের শোনাত জিন-পরীর গল্প আর প্রাচীন কিস্সা কাহিনী। শাফিয়ার মনে আছে, মাঝে মাঝে শখ করে দাদুর বিছানায় ঘুমাতে যেত। মাঝ রাতে ছুটে আসত বাতাসের গর্জন। সেই সঙ্গে ওলট-পালট খাওয়া ঢেউয়ের খ্যাপা আওয়াজ ছুটে আসত নদীর প্রতিবেশী জনপদে। দুরু দুরু বুকে দাদুর গলা জড়িয়ে ধরে উঠে বসত। জানতে চাইত, নদীটা কি খ্যাপা নাকি? ওকি খুব গোঁয়ার দাদি?
Ñখ্যাপা, গোঁয়ার যা বলিস বুবু। ও কিন্তু আমাদের খুব ভালোবাসে। নে, ঘুম যা। কাল বিকালে নদীর ধার থেকে বেড়িয়ে আসিস। কেমন? ওকে ভালোবাসতে হয় বুবু। ওর সঙ্গেই তো আমাদের কত জন্ম কেটে গেল। মাঝে মাঝে একটু পাগলামি করে বটে, কিন্তু আদতে ও আমাদের ঘরের মেয়ে। ঘরের মেয়ে! ঘরের মেয়ে! একটা নদীর প্রতি এমন ভালোবাসা। কেমন করে যেন নদীটার সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গেল শাফিয়ার। এক বিকালে নদীর ওপর নৗকা নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিল কয় চাচাতো ভাইবোন। তখন সদ্য কলেজে পড়ছিল শাফিয়া। নৌকার গলুইতে বসে পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর ¯্রােতে হাত ভাসিয়ে দিয়ে ¯্রােতের সঙ্গে খেলা করেছিল সে। অনেকক্ষণ। তখন যেন নদী তার সঙ্গে অনেক কথা বলেছিল। মনে হয়েছিল, নদীটা তার ছেলেবেলার খেলার সাথী। দুই হাত অঞ্জলি করে নদীর পানি তুলে এনেছিল শাফিয়া। ছেড়ে দিয়েছিল বৃষ্টির ধারার মতো। মনে মনে বলেছিল আমি তোমার কাছে আবার আসব। নদীর কলকল আওয়াজ তুলে সে বলেছিল আমি তোমাকে ডাকব।
সেদিন যেন নতুন করে গ্রামীণ জনপদ গ্রামীণ চাঁপা ফুলের গন্ধ, আর কলস্বরে বয়ে যাওয়া নদীকে বড় আপন বলে মনে হয়েছিল তার।
মাঝখানে চলে গেছে দীর্ঘ সময়ের পাড়ি। চলে গেছে জীবনের অস্থির নির্মম দিন যাপনের চলমানতা। একটা ভরা ভর্তি গ্রাম হয়ে গেছে শূন্য উদ্ধাস্তু। দাদাজান, দাদিজান, গর্বিত সৈয়দ বাড়ির সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে। চর রূপপুর কথিত আনবিক চুল্লির আয়োজন মাথায় নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে, তিরিশ বছর ধরে। এলাকায় দু-একটি গুদাম দু-একটি থাকার কাঠের ঘর আর বাংলো মতো কিছু ঘর আছে এখানকার কিছু কর্মচারীর জন্য। তাদেরই একজনে রকীব আহমেদ এলাকায় ব্যবসা সূত্রে থাকে। তার সঙ্গে পুরনো পরিচয় বেরিয়ে পড়ায় সে প্রথমেই অবাক হলো। তারপর আন্তরিকভাবে নিজের কোঠাবাড়ির একটা ঘর ছেড়ে দিল। দু-চার দিনের জন্য। শাহেদ তাকে বলল, আসলে এ গ্রামটায় ছিল আমার ওয়াইফের দাদাবাড়ি। সৈয়দ বাড়ি একসময় খুব নাম করা ছিল।
হ্যাঁ, হ্যাঁ শুনেছি বস, সব শুনেছি। তো, সারা দুনিয়া ঘুরে শেষে এখানে সেই জন্যই আসছেন, তাই না স্যার?
হ্যাঁ, খানিকটা। বলা যায় খানিকটা সেন্টিমেন্টাল জার্নি।
তো, সেই পুরনো স্মৃতির জগতে ফিরে আমার ব্যাকুলতা নিয়েই শাহেদ শাফিয়াকে নিয়ে এসেছে। এক উচ্চাকাক্সক্ষী রাষ্ট্রনায়কের কল্পনায় যোগান দেয়ার জন্য বেছে নেওয়া একটি জনপদ ছিল শ্যামল শান্তির, চোখ জুড়ানো। রাষ্ট্রনায়ক ফিল্ড মার্শাল বললেন, এখানে আণবিক রিঅ্যাক্টর গড়ে তুললে সমগ্র উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ, কল-কারখানায় বিশাল কর্মযজ্ঞ গড়ে উঠবে। ব্যস। ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে সরকারি হুকুম দখলের প্রক্রিয়ার ফলাফলে শূন্য হয়ে গেল সব। পরে রইল নীরব রূপপুর গ্রাম।
পৃথিবীতে বুঝি এমনই হয়। সময়ের ধাক্কায় কোথায় হারালো সেই ক্ষমতার মসনদ? রক্তের প্লাবনে ভেসে এলো স্বাধীনতা। নদীটার পায়ে কেমন করে যে শিকল পরলো, তা চোখ মেলে দেখেছে নদীর ¯্রােতভাসা গ্রামীণ মানুষেরা। ঘরের মেয়ে যেন কঠিন শাসনে পরের ঘরে বন্দিনী। বছরের পর বছর ধর গড়ে উঠল খাঁ খাঁ করা ধূধূ বালিবাড়ি, নদীর মাঝখান দিয়ে মূর্ছাহত দুর্বল ¯্রােত বেয়ে নৌকা যায়। গুন গুন করে গান গায় মাঝিরা, মনে হয় গান নয় শোকগাথা গাইছে।
এক বিকালে প্রাচীন পারিবারিক কবরস্থানে জিয়ারত করতে গেল শাহেদ আর শাফিয়া। বড় রাস্তার অন্য প্রান্তে এখানকার যারা কোনোমতে বাস করছে, তারা মোটামুটি সাফ সুতরো রেখেছে জায়গাটা। আগরবাতি জ্বেলে পারিবারিক পূর্বপুরুষদের স্মরণ করল দুজনে। বুকের গভীরে বেদনার্ত স্মৃতির আলোড়নে চোখ ভিজে ওঠে। মনে যেসব স্মৃতি ভেসে ওঠে, সব যেন পূর্বভঙ্গের কথা।
ফিরে এসে গুম হয়ে বসে থাকে শাফিয়া। একবার জিজ্ঞেস করেÑ বলতে পার, মানুষ কোন অধিকারে অন্যের পিতৃভূমি কেড়ে নেয়? কোন স্পর্ধায় অন্যের নদী কেড়ে নেয়? কোনো বিচারও হয় না, কোনো শাস্তিও হয় না। কেন? বলতে পার, কোন ত্যাগের বিনিময়ে নদীটা ফিরে পাওয়া যাবে?
শাহেদ এ কথার উত্তর দেয় না। সে জানে, শাফিয়া এক গভীর যন্ত্রণার মধ্যে বাস করছে। উত্তর খুঁজছে, গন্তব্য খুঁজছে।
ওদিকে তাদের ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে আসছে। তাদের দুটি ছেলে। মামাদের সঙ্গে রেখে এসেছে। শাহেদ রোজ রাতে তাদের সঙ্গে কথা বলছে। মায়ের মনটা ভালো নেই, পরে কথা বলিস। এই তো দুই দিন পরেই ফিরব, কেমন?
আসলে দুই দিন ধরে শাফিয়া যেন কেমন নিজের মধ্যে ডুবে আছে। শাহেদ ওকে জোর করে কিছু বোঝাতে চায়নি। সময় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। মানুষ তো আশা নিয়েই বেঁচে থাকে।
সকাল থেকে আকাশটা মেঘলা ছিল। সন্ধ্যা বেলায় মেঘ কেটে চাঁদ বেরিয়ে এলো। কি জ্যোৎ¯œা! কি জ্যোৎ¯œা! শাফিয়াকে যেন নেশায় পেয়েছে। ঘর-দরজা সব খুলে দিয়ে সে যেন চাঁদের মদিরা পান করছে। চুল এলোমেলো খোলা। একটা বেতের চেয়ার টেনে নিয়ে বারান্দায় বসে থাকল। নদীর দিকে চেয়ে রইল এক দৃষ্টিতে। বাতাসে নদীর বুক থেকে বালি উড়ে আসছে, তাতে তার ভ্রƒক্ষেপ নেই। ওর জন্য অপেক্ষা করে করে শাহেদ একসময়ে খেয়ে নিল। অবসাদে ক্লান্তিতে ঘুমিয়েও গেল এক সময়ে।
কি একটা দুঃস্বপ্ন দেখে চমকে জেগে উঠল শাহেদ। ধড়ফড় করে উঠে দেখে, দরোজা হা হা করছে খোলা। কিন্তু শাফিয়া কোথায়? বুকটা কেঁপে উঠল শাহেদের। পাশের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিল সে। রকীব, একটু বাইরে আসুন। ভীত সন্ত্রস্ত গলায় বলল শাহেদ।
শাফিয়ার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। যত নদীর দিকে যাচ্ছে ততই বালিতে পা আটকে যাচ্ছে। এক সময়ে পায়ের স্যান্ডেলটা ছুঁড়ে ফেলে দিল সে। আকাশে কুয়াশার চাদরের মতো বৃষ্টি বৃষ্টি, আর জ্যোৎ¯œা মাতাল আমন্ত্রণ।
Ñআমি আসছি, নদী, আমি আসছি! তুমি ডাক দিয়েছ, আমি আসছি... আসছি... কোথায় তুমি নদী?
জ্যোৎ¯œায় উড়ছে চুল, পা ক্রমশই গেড়ে যাচ্ছে বালির গভীরে। দুবার হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল শাফিয়া। উঠে দাঁড়াল। আবার চলল... একপশলা বৃষ্টি এসে তাকে আরও ভারী করে তুলল...
রকীব এবং তার লোকেরা বড় বড় টর্চ হাতে নদীর বালির মধ্যে ছুটল। চিৎকার করে বলল, স্যার আর যেতে দেবেন না, ওদিকে চোরাবালি আছে। বাতাস বাড়ি খাচ্ছে চোখে-মুখে। আতঙ্ক এসে রুখে দিতে চায়, তবু এগিয়ে গেল শাহেদ। দুই হাত বাড়িয়ে শাফিয়াকে ধাক্কা দিল। জড়িয়ে ধরল বুকের মধ্যে। পেছনে দাঁড়িয়ে রুদ্ধস্বরে রকীব বলল, আমরা ধরছি স্যার। সাবধানে... এখানে চোরাবালি আছে।
বরফের মতো ঠা-া বালিতে হাঁটু পর্যন্ত দেবে যাওয়ার ফলে জমে যাওয়ার অবস্থা শাফিয়ার। বাকি রাতটা পানি গরম করে হাত-পা ডুবিয়ে সেঁক দিয়ে সুস্থ করে তোলা হলো। শেষ রাতে কেঁপে জ্বর এলো তার। শাহেদেরও সারা শরীর ব্যথায় ফুঁকড়ে আসছে। কিন্তু শাফিয়ার জন্য চিন্তাই বেশি। আধো চেতন-অচেতন অবস্থায় বার বার উচ্চারণ করছেÑ ‘আমাকে নিয়ে যেও না, ...না... না, আমি ফিরে যাব না। আমার একার জীবনের দামে নদীতে যদি জোয়ার আসে, তবে কিসের ক্ষতি হবে?... তুমি জান না, নদী আমাকে ডেকেছে...
আমাকে যেতেই হবে। এক সময়ে হয়রান হয়ে থেমে গেছে।
নিজের মনের মধ্যে বারংবার প্রতিজ্ঞা করেছে শাহেদ। আর কোনোদিন এই উপসী, সর্বগ্রাসী নদীর মায়াবিনী রূপে ভুলে এ তল্লাটে আসবে না। সারা রাত জ্যোৎ¯œা আর বৃষ্টি, চাঁদ আর মেঘের খেলা দেখেছে, আর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছে। নদীর বুক ছুঁয়ে উদ্দাম বাতাস ভেজা বালির গন্ধ নিয়ে ছুটে আসছে। কিন্তু শাহেদ দরজা বন্ধ করে বাইরে বসে থাকে।
সকাল বেলায় রকীব আসে। সঙ্গের লোকটির হাতে চায়ের ট্রে আর রুটি। একটু পরে শাফিয়া উঠে আসে, ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে বলে, চা এত সকালে?
চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে শাফিয়া বলে, খুব ঘুমিয়েছি সারা রাত। চলো কাল ঢাকায় ফিরে যাই।
টুটুল পুতুলকে ফোন কর না! বড্ড মন কেমন করছে ওদের জন্য।
বেশ তো ফোন করছি। বলল শাহেদ।
রকীব মৃদু হেসে উঠে দাঁড়াল। বলল দেখছেন স্যার, কেমন সহজে ম্যাডাম সব ভুলে গেছেন। তবে উনারে একটু ডাক্তার দেখাবেন বস। বেয়াদবি নেবেন না।
Ñনা না, আপনি ঠিকই বলেছেন। আপনার উপকার আমি কোনো দিন ভুলব না।
বেলা বাড়ে। শাফিয়া গুন গুন করে কোনো পুরনো গানের কলি গায়।
নদীটা শান্ত চোখে বিদায়ী বন্ধুদের তাকিয়ে দেখে। শাহেদ ভাবে, ও ঠিক জানে, কখন ফিরিয়ে দিতে হয়। বুকের ভেতর গোমরায় কিন্তু ও আঘাত করে না। ভালোবেসে কেউ যদি মালা দেয়, ও তাকে অবহেলা করে না, ¯্রােতের বুকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। শুধু দীর্ঘশ্বাস ওঠে হারানো মত্ত ঘূর্নিপাকের জন্য। উথাল-পাথাল ঢেউয়ের জন্য। বুকের মধ্যে আগলে রেখে ছেড়ে দেওয়া সে তো শুধু সব হারানো কাঙাল হয়ে যাওয়া পদ্মা নদীকেই মানায়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন