বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

আল-কুরআনে ভাষা প্রসঙ্গ

মুহাম্মদ আতিকুর রহমান | প্রকাশের সময় : ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০২ এএম

“দয়াময় আল্লাহ, শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন। সৃষ্টি করেছেন মানুষ। তাকে শিক্ষা দিয়েছেন ভাষা” (আল-কুরআন, ৫৫: ১-৪)। মনের ভাব প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হলো ভাষা। বর্তমান পৃথিবীতে ছয় হাজারের বেশি ভাষা রয়েছে। এ ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে অন্যান্য জাতির উপর প্রাধান্য বিস্তার করে আসছে। মানুষের ন্যায় অন্যান্য প্রাণীরও নির্দিষ্ট ভাষা রয়েছে এবং তাদের এ ভাষা বোঝার জন্য বিজ্ঞানীগণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আল-কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে ‘ভাষা’ ও ভাষার ব্যবহার গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে। আসমান-যমীন, পাহাড়-পবর্ত, সাগার-মহাসাগর, রাত-দিন, আলো-বাতাস ও বিভিন্ন রঙের মত বৈচিত্রময় ভাষাও আল্লাহ তাআলার অন্যতম সৃষ্টি ও নিদর্শন। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনে এরশাদ হচ্ছে, “তার আরও এক নিদর্শন হচ্ছে নভোমন্ডল ও ভ‚মন্ডল সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য নির্দশনাবলী রয়েছে” (আল-কুরআন, ৩০: ২২)।

সৃষ্টির সূচনাতেই আল্লাহ তাআলা ভাষা সৃষ্টি করেন। তিনি আদি পিতা হযরত আদম আ. কে সৃষ্টি করার পর সর্বপ্রথম তাকে ভাষাসহ বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞান শিক্ষাদেন এবং ফিরিশতা ও জ¦ীন জাতিকে তাকে সিজদা করার নির্দেশ দানের মাধ্যমে সকল সৃষ্টির উপর মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্ব দান করেন। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “আর আল্লাহ তাআলা শিখালেন আদমকে সমস্ত বস্তু-সামগ্রীর নাম। তারপর সে সমস্ত বস্তু-সামগ্রীকে ফেরেশেতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। অতঃপর বললেন, আমাকে এগুলোর নাম বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক। তিনি বলেন, হে আদম, ফেরেশতাদেরকে বলে দাও এসবের নাম, তারপর যখন তিনি বলে দিলেন সে সবের নাম, তখন তিনি বললেন, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, আমি আসমান ও যমীনের যাবতীয় গোপন বিষয় সম্পর্কে খুব ভাল করেই অবগত রয়েছি? এবং সে সব বিষয়ও জানি যা তোমরা প্রকাশ কর, আর যা তোমরা গোপন কর! এবং যখন আমি আদম আ. কে সেজদা করার জন্য ফেরেশতাদেরকে নির্দেশ দিলাম, তখনই ইবলীস ব্যতীত সবাই সিজদা করলো। সে (নির্দেশ) পালন করতে অস্বীকার করল এবং অংহকার প্রদর্শন করল। ফলে সে কাফেরদের অন্তভর্‚ক্ত হয়ে গেল।(আল-কুরআন, ২:৩১-৩৪)

আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী ও রাসূল এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যাদের দায়িত্ব ছিল আল্লাহর একত্ববাদের প্রচার ও অন্যায়-অত্যাচারসহ সকল প্রকার যুলুমের মূলোৎপাটোন করা এবং সমাজের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সকলের অধিকার নিশ্চিত করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। যারা তাদের স্বজাতির কাছে তাদের ভাষায় আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-বিধান পৌছে দেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,“আমি সব রাসূলকেই তাঁেদর স্বজাতির ভাষাভাষীর নিকট প্রেরণ করেছি, যাতে তাদেরকে (আমার বাণী) স্পষ্টভাবে বোঝাতে পারে, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎ পথে পরিচালিত করেন এবং তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় (আল-কুরআন, ১৪:৪)।” আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক জাতির স্বীয় মাতৃভাষাকে যথাযথ মর্যাদা প্রদান করে তাদের ভাষায় আসমানি কিতাবগুলো নাযিল করেছেন। প্রধান প্রধান চারটি আসমানি কিতাবের মধ্যে হযরত মূসা আ. এর প্রতি ‘তাওরাত’ হিব্রু ভাষায়, হযরত ঈসা আ. এর প্রতি ‘ঈঞ্জিল’ সুরিয়ানি ভাষায়, হযরত দাউদ আ. এর ‘যাবুর’ ইউনানি ভাষায় এবং শেষ নাবী হযরত মুহাম্মদ সা. এর প্রতি ‘কুরআন’ আরবী ভাষায় নাজিল করা হয়। আল্লাহ তাআলা আল-কুরআনের পরিচয় ও এর ভাষা সম্পর্কে ইরশাদ করেন, “এই কোরআন তো বিশ্বজাহানের পালনকর্তার নিকট থেকে অবতীর্ণ, বিশ্বস্ত ফেরেশতা একে নিয়ে অবতরণ করেছে আপনার অন্তরে, যাতে আপনি ভীতি প্রদর্শনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হন, সুস্পষ্ট আরবী ভাষায়”(আল-কুরআন, ২৬:১৯২-১৯৫)। শেষ নবী ও রাসূল মুহাম্মদ সা. এর মাতৃভাষা আরবীতেই আল-কুরআন নাযিল করা হয়েছে, যাতে তিনি সহজেই আল-কোরআনের মর্মবাণী পৌছাতে পারেন। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “সুতরাং আমরা তো এটিকে তোমার মাতৃভাষায় সহজবোধ্য করে দিয়েছি যেন এর দ্বারা তুমি ধর্মপরায়ণদের সুসংবাদ দিতে পার আর এর দ্বারা সাবধান করে দিতে পার বিতর্কপ্রিয় সম্প্রদায়কে (আল-কুরআন, ১৯: ৯৭)। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনের অন্যস্থানে ইরশাদ করা হয়েছে,“ সুতরাং আমরা নিশ্চয় এটিকে (আল-কুরআনকে) তোমার(মুহাম্মদ সা.) ভাষায় সহজ করে দিয়েছি যেন তারা মনোনিবেশ করতে পারে”(আল-কুরআন, ৪৪:৫৮)।

আল্লাহর পথে আহবানের ক্ষেত্রে ‘ভাষার ব্যবহার’ আল-কুরআনে গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে। হযরত মূসা আ.অবাধ্য ফিরআউনকে একত্ববাদের দাওয়াত দেওয়ার জন্য আল্লাহর নিকট প্রাঞ্জলভাষী তার ভাই হারূন আ. কে সাহায্যকারী হিসেবে প্রার্থনা করেন। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, “(হযরত মূসা আ. বলেন, হে প্রভ‚) আমার ভ্রাতা হারুন আমার চেয়ে সুন্দর ও স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারে। সুতরাং তাকে আমার সঙ্গে সাহায্যকারী হিসেবে প্রেরণ করুন(আল-কুরআন, ২৮:৩৪)।
পিপীলিকা থেকে হাতি, নুড়ি পাথর থেকে বিশাল পাহাড়, ঘাস থেকে বড় বড় বৃক্ষ সকলেরই রয়েছে নিজস্ব ভাষা। মানবজাতির ন্যায় তারাও আল্লাহর পরিবারের সদস্য এবং প্রত্যেকটি সৃষ্টিই নির্দিষ্ট ভাষার মাধ্যমে আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করে থাকে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন: “সপ্ত আকাশ ও পৃথিবী এবং এগুলোর মধ্যে যা কিছু আছে সমস্ত কিছুই তাঁরই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। এবং এমন কিছু নেই যা তার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না। কিন্তু তাদের পবিত্রতা, মহিমা ঘোষণা তোমরা অনুধাবন করতে পার না। নিশ্চয় তিনি সহনশীল, ক্ষমাপরায়ণ” (আল-কুরআন, ১৭:৪৪)

আল-কুরআনে বিভিন্ন পাখি ও তাদের নিজস্ব ভাষার মাধ্যমে আল্লাহর মহত্ত¡ ঘোষণা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “তুমি কি দেখনা যে, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যারা আছে, তারা এবং উড়ন্ত পক্ষীকুল তাদের পাখা বিস্তর করতঃ আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষনা করে? প্রত্যেকেই তার যোগ্য এবাদত এবং পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা ও পদ্ধতি জানে” (আল-কুরআন, ২৪:৪১)।

আল্লাহ তাআলা হযরত সুলায়মান আ. কে পাখির ভাষা শিক্ষা দানের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছিলেন। আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “(আল্লাহ তাআলা বলেন) আমি অবশ্যই দাউদ ও সলায়মানকে জ্ঞান দান করেছিলাম। তাঁরা বলে ছিল, আল্লাহর প্রশংসা, যিনি আমাদেরকে তাঁর অনেক মুমিন বান্দার উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। সুলাইমান দাঊদের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। বলেছিলেন, হে লোকসকল, আমাকে উড়ন্ত পক্ষীকুলের ভাষা শিক্ষা দেয়া হয়েছে এবং আমাকে সবকিছু দেয়া হয়েছে। নিশ্চয় এটা সুস্পষ্ট শ্রেষ্ঠত্ব”(আল-কুরআন, ২৭:১৫-১৬)। আল-কুরআনে পিপীলিকার নিজস্ব ভাষা ব্যাপারে উল্লেখ করা হয়েছে এবং হযরত সুলায়মান আঃ পিপীলিকার ভাষাও বুঝতেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন: “যখন তারা পিপীলিকা অধ্যূষিত উপত্যকায় পৌছাল, তখন এক পিপীলিকা বলল হে পিপীলিকা দল, তোমরা তোমাদের গৃহে প্রবেশ কর। অন্যথায় সোলয়মান ও তার বাহিনী অজ্ঞতাসরে তোমাদের পিষ্ট করে ফেলবে। তার কথা শুনে সুলায়মান মুচকি হাসলেন এবং বললেন হে আমার পালনকর্তা, তুমি আমাকে সামর্থ্য দাও যাতে আমি তোমার সেই নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি, যা তুমি আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে দান করেছ এবং যাতে আমি তোমার পছন্দনীয় সৎকর্ম করতে পারি এবং আমাকে নিজ অনুগ্রহে তোমার সৎকর্মপরায়ন বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত কর” (আল-কুরআন, ২৭:১৮-১৯)।

মানবজাতির জন্য আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের জন্য ভাষা ও মাতৃভাষার প্রয়োজনীয়তা আল-কুরআনের বিভিন্ন স্থানে গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে। বাংলা ভাষাভাষী হিসেবে আমাদেরকে মহান সৃষ্টিকর্তার মহান বাণী জানার জন্য আল-কুরআনের মহান বাণী মাতৃভাষায় প্রচার ও প্রসার ঘটাতে হবে। তাই আসুন, মাতৃভাষা বাংলায় আল-কুরআনের বাণী অনুধাবন করে তা বাস্তবায়ন করি এবং দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা অর্জন করি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Tanjina_Islam ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৮:০৭ পিএম says : 0
ভাষার কথা কুরআানের কোন সূরায় এসেছে?
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন