দুই
মানবাধিকার ও তার পরিধি : মানবাধিকার বলতে মানুষের সেই সব স্বার্থকে বুঝায় যা অধিকারের নৈতিক বা আইনগত নিয়মনীতি দ্বারা সংরক্ষিত হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, রাষ্ট্র কর্তৃক এর নাগরিকদের জন্য স্বীকৃত ও প্রদত্ত কতিপয় সুযোগ-সুবিধাকে মানবাধিকার বলে যেগুলো ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অপরিহার্য। “রেবা মন্ডল ও মো. শাহজাহান মন্ডল, প্রাগুক্ত, পৃ. ১”। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব হওয়ার কারণে তার পক্ষে বিচ্ছিন্ন জীবন-যাপন সম্ভব নয়। তাই সামাজিক জীবনের উন্নতি ও অগ্রগতির ও বলিষ্ঠতার জন্য সমাজের এক সদস্যের প্রতি অন্য সদস্যের অনেকগুলো দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকে। এই দায়িত্বই হচ্ছে মূলত অধিকার। সুতরাং মানুষের প্রতি মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহই হল মানবাধিকার। জাতিসংঘ প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী মানবাধিকার হল মানুষের এমন কতগুলো জন্মগত অধিকার অনস্বীকার্য চাহিদা, যা মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তি ও বিবেককে পরিপূর্ণরূপে বিকশিত করার জন্য অতীব প্রয়োজন এবং সেগুলো মানুষের আত্মিক চাহিদা মেটায়। “জাতিসংঘ মানবধাকিার পঞ্চাশটি প্রশ্ন ও উত্তর ঢাকা : জাতিসংঘ তথ্য কেন্দ্র, পৃ. ০৫”। মূলত মানব পরিবারের সকল সদস্যের জন্য সর্বজনীন, সহজাত, হস্তান্তরযোগ্য ও অলংঘনীয় অধিকার হল মানবাধিকার। এসব অধিকার তিনভাগে বিভক্ত-
এক : অর্থনৈতিক অধিকার, যথা- ভাত, কাপড়, বাসস্থান, চিকিৎসা, জীবিকা অর্জন, সম্পত্তির মালিকানা লাভ ও সংরক্ষণ, জীবন ধারণের জন্য ন্যূনতম অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা, যোগ্যতানুযায়ী কর্মসংস্থান এবং ধনীদের সম্পদে গরীব অনাথ ও নিরন্ন মানুষের অধিকার প্রভৃতি।
দুই : সামাজিক অধিকার, যথা- জাতি-ধর্ম-গোত্র নির্বিশেষে সমঅধিকার, মতামত প্রকাশ, জান-মালের নিরাপত্তা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, রাজনৈতিক তথা-নাগরিক অধিকার, সভা-সমিতি, সংগঠন ও জনমত গঠনের অধিকার, অবাধে ধর্ম-কর্ম সম্পাদনের অধিকার, আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার লাভের অধিকার এবং বিবাহ-তালাক ইত্যাদির অধিকার।
তিন : নৈতিক অধিকার, যথা-অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করা, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করা, শ্লীলতার প্রসার ও অশ্লীলতা প্রতিরোধ, সৎকর্মের বিকাশ ও অসৎকর্মের বিনাশ, পিতা-মাতা ও বয়ো:জ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, ছোটদের প্রতি ¯েœহ মমতা প্রদর্শন, সমাজের দরিদ্র, অসহায়, বিধবা, ইয়াতীম, অধিকার বঞ্চিত- মজলুম মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন, অতিথি- মুসাফিরদের আদর-আপ্যায়ন এবং সকল মানুষের প্রতি সৌজন্য আচরণ ইত্যাদি। “রহমান, মুহাম্মদ মতিউর, ইসলামে মৌলিক মানবাধিকার, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩”। বর্তমান বিশ্বে মানবাধিকার বলতে সেই সব অধিকারকে বুঝায় যা ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃকহ গৃহিত মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণায় (The Universal Declaration of Human Rights) উল্লেখ করা হয়েছে। ৩০টি অনুচ্ছেদ সম্বলিত এই ঘোষণায় ২৫টি মানবাধিকার স্বীকৃত হয়েছে, যার মধ্যে ১৯টি নাগরিক ও রাজনৈতিক এবং ৬টি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক। “আব্দুল কাদের, ড. আ.ক.ম. মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী সা. প্রেক্ষিত বর্তমান বিশ্ব, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৯”।
বিশ্বপ্রেক্ষিত ও মানবাধিকার : ১৮শ শতকের ফরাসী দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাঁ রুশো বলেন,Man is born free, but everwhere he is in chain,, অর্থাৎ, মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন, কিন্তু সর্বত্রই সে শৃংখলাবদ্ধ। “প্রাগুক্ত”। যুগে যুগে দূর্বল শ্রেণীর মানুষের ওপর সবলদের নিয়ন্ত্রণ এবং মুষ্টিমেয় শাসক শ্রেণী কর্তৃক বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর উপর শাসন-শোষণের বন্ধনকে সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে বহুবিধ নিয়ম-নীতি আরোপের কারণে সাধারণ মানুষ তাদের প্রকৃতি ও স্বভাবের সাথে জড়িত অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছিল। ফলে মানবিক বিকাশের স্বাভাবিক ধারা রুদ্ধ হয়ে পড়েন। তাই মানুষকে সংগ্রাম করতে হয় শৃংখল মুক্তি তথা মৌলিক অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য।
“রাষ্ট্রের উৎপত্তির পূর্বেই কি অধিকারের জন্ম হয়েছে না কি রাষ্ট্রই অধিকার সৃষ্টি করেছে” রাজনীতি বিজ্ঞানের এটি বিতর্কিত বিষয়। John Licke এর মতে, মানুষ স্বভাবতই কিছু অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার অধিকারসহ স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকার মানুষের অস্তিত্বের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। “প্রাগুক্ত”। আধুনিক রাষ্ট্রের উদ্ভবের আগে প্রাক-রাষ্ট্রীয় যুগেও মানুষ কিছু প্রাকৃতিক অধিকার (Natural Rights) ভোগ করতো। পরবর্তীকালে রাষ্ট্র কেবল সেই সব অধিকারকে অনুমোদন, সংরক্ষণ ও ভোগের নিশ্চিয়তা দিয়েছে মাত্র। পক্ষান্তরে অনেক রাষ্টবিজ্ঞানী প্রাকৃতিক অধিকার ভোগ করার এই ধারণার প্রতি তেমন গুরুত্ব দেন না। তাঁদের মতে, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বে মানুষের পক্ষে কোন অধিকার ভোগ করা সম্ভব নয়। কেননা, রাষ্ট্র অধিকার ভোগ করার নিশ্চয়তা না দিলে সে অধিকার অর্থহীন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন