শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ট্রাম্পের ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি কী প্রত্যাখ্যাত: অতঃপর

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০২ এএম

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ প্রত্যাখ্যাত হয়েছে বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই। মাত্র কয়েকটি দেশ এটাকে সমর্থন করেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত ২৮ জানুয়ারি ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ ঘোষণা করেন। তার এই পরিকল্পনায় ‘রাজধানী হিসাবে অবিভক্ত জেরুজালেম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ইসরাইলের প্রতি আহবান, পূর্ব জেরুজালেমের উপকণ্ঠে ইসরাইল নির্মিত বিরাট এক দেয়ালের বাইরে ফিলিস্তিনি রাজধানী প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাব, পশ্চিম তীরে ইসরাইলের বসতি স্থাপনের অধিকাংশকেই ইসরাইলের ভূখন্ড হিসাবে স্বীকৃতি, কোনে ফিলিস্তিনি শরণার্থী তাদের ভিটেমাটিতে ফিরতে পারবেন না এবং ফিলিস্তিনিদের অবশ্যই অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে’ ইত্যাদি রয়েছে। এই ঘোষণাকালে তার পাশে উপস্থিত ছিলেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। ঘোষণার পর ট্রাম্প বলেছেন, ‘এই পরিকল্পনায় দুই পক্ষ যাতে লাভবান হয় সেই ধরনের সুযোগ প্রদান করা হয়েছে’। নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘শতাব্দীসেরা এই চুক্তিটি হচ্ছে শতাব্দীর একমাত্র সুযোগ। ইসরাইল এই সুযোগ কখনোই হাতছাড়া করবে না। ইসরাইলের ১৯৪৮ সালের স্বাধীনতা দিবসের মতোই এই দিনটাকে স্মরণে রাখা হবে’। নেতানিয়াহুর এ বক্তব্যের পর ইসরাইল আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণ ও জেরুজালেম শহরের পুরনো অংশে প্রবেশ ও বের হওয়া বন্ধ, সেনারা ফিলিস্তিনে আক্রমণ চালিয়ে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের হত্যা, বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু এবং ফিলিস্তিনের পশ্চিমতীরে একতরফাভাবে নিজেদের সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করেছে। ট্রাম্পের উপদেষ্টা কুশনার বলেছেন, ফিলিস্তিনিরা ‘ডিল অব দ্যা সেঞ্চুরি’ মেনে না নিলে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়া সম্ভব হবে না’। ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়েছে যে মুষ্টিমেয় দেশ তাদের মধ্যে ভারত অন্যতম। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী গত ২৯ জানুয়ারি এক বার্তায় ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি মেনে নেওয়ার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর প্রতি আহবান জানিয়েছেন। অন্যদিকে, জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘এ অঞ্চলে শুধুমাত্র উভয় পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য দুই রাষ্ট্র সমাধানই কাজ করবে’। ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে জোর করে একপেশে পরিকল্পনা চাপিয়ে দিয়ে কোনো লাভ হবে না। ফিলিস্তিনিরা বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘে আলোচনা করার যে আহবান জানিয়েছে তার প্রতি প্যারিসের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে’। ট্রাম্পের এই পরিকল্পনার সরাসরি বিরোধিতা করেছে ফিলিস্তিনি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ওআইসি, আরব লীগ, ইরান, তুরস্ক, রাশিয়া, জাতিসংঘ, জর্ডান, মালয়েশিয়া, কুয়েত, আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের হুতি। ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের সর্বত্রই ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট আব্বাস বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনি অধিকার ও আশা বিক্রির জন্য নয়। এই পরিকল্পনা ইতিহাসের ডাস্টবিনে পড়ে থাকবে’। উপরন্তু তিনি গত ১ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছেন। সর্বোপরি তিনি আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে জাতিসংঘ সফর করবেন এবং তাতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন মধ্যপ্রাচ্য পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদের সামনে তুলে ধরবেন। ট্রাম্পের এই ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করার জন্য ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ ও হামাসের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে। হামাসের প্রধান হানিয়া মুসলিম ও আরব দেশগুলোর শীর্ষ নেতাদের কাছে পাঠানো বার্তায় বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনি জাতি ট্রাম্পের পরিকল্পনার সহযোগীদের কখনোই ক্ষমা করবে না’। কথিত ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’কে সমর্থন দেয়া হারাম বলে ফতোয়া দিয়েছে ফিলিস্তিনের সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদ। জাতিসংঘ মহাসচিব গত ৪ ফেব্রুয়ারি বলেছেন, ‘দুই রাষ্ট্র তত্তে¡র’ ভিত্তিতেই ফিলিস্তিন-ইসরাইল বিরোধ মেটাতে হবে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব অনুসরণ করে যাবে জাতিসংঘ। জাতিসংঘে ১৯৬৭ সালের সীমান্ত বজায় রেখে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। সে প্রস্তাব এখনও বহাল আছে’। যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে ইইউ’র পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান বোরেল এক বিবৃতিতে বলেছেন, ন্যায়বিচার ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য উভয় পক্ষের মধ্যে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে সীমান্ত পরিস্থিতি, জেরুজালেমের অবস্থা এবং শরণার্থী সম্পর্কিত বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য। এছাড়া, গত ১১ ফেব্রয়ারি ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ট্রাম্পের এই পরিকল্পনার ব্যাপারে আলোচনা হয়। তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা বলেছেন, মার্কিন প্রশাসন যে শান্তি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে তা ইসরাইলের পক্ষে যায় এবং আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। অধিবেশনে হল্যান্ড থেকে নির্বাচিত সদস্য বলেছেন, আমেরিকার এই পরিকল্পনা একতরফা, অবৈধ এবং আন্তর্জাতিকভাবে উসকানি দেয়ার শামিল। স্পেন থেকে নির্বাচিত সদস্য বলেছেন, ট্রাম্পের এই পরিকল্পনাকে ‘শতাব্দীর সেরা প্রতারণা’। বেলজিয়ামের সদস্য ইইউর প্রতি আহবান জানিয়ে বলেছেন, সততার সঙ্গে বিশ্বস্ত মধ্যস্থতাকারী হিসেবে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা এবং ইইউর পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান বোরেলকে শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেয়া উচিত। গত ৩ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্পের পরিকল্পনা নিয়ে ওআইসির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তাতে ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মার্কিন প্রশাসনকে কোনো রকমের সহযোগিতা না করার জন্য সদস্য দেশগুলোর প্রতি আহবান জানানো হয়েছে। আরব লীগও ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছে। গত ১ ফেব্রুয়ারি জরুরি বৈঠকে দেশগুলো এ ব্যাপারে একমত হয়ে এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফেরাতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইলের ‘শতাব্দীর সেরা চুক্তি’তে ফিলিস্তিনদের ন্যূনতম অধিকার দেওয়া হয়নি। তাই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ট্রাম্পের প্রশাসনকে কোনো ধরনের সহায়তা করা হবে না। জোর করে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা উচিত হবে না। ট্রাম্পের পরিকল্পনা সম্পর্কে গত ৫ ফেব্রুয়ারি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনেয়ি বলেছেন, ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আগেই কথিত ‘ডিল অব দ্যা সেঞ্চুরি’র মৃত্যু ঘটবে। এই পরিকল্পনা মোকাবেলার পথ হচ্ছে ফিলিস্তিনি জাতি ও সংগঠনগুলোর সাহসিকতাপূর্ণ প্রতিরোধ ও জিহাদ এবং মুসলিম বিশ্বের সমর্থন। ইরানি প্রেসিডেন্ট, প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা, আইআরজিসি ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পৃথকভাবে এই পরিকল্পনাকে প্রত্যাখ্যন করেছে। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেছেন, ট্রাম্প কথিত শান্তি চুক্তির যে পরিকল্পনা প্রকাশ করেছেন তার বিরুদ্ধে আঞ্চলিক যেসব দেশ লড়াই করতে চায় তাদেরকে সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত রয়েছে তেহরান। উক্ত বিবৃতিতে ফিলিস্তিনকে মুসলিম উম্মার অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং বায়তুল মোকাদ্দাসকে মুসলিম উম্মাহর রেডলাইন হিসেবে অভিহিত করে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের ওপর গুরুত্বারোপ, ‘ডিল অব দ্যা সেঞ্চুরি’র প্রতি ঘৃণা প্রকাশ এবং এ ব্যাপারে নীরব না থাকার জন্য বিশ্বের মুসলমানদের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে। জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ট্রাম্পের পরিকল্পনার নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনদের ভূমি দখলের চেষ্টা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে’। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে সমর্থন দেওয়া আরবদেশগুলোকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসাবে আখ্যা দিয়ে বলেছেন, ওই দেশগুলোর লজ্জিত হওয়া উচিত। এখন যদি আল-আকসা মসজিদ রক্ষা করা না যায় তাহলে ভবিষ্যতে তারা কাবাকে লক্ষ্যবস্তু করলে তখনো প্রতিরোধ করা যাবে না। জেরুজালেম আমাদের জন্য সতর্কবার্তা। তুরস্কের একে পার্টির সহকারী প্রধান কার্তুলমাস এক বিবৃতিতে ট্রাম্পের প্রস্তাবের সমালোচনা করে বলেছেন, ‘না জনাব ট্রাম্প! জেরুজালেম ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী ও ইসলামিক বিশ্বের হৃদপিন্ড। ইয়েমেন, জর্ডান ও ফিলিস্তিনে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। কুয়েতের সংসদ স্পিকার গানিম ট্রাম্পের এই পরিকল্পনার কঠোর সমালোচনা করে এর একটি কপি ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছেন। তিনি গত ৮ ফেব্রুয়ারি আরব দেশগুলোর সংসদীয় ইউনিয়নের জরুরি বৈঠকে এটা করেছেন। পেটালিং জায়ায় আল-কুদস নিয়ে তৃতীয় পার্লামেন্টারি সম্মেলনের উদ্বোধনীতে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির বলেছেন, শতাব্দীর সেরা চুক্তি দিয়ে জেরুজালেমে ইসরাইলি দখলদারিত্ব বৈধ করতে চাচ্ছেন ট্রাম্প। এই শান্তি পরিকল্পনায় কেবল ইসরাইলি দখলদারিত্বকেই বৈধতা দেবে এবং নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের অধিকারের বিষয়টি উপেক্ষিত থাকবে। উপরন্তু তিনি ফিলিস্তিনিদের পাশে সবসময় থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। ট্রাম্পের কথিত শান্তি পরিকল্পনার তিরস্কার করে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি খসড়া প্রস্তাবে পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি পুনরায় সংযুক্ত করার ইসরাইলি পরিকল্পনার নিন্দা জানানো হয়েছে।খসড়ার অনুলিপি নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের কাছে তুলে ধরেছে তিউনিসিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিনবিষয়ক এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় গত ১১ ফেব্রুয়ারি। তাতে ফিলিস্তিনের প্রসিডেন্ট আব্বাস বলেছেন, ট্রাম্প ঘোষিত পরিকল্পনা বর্ণবাদী প্রথাকে শক্তিশালী করবে। এতে ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক জেরুসালেম শহরকে ইসরাইলি ভূখন্ড হিসেবে দেখানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় শহর জেরুসালেমের বাইরের আবু দিস নামের একটি ছোট গ্রামকে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে। ওই পরিকল্পনায় জর্দান নদীর পশ্চিম তীরের অংশবিশেষ ও গাজা উপত্যকা নিয়ে নামমাত্র একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়েছে, যে রাষ্ট্রের নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না। এই বৈঠকের আগে বেলজিয়াম, এস্তোনিয়া, জার্মানি, পোল্যান্ড ও ফ্রান্সের পক্ষ থেকে একটি যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আমেরিকার ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ পরিকল্পনায় জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব উপেক্ষা করা হয়েছে। জর্দান নদীর পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি ভূখন্ডে অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপন করে জাতিসঙ্ঘের আইন লঙ্ঘন করা হচ্ছে।
ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রেও বিরোধীতা হচ্ছে। দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে শান্তি আনার যেটুকু আশা ছিল তা নতুন এই মার্কিন পরিকল্পনার কারণে নষ্ট হলো। এই পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করবে’। উপরন্তু তিনি ফিলিস্তিনের জমি দখল করা থেকে ইসরায়েলকে বিরত রাখার জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। এছাড়া, ‘ডিল অব দ্যা সেঞ্চুরি’ কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের শতাধিক ডেমোক্রেট কংগ্রেস সদস্য। গত ৭ ফেব্রুয়ারি লেখা এক চিঠিতে আইনপ্রণেতারা এ শান্তি পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত টিমেরও কড়া সমালোচনা করেছেন। অপরদিকে, ট্রাম্পের এই পরিকল্পনায় ইসরাইল অধিকৃত সিরিয়ার গোলান মালভূমিকে ইসরাইলের অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে। অথচ ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় ইসরাইল গোলান মালভূমির একটি অংশ দখল করে নেয়। ১৯৮১ সালে এটি ইসরাইলের অংশ হিসেবে সংযুক্ত করে। কিন্তু ঐ বছরই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ গোলানের সংযুক্তিকরণকে অবৈধ বলে ৪৯৭ নম্বর প্রস্তাব পাস করে। তবুও ট্রাম্প নিরাপত্তা পরিষদের এই প্রস্তাব উপেক্ষা করে গোলান মালভূমিকে ইসরাইলের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাই রাশিয়া এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। এছাড়া, ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার ব্যাপারে অনেক বিশেষজ্ঞের অভিমত হচ্ছে: এই পরিকল্পনায় জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করা হয়েছে। জাতি সংঘের ২৪২ রেজ্যুলিশনে বলা হয়েছে, ‘যুদ্ধের মাধ্যমে দখল করা কোন ভূমি অধিগ্রহণ করা যাবে না অথবা আন্তর্জাতিক আইনে বলা হয়েছে যে, কেউ দখল করা জমিতে বসতি তৈরি করতে পারবে না’। তবুও ইসরাইল পশ্চিম তীরে একের পর এক বসতি নির্মাণ করে চলেছে এবং সেখানে ইহুদিদের বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে থাকতে দেওয়া হয়েছে এবং পশ্চিম তীরে ও গাজার কাছে সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে ইসরাইল। অর্থাৎ ট্রাম্পের পরিকল্পনায় ইসরাইলের জন্য সবকিছুই রয়েছে আর ফিলিস্তিনদের জন্য সামান্যই প্রস্তাব করা হয়েছে।এমন একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের কথা প্রস্তাব করা হয়েছে যার সার্বভৌমত্ব থাকবে না, চারদিকে ইসরাইলের ভূখন্ড দ্বারা বেষ্টিত থাকবে আর সবসময়েই ইহুদি বসতি বিস্তারের ঝুঁকির মধ্যে থাকবে। কারণ, ১৯৪৭ সালে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের যে প্রস্তাব করা হয়েছিল, তাতে পুরো ভূখন্ডের ৪৩% ছিল।২০২০ সালের পরিকল্পনায় পুরো ফিলিস্তিন টুকরো টুকরো খন্ডাংশ। ৭২ বছরে আগের পরিকল্পনায় জেরুজালেম ছিল আন্তর্জাতিক শহর, কিন্তু ২০২০ সালে তা পুরোপুরি ইসরাইলি নিয়ন্ত্রণে। অপরদিকে, ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনাকে অনেকেই বেলফোর ঘোষণার পুনরাবৃত্তি বলে উল্লেখ করেছেন। ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফোর ফিলিস্তিনি ভূখন্ডে ইহুদিদের জন্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই পরিকল্পনাই এখন বাস্তবায়ন করতে চাইছেন ট্রাম্প। স্মরণীয় যে, ফিলিস্তিন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। সেখানে ১৯৪৮ সালে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর ইহুদিদের বসতি স্থাপন করে দিয়েছিল মিত্র শক্তি। তার পর থেকে ইসরাইল সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে পশ্চিমাদের পূর্ণ সহায়তায়। ফিলিস্তিনদের উপর লাগাতার ব্যাপক নির্যাতন ও হত্যা চালিয়েছে। তাতে প্রাণভয়ে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি আশ্রয় নিয়েছেন পাশের দেশগুলোতে। সেখানে তারা চরম মানবেতর জীবন যাপন করছেন দীর্ঘকাল! এখন ট্রাম্পের পরিকল্পনা মতে, তারা ফিরতেও পারবে না মাতৃভূমিতে! এছাড়াও ১৯৬৭ সালে যুদ্ধে ইসরাইল পার্শ্ববর্তী সব দেশের বিশাল এলাকা দখল করে নিয়েছে, যা এখনও বহাল রেখেছে। ফলে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে পরিণত হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, নরওয়েতে উভয় পক্ষের বহুবার গোপন আলোচনার পর, ১৯৯৩ সালে হোয়াইট হাউজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের সভাপতিত্বে এক অনুষ্ঠানে একটি শান্তি চুক্তি হয়।যা অসলো চুক্তি বলে খ্যাত। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী রবিন এবং পিএলও প্রধান আরাফাত এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এর প্রেক্ষিতে রবিন, আরাফাত এবং ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেরেজ শান্তিতে নোবেল পান। সে চুক্তি মতেই ফিলিস্তিন স্বায়ত্তশাসন লাভ করেছে। চুক্তি অনুযায়ীই স্বল্প দিনের মধ্যেই ফিলিস্তিন পূর্ণ স্বাধীন হওয়ার কথা ছিল এবং তা জেরুজালেমকেই রাজধানী করে। এই চুক্তিকে বেশিরভাগ ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলি এবং জাতিসংঘসহ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ সমর্থন করেছিল। তবুও ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের উগ্রপন্থীরা এই চুক্তির প্রচন্ড বিরোধিতা করেছিল। নেতানিয়াহু ও জেনারেল শ্যারন এই চুক্তির প্রচন্ড বিরোধিতা করেছিলেন। রবিনকে তার কয়েকজন সহযোগী নানাভাবে কটুক্তি করেছিলেন। এই অবস্থায় ১৯৯৫ সালের ৪ নভেম্বর ইহুদি উগ্রপন্থীদের দ্বারা রবিন নিহত হন। অপরদিকে, ফিলিস্তিনি শিক্ষাবিদ সাইদ এই চুক্তিকে ‘আত্মসমর্পণ’ বলে নিন্দা করেছিলেন। ফিলিস্তিনি হামাসও এই চুক্তিকে নাজুক করে তুলেছিল। পরবর্তীতে ইয়াসির আরাফাত অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে বিষ প্রয়োগে অসুস্থ করা হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এই অবস্থায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০১৭ সালে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী করে একটি নীতি ঘোষণা করেছিলেন এবং তৎপ্রেক্ষিতে তেলআবিব থেকে মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তরও করেছিলেন। আরও ২-৩টি দেশও তাদের দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তর করেছিল। কিন্তু বাকী বিশ্ব এবং জাতিসংঘ সে নীতি প্রত্যাখ্যান করেছিল। প্রতিবাদে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। তবুও ট্রাম্প পুনরায় মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী করে এবং সিরিয়ার দখলকৃত গোলান মালভূমিকে অন্তর্ভুক্ত করে!
স্বাধীনতার নামে এখন যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তা পরাধীনতারই নামান্তর! তাই ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা ফিলিস্তিনিদের সাথে শতভাগ প্রহসন। দ্বিতীয়ত মুসলমানের প্রথম মসজিদ হচ্ছে আল আকসা মসজিদ। এটাই ছিল মুসলমানদের প্রথম কেবলা। পরবর্তীতে পবিত্র মক্কা শরীফ হয়েছে মুসলমানদের কেবলা। এই আল আকসা মসজিদ জেরুজালেমেই অবস্থিত। সেই জেরুজালেম যদি স্বাধীন ফিলিস্তিনের মধ্যে না থাকে, ইসরাইলের অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলে সেখানে মুসলমানরা কখনই অবাধে দর্শন ও নামাজ পড়তে পারবে না। ইহুদিদের দখলে থাকবে এবং বন্ধ থাকবে। এখন তাই হয়েছে। একই অবস্থা হবে সেখানে অবস্থিত কুব্বাত আস সাখরা, কুব্বাত আস সিলসিলা, কুব্বাত আন নবীর মত মুসলমানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থাপনাগুলোরও। তাই এই ঘৃণ্য বিষয়টি কোনো মুসলমানের প্রাণ থাকতে মেনে নেওয়া উচিৎ নয়। জীবন বাজী রেখে এটা স্বাধীন রাখার চেষ্টা করা নৈতিক দায়িত্ব। অপরদিকে, আল আকসা মসজিদের পাশেই আছে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের প্রিয় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রার্থনাস্থান রক্ষা করা, তার পবিত্রতা অক্ষুন্ন রাখা এবং ভক্তদের সেখানে স্বাধীনভাবে দর্শন ও প্রার্থনা করার সুযোগ করে দেওয়া মুসলমানদের নৈতিক দায়িত্ব। এখানেই ইসলামের মাহাত্ম। অপরদিকে, ইসরাইলের বুঝা উচিৎ যে, এই দিন শেষ দিন নয়, আরও দিন আছে। তখন যদি মধ্যপ্রাচ্যে একটি মুসলিম দেশ শক্তিশালী হয়ে উঠে, তাহলে কিন্তু ইসরাইলের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এখনই শান্তিপূর্ণ সহবস্থান গড়ে তুলতে হবে ইসরাইলকে। অন্যদিকে, বিশ্ববাসীরও ভেবে দেখা উচিৎ যে, বৃহৎ একটি অঞ্চলে অশান্তি রেখে নিজেরা শান্তিতে থাকা সম্ভব নয়।তাই মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আর সে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে বেশিরভাগ দেশের সমর্থিত অসলো চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে। জাতি সংঘেরও উচিৎ এই চুক্তি বাস্তবায়নে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Byazed Hasan ১৬ আগস্ট, ২০২০, ১০:৪৩ এএম says : 0
ধন্যবাদ স্যার । অনেক চমৎকার বলেছেন । অনেক কিছু জানতে পারলাম ।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন