শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

রাজনীতিমুক্ত থাকা উচিত সিভিল সোসাইটির

সুজনের সপ্তম জাতীয় কাউন্সিল

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০০ এএম

গত জাতীয় নির্বাচনে ৩০ শতাংশেরও কম ভোট পড়েছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান। তিনি বলেন, আমি মনে করি, ২০ দফার পরিবর্তে এখন একদফা দাবি তোলা দরকার, সেটা হলো সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা। জনগণ ভোটের অধিকার হারা বেশিদিন থাকতে পারে না। গতকাল সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সপ্তম জাতীয় কাউন্সিলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এমন মন্তব্য করেন।

রাজধানীর কাকরাইলস্থ ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে আয়োজিত সম্মেলনে সারা দেশ থেকে আগত ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের প্রায় এক হাজার সুজন নেতৃবৃন্দ এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। বক্তারা বলেন, সিভিল সমাজকে রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে হবে। বর্তমান রাজনৈতিক সমস্যা রাতারাতি দূর হতে হবে না। কারণ রাজনৈতিকরা এই সমস্যা সৃষ্টি করেছেন, তারা এটি সহজে দূর করবেন বলে মনে হয় না।

অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন সুজন কেন্দ্রীয় সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান। সম্মেলনে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির চেয়ারম্যান ড. রেহমান সোবহান, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবু হেনা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান, বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. রওনক জাহান, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি প্রমুখ। সুজন নেতৃবৃন্দের মধ্যে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সুজন নির্বাহী সদস্য আলী ইমাম মজুমদার, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, সহ-সম্পাদক জাকির হোসেন, সুজন জাতীয় কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। শোক প্রস্তাব পাঠ করেন সুজনের সহ-স¤পাদক জাকির হোসেন।

স্বাগত বক্তব্যে সুজন সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, আজকের বিরাজমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সুজন-এর এই সম্মেলন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আজকে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। অথচ গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের জন্য নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতেও সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা দেখি না। তাই দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণকে সোচ্চার করে তুলতে হবে।

ড. আকবর আলি খান বলেন, সর্বশেষ নির্বাচনে হয়ত ৩০ শতাংশেরও কম ভোট পড়েছিলো এবং পরে আরো ৫০ শতাংশ বেশি করে তা দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার দীপ্ত শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে সফলভাবে সম্পন্ন হলো সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক-এর সপ্তম জাতীয় সম্মেলন-২০২০।
সাবেক উপদেষ্টা বলেন, যেখানে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৩০ শতাংশেরও কম সেখানে জাতীয় নির্বাচনে ৮০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে দেখানো হয়েছিলো। সাধারণত, জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেয়ার হার তুলনামূলক কম থাকে কারণ সেখানে রাজনৈতিক দলগুলো তৃণমূল পর্যায়ে আশানুরূপ সংগঠিত থাকে না। কিন্তু যখন ইউনিয়ন পরিষদ অথবা নগর পর্যায়ে নির্বাচন হয় তখন স্থানীয় প্রার্থীরা অনেক বেশি সক্রিয় থাকে। তারা তাদের আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব ও শুভাকাক্সক্ষী সকলকেই ভোট দিতে উৎসাহিত করে। তাই কোনোভাবেই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোট প্রদানের হার জাতীয় নির্বাচনের থেকে বেশি হতে পারে না। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দক্ষিণ সিটিতে ভোট পড়েছিলো ২৯ শতাংশ এবং উত্তর সিটিতে পড়েছিলো ২৫.৩২ শতাংশ।

আকবর আলি খান বলেন, নির্বাচন কমিশনের উচিৎ প্রতিটা কেন্দ্রে ভোটের ফল ঘোষণার পূর্বে ওই কেন্দ্রে পড়া ভোটের সংখ্যা যাচাই করা। যদি দেখা যায় সেখানে ৯৫, ৯৮ কিংবা ১০০ ভাগ ভোট পড়েছে তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে ওই কেন্দ্রের নির্বাচন বাতিল করা উচিত। এভাবে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে গেলে অনেক অনিয়মই বন্ধ হয়ে যাবে। ইভিএমের ওপর মানুষের বিশ্বাস অর্জনের জন্য এখন পর্যন্ত কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ইভিএম প্রযুক্তিগত দিক থেকে অনেক বেশি কার্যকরী। কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশেই এ নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। বাংলাদেশেও ইভিএম ব্যবহার নিয়ে সতর্ক থাকা উচিত। সুশাসন নিশ্চিতে সুজনের প্রচেষ্টার প্রশংসা করে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে সংগঠনটির উচিত শুধুমাত্র নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতের দাবিতে অনড় থাকা। সিভিল সমাজকে রাজনীতি থেকে দ‚রে থাকতে হবে। যদিও তারা সবসময় রাজনীতি এড়াতে পারে না। তবে স্বতন্ত্র থাকাই ভালো। তিনি আরও বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক সমস্যা রাতারাতি দ‚র হতে হবে না। কারণ রাজনৈতিকরা এই সমস্যা সৃষ্টি করেছেন, তারা এটি সহজে দ‚র করবেন বলে মনে হয় না। আমি মনে করি, ২০ দফার পরিবর্তে এখন একদফা দাবি তোলা দরকার, সেটা হলো সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা।’

আবু হেনা বলেন, সুজন গণতন্ত্র, সুশাসন ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য কাজ করছে। এজন্য সুজন অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। তিনি বলেন, গণতন্ত্র চলতে পারে যখন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত হন। আর এই প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন নির্বাচনের মাধমে। তাই যোগ্য ব্যক্তিদের নির্বাচিত করা গেলে গণতন্ত্র কাজ করতে পারে এবং সুশাসন বিরাজ করতে পারে।

সাবেক সচিব বলেন, বিগত সময়ে সরকার, নির্বাচন কমিশন ও সুজনসহ অন্যান্যদের ধারাবাহিক অ্যাডভোকেসির ফলে দেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচনী ব্যবস্থায় বিভিন্ন সংস্কার সাধন করা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন সচিবালয়, আরপিও এবং আচরণবিধির সংশোধন, প্রার্থীদের তথ্য প্রদানের বাধ্যবাধকতা, ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয়ের বিবরণ দেয়ার বিধান ইত্যাদি। কিন্তু এতসব সংস্কারের পরও আজ আমরা কেন গণতন্ত্র ও সুশাসন নিয়ে চিন্তিত? তিনি বলেন, আমি মনে করি, একটা দেশ তার মাটির জন্য বড় হয় না। দেশের মানুষ ভালো ও যোগ্য হলে দেশও ভালো ও যোগ্য হয়। তাই যতই আইন করা হোক না কেন, যদি সেগুলো কার্যকর করা না হয় এবং সমভাবে সবার জন্য বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।

সাংগঠনিক প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সুজন সচেতন নাগরিকদের উদ্যোগে গড়ে ওঠা একটি সংগঠন। ২০০২ সালে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত প্রার্থীদের নির্বাচিত করার লক্ষ্য নিয়ে সংগঠনটি যাত্রা শুরু করে। পরবর্তীতে দেশের গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলকে লক্ষ্য হিসেবে সুজন-এর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে সুজন যেসব কাজ করছে তার মধ্যে অন্যতম হলো, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত প্রার্থীদের নির্বাচিত করা, রাজনৈতিক সংস্কার সংক্রান্ত কার্যক্রম, বিভিন্ন নীতি-নির্ধারণী ও জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জনমত সৃষ্টি, নাগরিক অধিকার আদায়ে সোচ্চার করা। তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদলের হাতিয়ার হলো নির্বাচন। কিন্তু আজকে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এজন্য আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে সঠিক পথে আনা ও গণতন্ত্রকে কার্যকর করার জন্য আমাদের কার্যক্রমকে আরও বেগবান করতে হবে। আলী ইমাম মজুমদার বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে পরিচ্ছন্ন করার লক্ষ্যে সুজন নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো প্রার্থীদের হলফনামা জনগণের সামনে তুলে ধরা। সুজন-এর এই প্রচেষ্টাকে আমি স্বাগত জানাই।

রানা দাশগুপ্ত বলেন, তিনজোটের রূপরেখার মাধ্যমে স্বৈরাচারী এরশাদের পতন হয়। তখন রাজনৈতিক দলগুলো থেকে স্লোগান তোলা হয়, আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব। কিন্তু সুজন স্লোগান তুলে, আমার ভোট আমি দেব, জেনে, শুনে বুঝে দেব। স্বৈরাচারী এরশাদের পতন ঘটার পরও আজও আমাদেরকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন পরিচালনা করছে এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। আমি মনে করি, একটি সংস্কার প্রস্তাব পাস হওয়া দরকার। কারণ আমরা গণতন্ত্রহীনতা, ভোটাধিকারহীনতা চাই না। জোনায়েদ সাকি বলেন, নাগরিকদের জন্য একটি মর্যাদাপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিকদের সক্রিয় থাকতে হয়। এক্ষেত্রে সুজন অসাধারণ কাজ করছে। তিনি বলেন, দেশ আজ শুধু গণতন্ত্রহীনই নয়, বরং দেশে আজ এক নতুন রাষ্ট্র কাঠামো দাঁড় হয়েছে, যা কোনো তুলনা হয় না। আজকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে প্রতিনিয়ত নাগরিকদের অধিকার হরণ করা হচ্ছে। তাই আমাদেরকে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হতে হবে। ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জনগণের আন্দোলনের মাধ্যমেই জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, আজকে মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষা ও মানুষের অধিকার প্রতিনিয়ত ভূলণ্ঠিত হচ্ছে। তাই আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে একটা আমুল সংস্কার দরকার।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন