শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পরিবেশ বাঁচাতে জৈব-প্লাস্টিকের বিকাশ প্রয়োজন

তৌহিদা আক্তার | প্রকাশের সময় : ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম

প্লাস্টিকের পণ্য আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। অনেক হালকা এবং দামে সস্তার কারণে প্লাস্টিক খুব জনপ্রিয়। দোকানে দোকানে পাতলা প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগের ছড়াছড়ি। বর্তমানে এমন যুগে বাস করছি যাকে প্লাস্টিক যুগও বলা যায়। ঘরে বাইরে আসবাবপত্র কিংবা খেলনা-যন্ত্রপাতিতে বা গাড়ি-উড়োজাহাজের বিভিন্ন অংশ, ল্যাবরেটরির বিভিন্ন কাজে দেখা যায় প্লাস্টিকজাত সামগ্রীর বহুল ব্যবহার। প্লাস্টিকের এই ব্যবহারের কারণ হলো এটিকে যেকোনো আকৃতি দেয়া যায়, রাসায়নিকভাবে উচ্চ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন এবং কমবেশি নমনীয়তা গুণসম্পন্ন।


কিন্তু পলিথিন ব্যাগ, কসমেটিক প্লাস্টিক, গৃহস্থালির প্লাস্টিক, বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্যের বেশিরভাগই রিসাইক্লিং হয় না। এগুলো পরিবেশে থেকে বর্জ্যের আকার নেয়। আলাদা করে অন্যান্য আবর্জনার সঙ্গে পোড়ানো না হলে এসব প্লাস্টিকের ব্যাগ রাস্তায় গিয়ে পড়ে, এমনকি শেষমেষ সাগরে।

প্লাস্টিক মানে বিষ। বাজারের প্রচলিত প্লাস্টিক বা পলিথিন যা শপিং ব্যাগ তৈরির প্রধান উপকরণ, তা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। কারণ হলো পলিথিন বা পলিইথিলিন সাধারণত নষ্ট হয় না। প্লাস্টিক উৎপন্ন হয় কার্বনের পলিমার যৌগ দিয়ে। কার্বনের পলিমার যৌগগুলো পলিথিন, পলিস্টাইরিন, পলিপ্রপিলিন ইত্যাদি নামে পরিচিত। সাধারণত যেকোনো জিনিস খোলা পরিবেশে রেখে দিলে কিছুদিনের মধ্যে এর পচন ধরে। পচনের এই কাজটা করে অণুজীব। বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় প্রকৃতিতে থাকা সব ধরনের পদার্থকেই ভেঙে সরল উপাদানে পরিণত করতে পারে এই অণুজীব। কিন্তু প্লাস্টিকের মতো পদার্থকে ভাঙার ক্ষমতা অণুজীবের নেই। সাধারণ কোনো ব্যাকটেরিয়া একে হজম করতে পারে না। ফলাফলস্বরূপ মাটিতে, নর্দমায়, খালে, নদীতে পরে থাকা পলিথিন নষ্ট না হয়ে থেকে যায় বছরের পর বছর ।

প্লাস্টিক এমন এক রাসায়নিক পদার্থ যা পরিবেশে পচতে অথবা কারখানায় রিসাইক্লিং করতে প্রচুর সময় লাগে। তাই একে ‘অপচ্য পদার্থ’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। উদ্ভিদক‚ল, জলজ প্রাণী, দ্বীপ অঞ্চলের প্রাণীরা প্লাস্টিক বর্জ্যরে জন্য মারাত্মক ক্ষতির সন্মুখীন হচ্ছে। প্লাস্টিক বর্জ্য ঐসকল প্রাণীর বাসস্থান, খাদ্য সংগ্রহের স্থান ও উদ্ভিদের খাদ্য গ্রহণের পথে বাধার সৃষ্টি করে। শুধুমাত্র উদ্ভিদ ও জলজ প্রাণী নয়, মানুষ পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে প্লাস্টিক দূষণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যেহেতু প্লাস্টিক অপচ্য পদার্থ, তাই সৃষ্টির পর রিসাইক্লিং না হওয়া পর্যন্ত এটি পরিবেশে অবস্থান করে। এটি নিয়মিত প্রাণীর খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়ছে (মাইক্রো কণাসমূহ), যা প্রাণীর জন্য খুবই বিপজ্জনক। বিভিন্ন উপায়ে প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশের ভারসাম্যকে নষ্ট করছে।

ক্লোরিনযুক্ত প্লাস্টিক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে যা ভূগর্ভস্থ পানি ও ভূপৃষ্ঠীয় পানির সাথে মিশে যায়। অতঃপর ভূগর্ভস্থ ও ভূপৃষ্ঠীয় পানি গ্রহণের সাথে সাথে তা আমাদের খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়ে। যেমন, প্লাঙ্কটন সাইজের প্লাস্টিক কণাকে জলজ প্রাণী প্রায়ই খাদ্য মনে করে ভুল করে গিলে খায়। জলজ প্রাণী এসব খাবার হজম করতে না পেরে মারা যায়। এসব মৃত, রোগাক্রান্ত মাছ জেলেদের জালে ধরা পড়ে খাদ্যচক্রের আবর্তে আবার মানুষের পেটে চলে যায়। এভাবে নদী ও সাগরে ফেলে দেয়া টুকরো টুকরো প্লাস্টিক কণা মাছের খাবারের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশের আশঙ্কা দিন দিন বাড়ছে। মাটিতে পচতে এটার ৫০০ বছর অবধি সময় লাগে আর এভাবেই পানি গ্রহণের সাথে সাথে প্রতিনিয়ত আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। প্লাস্টিক দূষণ মানুষের স্বাস্থ্যের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। সাধারণত প্লাস্টিক পদার্থে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক রঞ্জক মেশানো হয়। এসকল রঞ্জক কারসিনোজেন হিসেবে কাজ করে এন্ডোক্রিনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

আমরা অধিকাংশই প্লাস্টিকের বোতলে পানি রাখি। এটা যে নানা সমস্যার কারণ হতে পারে, তা না জেনেই। ১. বেশি তাপমাত্রায় বোতল গরম হলে, এর মধ্যে থেকে ক্ষতিকর পদার্থ বের হয়। যেটা পানি পানের মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে এবং আমাদের স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করে। ২. প্লাস্টিকের বোতলে পানি পান করলে হৃদরোগ, গর্ভবতী নারীদের সমস্যা ও পেটের রোগ হতে পারে। ৩. পানি দীর্ঘক্ষণ বোতলে রেখে দিলে এতে এক ধরনের জীবাণু জন্ম নেয় যা সমস্ত অঙ্গেরই ক্ষতি করে।

বর্তমান সময়ের অ্যালার্জি, হাঁপানি, চর্মরোগ, কিডনি রোগ, থাইরয়েডের অতিরিক্ত হরমোন ক্ষরণ এবং ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ নানান জটিল রোগের জন্য এই প্লাস্টিককে দায়ী করা হয়। অতএব, আমাদের নিজেদের সুস্বাস্থ্য রক্ষায় এবং জীবনযাত্রার মান রক্ষার্থে পণ্যদ্রব্যের গুণগত মান নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। আর পণ্যদ্রব্যের গুণগত মান নিশ্চিত করতে প্লাস্টিকের বিকল্প কিছু ব্যবহার করতে হবে যা পরিবেশবান্ধব।

প্লাস্টিকের ভয়াবহ দূষণ থেকে রক্ষা পেতে বিজ্ঞানীরা বিকল্প প্লাস্টিকের সন্ধান করছেন। বাংলাদেশে প্লাস্টিক ব্যাগের পরিবর্তে পচনশীল পাটের ব্যাপক প্রচলনের চেষ্টা চলছে। পাট ও পাটজাত পণ্য শুধু পরিবেশবান্ধব এবং সহজে পচনশীলই নয়, এটা পরিবেশকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে। পরিবেশ দূষণকারী পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হতে পারে স্বল্পব্যায়ে তৈরি পাটের ব্যাগ। মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে পাটের গুরুত্ব অপরিসীম।

এছাড়াও সম্প্রতি সন্ধান মিলেছে প্লাস্টিকের বিকল্প জৈব প্লাস্টিকের। এই যুগে প্লাস্টিকহীন হিসেবে থাকা সম্ভব নয়। একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকই পরিবেশে সমস্যা তৈরি করছে। এই বিপদ থেকে বাঁচতে উন্নততর প্লাস্টিক ব্যবহার করা দরকার। দূষণ সৃষ্টিকারী প্লাস্টিকের বদলে ‘বায়োপ্লাস্টিক’ বা জৈব প্লাস্টিক তৈরি হয়েছে। খাদ্যদ্রব্যের বাদ দেওয়া, পরিত্যক্ত, ফেলে দেওয়া অংশ থেকে জীবাণুর সাহায্যে বিয়োজিত করে, মাটিতে ও পরিবেশে মিশে যাওয়ার উপযুক্ত জৈব প্লাস্টিক তৈরি করতে সক্ষম হয়েচে হনলুলুর হাওয়াই ন্যাচারাল এনার্জি ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী জেন ইউ। এছাড়া জিন প্রযুক্তির সাহায্যে এমন এক উদ্ভিদ জন্ম দেওয়া হয়েছে যা থেকে পাওয়া যাবে এক বিশেষ ধরনের পলিমার। এই পলিমারকে উত্তাপের সাহায্যে গলিয়ে তৈরি করা হবে প্লাস্টিক। এটাই জৈব প্লাস্টিক। এই জৈব প্লাস্টিক পরিবেশকে দূষিত করবে না। কাগজের মতোই পরিবেশের সঙ্গে মিশে যাবে।

এই ব্যাগগুলো মিশ্র সারের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা চলে। কেননা এগুলো শেষমেষ উদ্ভিদ পদার্থের মতোই পঁচে যায়। তা সত্ত্বেও বায়োপ্লাস্টিক ফয়েল সহজে ছিঁড়ে না; তার উপর ছাপা যায়; মেশিনে কাট-ছাঁট করা যায়। বায়োপ্লাস্টিকের ব্যাগ আবর্জনা কমায়। বায়োপ্লাস্টিক ব্যাগের সুবিধা হলো, তা সাধারণ প্লাস্টিক ব্যাগের মতো সরানো বা পোড়ানোর কোনো দরকার পড়ে না। কাজেই বায়োপ্লাস্টিকের রিসাইক্লিং এর প্রয়োজন পড়ে না। বায়োপ্লাস্টিকের ব্যাগ কিছুকাল পরে নিজে থেকেই পঁচে যায়, আলাদা করে অপসারণ করতে হয় না। জৈব প্লাস্টিক, সাধারণ প্লাস্টিকের মতো ভূগর্ভস্থ পানি ও ভূপৃষ্ঠীয় পানির, উদ্ভিদ ও জলজ প্রাণীদের, খাদ্যচক্রের সর্বোপরি পরিবেশের ক্ষতি করে না। যার জন্যেই, ‘বায়োপ্লাস্টিক’ বা জৈব প্লাস্টিক পরিবেশবান্ধব।

জৈব প্লাস্টিক হলো নতুন প্রজন্মের প্লাস্টিক, যা প্রস্তুত করতে ব্যবহৃত হতে পারে ভুট্টা, আলু, আখ, সয়াপ্রোটিন, ল্যাকটিক এসিড ইত্যাদি। কাঁচামাল হিসেবে পেট্রোলিয়ামের পরিবর্তে এগুলো ব্যবহৃত হওয়ার সুবিধা হলো এদের সহজলভ্যতা। যেহেতু উদ্ভিদ বায়ুমন্ডল থেকে কার্বনডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে বৃদ্ধি পায়, সেহেতু উদ্ভিদজাত বায়োপ্লাস্টিকের দহনে উৎপন্ন কার্বনডাই-অক্সাইড বায়ুমন্ডলের কার্বনডাই-অক্সাইডের ভারসাম্যের পরিবর্তন করে না। বায়োপ্লাস্টিক পরিত্যাক্ত অবস্থায় ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গি প্রভৃতি আণুবীক্ষণিক জীবের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে সহজেই কার্বনডাই-অক্সাইড, পানি ও জৈব পদার্থে পরিণত হয়। এভাবে প্রাপ্ত জৈব পদার্থ সার হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে। পরিবেশ-সহায়ক হওয়ায় পরবর্তী প্রজন্মের প্লাস্টিক হিসেবে বায়োপ্লাস্টিকের ব্যবহার যথোপযুক্ত।

উদ্ভিদ বা উদ্ভিদজাত বস্তু যেমন-বাঁশ, তন্তু, দানাশস্যের তুষ প্রভৃতি বিশেষ প্রযুক্তির সহায়তায় এমন জৈব প্লাস্টিকে পরিবর্তিত করা যা হবে সুলভ ব্যবহারিক, প্রয়োজনীয়তাযুক্ত এবং পরিবেশবান্ধব। পাট থেকে জৈব প্লাস্টিক বা বায়োপ্লাস্টিক উৎপাদনের প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেছেন ড. মোবারক আহমদ খান। তিনি বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা। বাংলাদেশে বিভিন্ন জলজ প্রাণী ও মাছের অস্তিত্ব হ্রাস পাওয়ার অন্যতম কারণ পানিতে প্রচুর পরিমাণে পলিথিনের উপস্থিতি। কিন্তু পাট থেকে উৎপাদিত জৈব প্লাস্টিক বা বায়োপ্লাস্টিক ধীরে ধীরে পচে যায় কারন এটি জৈব পদার্থ। ২০০২ সালে, বিশে^র প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আইনগতভাবে পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন বন্ধ করে। এছাড়াও এর আগে ও পরে বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কোনোটাই ফলপ্রসূ হয়নি। তার কারণ একটিই, সেটা হলো পলিথিনের উপযুক্ত বিকল্পের অভাব। কেননা পলিথিনের চাহিদা প্রচুর। যদি বাজারে চাহিদা থাকে, তা হলে উপযুক্ত বিকল্প ছাড়া কোনো পণ্যের সরবরাহ বন্ধ করা অসম্ভব।

প্রাথমিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, পাট থেকে উৎপাদিত প্লাস্টিক ব্যাগের খরচ প্রচলিত প্লাস্টিক ব্যাগের চেয়ে কিছুটা বেশি। ভোক্তা পর্যায়ে জৈব প্লাস্টিক ব্যাগের দাম প্রচলিত ব্যাগের চেয়ে বেশি হলে কোনো উদ্যোগই কার্যকর হবে না। তাই উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে এ খরচ কমাতে হবে পরিবেশ রক্ষার জন্যে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে এদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত ছিল পাট। আর সেই পাটই যখন জৈব প্লাস্টিকের কাঁচামাল, তখন বলাবাহুল্য যে, বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় পরিবেশবান্ধব তন্তু হিসেবে আবার পাটের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। মনে রাখতে হবে, এ সমস্যাটা পুরো দেশের। তাই, এই জৈব প্লাস্টিক বা বায়োপ্লাস্টিক ব্যাগ প্রচলন করতে হবে সারা দেশে। এভাবেই, প্রচলিত প্লাস্টিকের বিকল্প হিসাবে জৈব প্লাস্টিক বা বায়োপ্লাস্টিক ব্যবহার করে পণ্যের গুণগতমান বজায় রাখতে হবে এবং প্লাস্টিক বিপর্যয়ের মুখ থেকে বাংলাদেশ তথা পুরো বিশ্বকে বাঁচাতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন