শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

কারণ ছাড়াই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে উইঘুরদের, দলিল ফাঁস

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ৬:৫৭ পিএম

জিনজিয়াং প্রদেশে প্রায় এক কোটি উইগুরের বাস। এর মধ্যে প্রায় ১০ লাখ প্রদেশটির কারাগারগুলোতে নিখোঁজ অবস্থায় বন্দি আছেন বলে ধারণা করা হয়। জানা যায়, এসব কারাগার ও ক্যাম্পে অনেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্দি আছেন। কেউ কেউ ফিরে আসেন ‘লেবার ক্যাম্প ‘। যারা ঘরে ফেরেন, তাদের কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়।

চীন কর্তৃপক্ষের দাবি, এসব কারাগার হলো ‘কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’। ‘চরমপন্থি’ মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়তেই এগুলো তৈরি করা হয়েছে। বিনিময়ে তাদের ‘মূল্যবান কর্মদক্ষতার’ প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বার্লিন সফর করেন। তখন তাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন যে, বেশ কয়েকজন এনজিও কর্মী ও সাংবাদিককে জিংজিয়াং প্রদেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘তারা একটিও কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বা রি-এডুকেশন ক্যাম্প দেখেননি, জিংজিয়াংয়ে কোনো নির্যাতন চালানো হয় না।’

কিন্তু সম্প্রতি ডয়চে ভেলে ও কয়েকটি জার্মান মিডিয়া হাউজের হাতে একটি দলিল এসেছে। সেই দলিলের তথ্য চীনের সরকারি বক্তব্য সমর্থন করে না। সেখানে দেখা যায়, চীন উইঘুরদের অন্তরীণ করে রেখেছে তাদের চরমপন্থি আচরণের জন্য নয়, বরং সাধারণ ধর্মীয় আচার ও সংস্কৃতি পালনের কারণে।

ফাঁস হওয়া দলিলটি ১৩৭ পৃষ্ঠার। সেখানে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে আটককৃত ৩১১ জন উইগুরের নাম ও আইডি নম্বর তালিকাভুক্ত করা আছে। শুধু তাই নয়, কারা এদের পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী ও বন্ধুবান্ধব, তা-ও বিস্তারিত আছে সেখানে। মোট এক হাজার ৮শ’ জন উইগুরের পুরো নাম ও আইডি এবং তাদের সামাজিক আচরণের তথ্য আছে সেখানে। সামাজিক আচরণ বলতে তারা বাসায় নামাজ বা কোরআন পড়েন কিনা - এসব। আরো কয়েকশ’ নাম আছে, যাদের বিস্তারিত এখনো লিপিবদ্ধ করা হয়নি। লিপিবদ্ধ সবগুলো নাম ভারত ও তিব্বত সীমান্তবর্তী কারাকাক্স কাউন্টির। জিনজিয়াংয়ের তুলনায় লিপিবদ্ধ এলাকাটি খুব ছোট হলেও এটা স্পষ্ট যে চীন কর্তৃপক্ষ উইঘুরদের সম্পর্কে ব্যাপক তথ্য সংগ্রহ করেছে। নিরাপত্তা ক্যামেরায় তাদের চলাচলে প্রতিমুহূর্তে নজর রাখা হচ্ছে। স্মার্টফোন ‘ফেস রিকগনিশন’ অ্যাপ ব্যবহার করতে বাধ্য করা হচ্ছে।

এদের যেসব ‘অপরাধে’ আটক করা হয়েছে, সেগুলো হলো, বৈধ সংখ্যার চেয়ে বেশি শিশু জন্ম দেয়া, পাসপোর্টের জন্য আবেদন করা, লম্বা দাঁড়ি রাখা ইত্যাদি। একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ছয় বছর আগে একটি ধর্মীয় ভিডিও ডাউনলোড করেছিলেন। সেজন্য তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দলিলটিতে কোনো দাপ্তরিক সিল বা স্বাক্ষর নেই। কিন্তু ডয়চে ভেলে অনেকের সঙ্গে কথা বলেছে এবং এর ভাষা ও তথ্য বিশ্লেষণ করে বিশ্লেষকরা বলেছেন, এটি যে চীন কর্তৃপক্ষের তৈরি করা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তালিকা থেকে কয়েকজনের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগও করেছে ডয়চে ভেলে।

দলিল ফাঁসকারী ব্যক্তির নাম আবদুওয়েলি আয়ুপ। তিনি নরওয়েতে বসবাসরত একজন উইঘুর অ্যাকাডেমিক। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করেছেন। আয়ুপ জিনজিয়াংয়ে উইঘুর ভাষা শিক্ষার স্কুল খুলতে চেয়েছিলেন। সেজন্য ১৫ মাস কারাবাস করতে হয় তাকে। দেশে নিজের পরিবার বিপদে পড়বে জেনেও আয়ুপ সামনে আসার সিদ্ধান্ত নেন। সম্প্রতি তার স্ত্রীর পরিবারের বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এমনকি ডিডাব্লিউকে সাক্ষাৎকার দেয়ার ঠিক আগে টেলিফোনে হুমকিও পান তিনি। ‘আমি জানি, এটা বিপদজনক। কিন্তু কাউকে না কাউকে কথা বলতে হবে। বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে হবে কী হচ্ছে,’ বলেন তিনি। তালিকাটি হাতে পাবার পর স্তব্ধ হয়ে যান আয়ুপ। চীন কর্তৃপক্ষ যতই চরমপন্থার কথা বলুক, তার মতে, ‘কোনো কারণ ছাড়াই লোকেদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।’

আয়ুপ যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তাদের একজন রোজিনিসা মেমেত তোহতি। তিনি একজন গৃহিনী ও তিন সন্তানের মা। তোহতি জানতে পারেন, তার সবচেয়ে ছোট বোনটি আছেন তালিকায়। ‘বহুদিন আমি কিছু খেতে বা ঘুমোতে পারিনি। কখনো ভাবতে পারিনি আমার সবচেয়ে ছোট বোনটি জেলে যাবে।’ তার সবচেয়ে বড় বোন ও বৃদ্ধ বাবা-মাকে ২০১৬ সালে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এই খবর আগেই জানতে পেরেছিলেন তোহতি। কিন্তু তিনি জানতেন না যে, তার সর্বকনিষ্ঠ বোনটিও ২০১৮ সালের মার্চে আটক হন। তিনি বাকি আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন না। ভয় পেতেন, যদি তাদের কোনো ক্ষতি হয়।

চীনা কর্তৃপক্ষ সবসময়ই বলে আসছে যে, ক্যাম্পগুলো হলো উইঘুর চরমপন্থার বিরুদ্ধে তাদের নেয়া ব্যবস্থা।২০০৯ সালে জিনজিয়াং প্রদেশের রাজধানী উরুমকিতে জাতিগত দাঙ্গায় ১৪০ জন নিহত এবং অসংখ্য আহত হয়। বিক্ষোভকারীরা চীনা অধিবাসীদের ওপর হামলা চালান এবং তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেন। ২০১৪ সালে উরুমকির একটি মার্কেটে সন্ত্রাসী হামলায় ৩১ জন মারা যান। জবাবে চীন সরকার উইঘুরদের ওপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে থাকে। চীনে উইঘুর মুসলিমরা যুগ যুগ ধরে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার। এর কারণেই তাদের মধ্যে এই আসান্তোষ তৈরি হয়েছে। সূত্র: ডয়চে ভেলে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন