মাওলানা ফজলুল করিম রহ. এর ৭১ বছরের কর্মময় ও সংগ্রামী জীবন এক বিস্ময়কর উপখ্যান। তিনি পথভোলা মানুষের আত্মিক পরিশুদ্ধি ও নৈতিক সমৃদ্ধির সর্বাত্মক প্রচেষ্টা যেমন চালিয়েছেন তেমনি শিরক বিদআতের মোকাবেলা করেছেন। তিনি গণমানুষের মুক্তির জন্যে অধিকার আদায়ের জন্যে রাজপথে আন্দোলন ও সংগ্রাম করেছেন। আবার শিক্ষা সংস্কার তালিম তারবিয়াতেও আত্মনিয়োগ করেছেন।
এ ক্ষণজন্মা মহা পুরুষ ১৯৩৫ সাল মোতাবেক ১৩৫৪ হিজরীতে বরিশাল জিলার কোতোয়ালী থানার অন্তর্গত চরমোনাই গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। আলিম ও বুযুর্গ পিতা-মাতার তত্ত্বাবধানে এবং দ্বীনী পরিবেশে তাঁর শিক্ষার হাতে খড়ি হয়। মাত্র ৫ বছর বয়সে তিনি নিজ গ্রামস্থ চরমোনাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পাশাপাশি পিতা-মাতার যতে্ন স্থানীয় মক্তবে পবিত্র কুরআন শিক্ষা শুরু করেন এবং চরমোনাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তিনি ১৯৪৫ সালে পিতার প্রতিষ্ঠিত চরমোনাই আহ্সানাবাদ রশীদিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এখান থেকে কৃতিত্বের সাথে তিনি ফাযিল পাস করেন। এখানে তাঁর উস্তাদগণের মধ্যে উলেখযোগ্য ছিলেন মুফতীয়ে আ’যম হযরত মাওলানা আবদুল মুঈয বিহারী (রহঃ)। অতঃপর ১৯৫৬ সালে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকার লালবাগ জামেয়া কুরআনিয়ায় লালবাগ ভর্তি হন। লালবাগ মাদ্রাসায় দু’বছর অধ্যায়ন করে ১৯৫৭ সালে তিনি কৃতিত্বের সহিত দাওরায়ে হাদীস পাস করেন। দাওরায়ে হাদীসে তিনি প্রথম স্থান লাভ করেন। হযরত পীর সাহেব (রহঃ) লালবাগ মাদ্রাসার প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মুজাহিদে আ’যম হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহঃ), আলামা হেদায়াতুলাহ (রহঃ), হযরত মাওলানা মুহাম্মদ উলাহ হাফেজ্জী হুযূর (রহঃ), হযরত মাওলানা আবদুল মজীদ ঢাকুবী হুযূর (রহঃ), হযরত মাওলানা মুফতী আবদুল মুহীত সাহেব (রহঃ), এবং শাইখুল হাদীস আল্লামা হযরত মাওলানা আজিজুল হক সাহেব প্রমুখ যুগশ্রেষ্ঠ বুযুর্গ আলিমদের নিকট অধ্যয়ন করেন।
হযরত পীর সাহেব হুযূর (রহঃ) যখন লালবাগ মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন, তখন হযরত হাফেজ্জী হুযূর (রহঃ) দাওরায়ে হাদীস ক্লাসে বোখারী শরীফ এবং তিরমিযী শরীফ পড়াতেন। বার্ষিক পরীক্ষায় হযরত হাফেজ্জী হুযূর (রহঃ) তাঁর সঠিক উত্তর প্রদান ও চৌকষ লেখার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তিরমিযী শরীফে ১০০ নাম্বারের মধ্যে ১০৫ নাম্বার প্রদান করেন। উলেখ্য যে, খুব ভাল লিখলে কওমি মাদরাসায় পূর্ণমানের চেয়ে বেশী নম্বর দেয়ার একটা প্রচলন তৎকালে বিদ্যমান ছিল।
শিক্ষকতা: ১৯৫৭ ইং সালে হযরত পীর সাহেব চরমোনাই (রহঃ) লালবাগ মাদ্রাসা হতে দাওরায়ে হাদীস পাস করার পর চরমোনাই আহ্সানাবাদ রশীদিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে নিয়োজিত হন। এ সময় থেকে একটানা বার বছর পর্যন্ত তিনি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। হযরত পীর সাহেব হুযূর (রহঃ) হাদীস, তাফসীর, ফিক্বহ, উসূল ইত্যাদি সব ধরণের কিতাবই পড়াতেন। তিনি “মাকামাতে হারিবী”ও অনায়াসে পড়াতেন, যাতে তার আরবী ভাষা ও সাহিত্যে দক্ষতা প্রস্ফুটিত হয়ে উঠত। কামিল জামায়াতে তিনি ইবনে মাজাহ শরীফের দরসে দিতেন। এছাড়া তিনি শামায়েলে তিরমিযীও নিয়মিত পড়াতেন। মাঝে মাঝে বুখারী শরীফের দরস দিতেন। এসব কিতাব ছাড়া মিশকাত শরীফ, হিদায়া, শরহে বিকায়া, নূরুল আনওয়ারসহ দরসী প্রায় সব কিতাবের তিনি পাঠদান করতেন।
হুজুরের অবদান: হযরত পীর সাহেব হুযুর (রহঃ) এর অবদানে বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে-
১. বাংলাদেশ কুরআন শিক্ষা বোর্ড, ২. হিফ্য বিভাগ-এ বিভাগে দক্ষ হাফিযদের মাধ্যমে অল্প সময়ে পবিত্র কুরআন হিফয করানো হয়।
৩. ক্বিরাআত বিভাগ- সুদক্ষ ক্বারীর তত্ত্বাবধানে সহীহ্ ভাবে এবং ইলমে তাজবীদ সহকারে কুরআন তিলাওয়াত ও ক্বিরাআতে ছাবআ বা সাত ক্বিরাআত শিক্ষার আলাদা বিভাগ। ৪. তাখাচ্ছুছ বা অনার্স-হাদীস, তাফসীর ও ফিক্বহ শাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জনের জন্য এ বিভাগ চালু করা হয়। ৫. মুজাহিদ প্রকাশনী- বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটি কর্তৃক পরিচালত “মুজাহিদ প্রকাশনী” হযরত পীর সাহেব হুযুর (রহঃ) এর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ প্রকাশনী হতে আজ পর্যন্ত প্রায় ১৪০-১৫০ টি কিতাব প্রকাশিত হয়েছে। এসব কিতাবের মধ্যে রয়েছে কুরআন, হাদীস, ফিক্বহ, তাসাওউফ ও রাজনৈতিক বিষয়ের ওপরে লিখিত কিতাব। ৬. কুরআন শিক্ষা বোর্ড প্রকাশনা বিভাগ- কুরআন শিক্ষা বোর্ডের অধীনস্থ মাদ্রাসাসমূহের পাঠ্যপুস্তকে এ প্রকাশনা হতে প্রকাশ করা হয়। ৭. ইশা আন্দোলন প্রকাশনা বিভাগ- এ প্রকাশনা বিভাগ হতে আন্দোলন, সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংক্রান্ত কিতাবাদি প্রকাশিত হয়। ৮. আল-ফাতাহ প্রকাশনী- এ প্রকাশনী থেকেও বিভিন্ন বিষয়ের ওপরে লিখিত বই পুস্তক প্রকাশিত হয়। ৯. মারকাযুদ্দাওয়াহ ওয়াল ইফতা- দেশের শীর্ষস্থানীয় ফক্বীহদের সমন্বয়ে এ বিভাগ চালু করা হয়েছে। সমসাময়িক কালের উদ্ভূত নতুন নতুন সমস্যার কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াসের আলোকে সমাধান পেশ করা তথা ফতোয়া ও মাসআলা প্রদান করা এ বিভাগের অন্যতম দায়িত্ব। এ বিভাগ হতে ইতোমধ্যে দেশে প্রচলিত নেটওয়ার্ক বিজনেসের ব্যাপারে সুষ্পষ্ট ফতোয়া প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা থেকে হযরত পীর সাহেব (রহঃ) এর বয়ান, ভাষণ, ওয়ায-নসীহতসমূহ পুস্তক আকারে বের হয়েছে, যা মানুষের জন্য হেদায়েতের আলোক বর্তিকা স্বরূপ। গ্রন্থরাজির মধ্যে উলেখযোগ্য হলঃ ১) মাওয়ায়েযে কারীমিয়া (১ম থেকে ৪র্থ খন্ড পর্যন্ত) এ সব কিতাবে চরমোনাই মাহফিলে পীর সাহেব হুযূরের বয়ানসমূহ সংকলিত হয়েছে।
২) মানুষ হওয়ার উপায়-এটি বিভিন্ন রমযানের তারবিয়াতের বয়ানের কিতাব, যা তাসাউফ ও মা’রিফাতের স্বরূপ। ৩) কুয়েতের ভাষণ- ২৫/০৯/৯৭ ইং তারিখে কুয়েত সিটিতে হযরত পীর সাহেব (রহঃ) ওলামায়ে কেরামের সম্মেলনে যে ঐতিহাসিক ভাষণ পেশ করেন তা সংকলিত হয়েছে। ৪) চরমোনাইর হযরত পীর হুযূরের ঐতিহাসিক ভাষণৎ ৩০ ডিসেম্বর’ ৯৪ বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে স্মরণকালের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ যে ভাষন পেশ করেন, তা এতে সংকলিত হয়েছে। ৫) চরমোনাইর পীর সাহেব হুযূরের কুয়েতের পাঁচ দিন । ৬) চরমোনাইর পীর সাহেব হুযূরের ভারত সফর।
বাইয়াত গ্রহণ ও খেলাফত লাভ: হযরত মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম (রহঃ) ছাত্র জীবনেই স্বীয় পিতা ও শাইখ হযরত মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ইসহাক (রহঃ) এর নিকট তরীকতের বাইয়াত গ্রহণ করেন। জাহেরী ইল্মের পাশাপাশি তিনি বাতেনী ইল্মও অর্জন করেন। (চলবে)
মন্তব্য করুন