বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

কাশ্মীরিদের সামনে ভয়ঙ্কর সময়

কাশ্মীর টাইমসের সম্পাদক অনুরাধা ভাসিন বললেন

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম

অনুরাধা ভাসিন জামওয়াল। প্রখ্যাত সাংবাদিক ও শান্তিকর্মী। তিনি জম্মু ও কাশ্মীরের সবচেয়ে পুরনো ইংরেজি দৈনিক কাশ্মীর টাইমসের নির্বাহী সম্পাদক এবং সাহসী ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার জন্য পরিচিত। গত বছরের ৫ আগস্ট ভারত সরকার যখন কাশ্মীরের গণযোগাযোগের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করে, তখন তার ভাষায় ‘কার্যত অবরোধের’ বিরুদ্ধে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিলেন যারা, তাদের মধ্যে সবার আগে ছিলেন তিনিই। সাউথ এশিয়ান মনিটরকে দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাতকারে কাশ্মীরি জনসাধারণ কেমন দুর্যোগময় সময় অতিবাহিত করছেন এবং তাদেরকে কেন আগামী দিনগুলোতে আরো কঠিন পরিস্থিতির পড়তে হবে সে সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন।

প্রশ্ন : গত মাসে অবশেষে সুপ্রিম কোর্ট কাশ্মীরে যোগাযোগ অবরোধ নিয়ে আপনার পিটিশনের ওপর রায় দিয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় কতটা তাৎপর্যপ‚র্ণ?
মনে হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্ট কিছু গুরুত্বপ‚র্ণ নীতিমালা নির্ধারণ করেছে। এসব গুরুত্বপ‚র্ণ হওয়ার কারণ হলো, ইন্টারনেট সুবিধাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে সমুন্নত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র দীর্ঘ মেয়াদে জনগণের ওপর নির্বিচারে বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে না। আর তা যদি করতেই হয়, তবে সব কারণ প্রকাশ করতে হবে সাত দিনের মধ্যে। মামলাটির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিতে সুপ্রিম কোর্টের ৫ মাস সময় লেগেছে। আমরা পিটিশন দায়ের করেছিলাম ২০১৯ সালের ১০ আগস্ট, আর রায় হলো ২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি। রায় প্রদানের এক মাস হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো বাস্তবে কিছুই হয়নি। এখনো ইন্টারনেট পাওয়া যাচ্ছে খুবই বিধিনিষেধের আওতায়। এমনকি যখন পিটিশন দায়ের করতে যাই, তখনো ল্যান্ডলাইন কাজ করছিল না। আমি এমনকি শ্রীনগর থেকে আমার ব্যুরো চিফের কাছ থেকেও খবর পাই না। এসব কিছু কার্যত মিডিয়াকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।

প্রশ্ন : সুপ্রিম কোর্ট যদি ইন্টারনেট সুবিধাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করেই থাকে, তবে কেন এখনো কাশ্মীরে তা বন্ধই আছে?
দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইন্টারনেট ও গণযোগাযোগ সীমিত ও কৃত্রিম পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছে। এক দিন পাওয়া যায় ২জি, অন্য দিন থাকে বন্ধ। তৃতীয় দিন আবার কাজ করে। আমাদের আরেকটি আদালতের রায় প্রয়োজন। আদালত দীর্ঘ মেয়াদের কথা বলেছে। এই মেয়াদ কত দিন তা স্পষ্ট করা প্রয়োজন।

প্রশ্ন : অনেকে বলছে, সুপ্রিম কোর্টের ওপর যে আস্থা ছিল, তা নড়ে গেছে। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে নিচ্ছেন?
আমি রায়ের বিষয়গুলো বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছি। যখনই পড়ি, তখনই এতে ত্রæটি পাই। রায় দেয়ার এক মাস পরও পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় সুপ্রিম কোর্টের ওপর থাকা আস্থা নড়ে গেছে। কাশ্মীর নিয়ে দায়ের করা পিটিশনের শুনানির জন্য ছয় মাস অপেক্ষা করতে হয়। আবার অযোধ্যা পিটিশন, জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের ব্যাপারে ভিন্নভাবে রায় হয়েছে।
প্রশ্ন : আপনি একটি খ্যাতিমান পত্রিকার সম্পাদক। ইন্টারনেট প্রতিবন্ধকতা নিয়ে কিছু বলুন এবং কীভাবে তা আপনার কাজে সমস্যা করছে, তা জানাবেন?

আমি আদালতে গিয়েছিলাম সচেতনভাবেই। কাশ্মীরের ইতিহাস জানতাম, রাষ্ট্রের নৃশংসতা সম্পর্কেও ধারণা ছিল। আমি আমার সহকর্মীদের নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম। দীর্ঘমেয়াদি বিধিনিষেধ দুই ভাগে মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের ওপর প্রভাব ফেলছে। একটি হলো তাৎক্ষণিক। আমাদের হাত থেকে হাতিয়ার নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফলে আমরা বুঝতে পারছি না, কীভাবে কাজ করব। আমরা আধুনিক সময়ে বাস করছি, ১৯৯০-এর দশকের শুরুর সময়ে নয়। পুরো দেশে এসব সুবিধা থাকলেও কাশ্মীরে নেই। এর মানে হলো আমরা বঞ্চনার মধ্যে আছি। লোকজনকে কেবল শরীরিকভাবেই নয়, মানসিকভাবেও নির্যাতন করা হচ্ছে। ভারতের অন্যান্য নাগরিকদের জন্য ইন্টারনেট সুবিধা আছে। আর এখন যে সময়, তাতে করে ইন্টারনেট সুবিধা ছাড়া প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাতেও অংশ নেয়া যায় না। আর দীর্ঘ মেয়াদের জন্য ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হলে তা জনসাধরণের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ভয় ঢুকে যায়। কারণ নির্ভরযোগ্য তথ্য আসছে না। নির্ভরযোগ্য তথ্য তখন না আসে, তখন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ও শক্তি বাড়ে। রাষ্ট্র মনে করে যে, সে দায়বদ্ধ নয়। এটাই স্বাভাবিক। ভয় গভীরে ঢুকে যায়।

প্রশ্ন : জননিরাপত্তা আইনে (পিএসএ) আটজন সিনিয়র ভারতপন্থী নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ধরনের পদক্ষেপের পেছনে আরো বড় কোনো বিষয় আছে বলে কি আপনি মনে করেন?

প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে এই বলে এসব নেতার আটককে যৌক্তিক বলেছেন যে, তারা যা বলছিলেন তা গ্রহণযোগ্য ছিল না। এর মানে হলো, সরকার আইনের ঊর্ধ্বে। তারাই সিদ্ধান্ত নেবে কোনটা অগ্রহণযোগ্য ও সেটাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করবে। কাশ্মীরকে এর মাধ্যমে একটি বার্তা দেয়া হচ্ছে। সরকার তার নিজস্ব মুসলিমবিরোধী এজেন্ডা, ইসলামফোবিক এজেন্ডার কথা বলছে।

প্রশ্ন : কাশ্মীরি জনগণের সামনে কী অপেক্ষা করছে বলে আপনি মনে করেন?
ভয়াবহ সময়। অন্ধকার, চরম অন্ধকার সময়। আমি কোনো আশা দেখছি না। ৭০ বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে, কিন্তু কাশ্মীর এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। নেহরু ছিলেন উদার ও গণতন্ত্রী। কিন্তু তিনি কাশ্মীরের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেন। তিনি যেকোনো মূল্যে এটিকে মুঠোয় রাখতে চেয়েছিলেন। বিজেপি যখন ক্ষমতায় উঠতে শুরু করেছিল, তখন আমার আশা কমছিল। কারণ তারা আদর্শগতভাবেই মুসলিমবিরোধী। তারা মুসলিমদের ব্যাপারে উদ্ধত, তারা কাশ্মীরিদের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ। তারা কেবল কাশ্মীরকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নয়, এর জনসংখ্যার মর্যাদা পরিবর্তন করতে ও ধ্বংস করতে সবকিছুই করবে। মোদির দ্বিতীয় মেয়াদ যখন শুরু হলো, তখনই আমি জানতাম, কিছু একটা হচ্ছে। তবে তা এত দ্রæত ঘটবে তা বুঝতে পারিনি। বর্তমানে ভারতের উদার সমাজও কিছু বলে না। তারা কাশ্মীরে চলমান নৃশংসতা নিয়ে কথা বলতে ভয় পায়। কারণ তারা জানে, ভারতের জনসাধারণের মধ্যে তা চলবে না। এ কারণেই আমি কাশ্মীরিদের জন্য কোনো আশা দেখি না। বিশ্ব রাজনীতিতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন হলেই কেবল কাশ্মীর একটু ভালো থাকতে পারে।

প্রশ্ন : ভারতের রাজনীতি সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করেন?
ভারতের ভবিষ্যত ও এর রাজনীতি নিয়ে আমি সন্দিহান। উন্নয়ন নিয়ে বিজেপি তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে না পারা ও হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ ব্যাপকভাবে প্রদর্শন করা সত্তে¡ও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ ভয়ঙ্কর আশঙ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে একমাত্র যে ব্যাপারে কিছু আশা আছে, তা হলো সিএএবিরোধী বিক্ষোভ। কেবল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের মধ্যেই নয়, অন্যান্য বিশ্বাসের লোকজনও এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে।

প্রশ্ন : সরকার কাশ্মীরে নতুন রাজনৈতিক দলের জন্য জায়গা দেয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এসব দল কি কিছু করতে পারবে?
এটা আসলে সময় ক্ষেপণের বিষয় ও আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়কে (যেখানে মোদির ভাবমর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে) বিভ্রান্ত করা। কিছু কাশ্মীরি সম্পৃক্ত আছে, তা প্রদর্শন করে কিছু বৈধতা পাওয়ার চেষ্টা মাত্র এটি। কাজটি হলেই বিজেপি তাদেরকে ছুড়ে ফেলবে। বিজেপি ভারতকে যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে, তাতে আমি কাশ্মীরিদের জন্য কোনো কল্যাণমূলক কিছু দেখি না। বিজেপির লক্ষ্য ও এজেন্ডা পরিষ্কার। তারা রাজ্যের জনসংখ্যায় পরিবর্তন আনতে চায়, একজন হিন্দু মুখ্যমন্ত্রী চায়। এখন জম্মুর জনসাধারণ যদিও মনে করছে যে, তারা মুসলিম কাশ্মীরিদের বিপরীতে জাতীয় স্বার্থ কিছুটা রক্ষা করে চলেছে, কিন্তু বিশেষ করে গত দশকে তারা যে ধরনের রাজনীতি দেখেছে, তাতে করে যা ঘটছে, তা দেখে তারা অসন্তুষ্ট। কারণ লোকজন দুর্ভোগে রয়েছে। জম্মুর জনসাধারণ ডোমিসাইল অধিকার চায়, রাজ্যের মর্যাদার প্রত্যাবর্তন চায়। আমার মনে হয়, জম্মুতে বিজেপি তার নিজের জনসাধারণ তথা হিন্দুদেরও বিশ্বাস করে না।

আমি এ নিয়ে অনেক বিশ্লেষণ পড়েছি এবং তারা কীভাবে পরবর্তী বকশি গোলাম মোহাম্মদ (এই কাশ্মীরি রাজনীতিবিদ ১৯৫৩ সালে শেখ আবদুল্লাহকে গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ করার পর তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন) হিসেবে আলতাফ বুখারি ও মুজাফফর বেগকে দেখে তা পড়েছি। একটি বিষয় তারা ভুলে গেছে যে, নেহরু ও মোদির মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। সূত্র : সাউথ এশিয়ান মনিটর।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (6)
কাজী হাফিজ ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১:২৫ এএম says : 0
ধন্যবাদ আপনাকে সত্য কথা বলার জন্য্।
Total Reply(0)
জাহিদ খান ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১:২৬ এএম says : 0
ইনশায়াল্লাহ কাশ্মিরিদের সঙ্গে আল্লাহ আছেন।
Total Reply(0)
নাসিম ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১:২৬ এএম says : 0
কাশ্মিরিরা সংগ্রাম করতে জানে তাদের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই।
Total Reply(0)
সাকা চৌধুরী ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১:২৭ এএম says : 0
মুসলিম বিশ্বের প্রতি আহ্বান কাশ্মিরের নিরপরাধ মুসলিমদের পাশে দাঁড়ানো হোউক।
Total Reply(0)
রিদওয়ান বিবেক ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১:২৭ এএম says : 0
হে আল্লাহ তুমিই আমাদের রক্ষাকর্তা
Total Reply(0)
jack ali ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১১:৫৯ এএম says : 0
O' Allah liberate kasmir from Iblees modi government. Ameen
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন