মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ০৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

মহান একুশে সংখ্যা

হাছানকে বাঁচান

আরাফাত বিন আবু তাহের | প্রকাশের সময় : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:৩২ এএম

দিন দিন দুর্বলতা গ্রাস করছে হাছানকে। এখন আর আগের মত ওজনদার ও শক্ত বোঝা মাথায় নিয়ে টানতে পারে না। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে গেলে দুপুরের দিকে নাভিশ্বাস উঠে, তবুও বিশ্রাম নেওয়া নিষেধ। মালিকের বাঁধা ধরা নিয়ম। কাজ শেষ না হলে নিশ্বাস নেয়াও নিষেধ এমন অবস্থায় এক লহমা বসে শরীরটা জুড়াবে সে সাহস কারো নাই। মালিকের মিল ইন্ডাস্ট্রি দিন দিন বড় হয়ে ক্রমশ প্রধান সড়ক ছাপিয়ে উঠেছে। দক্ষিণ থেকে উত্তরে বেড়ে চলেছে অবিশ্রান্ত ভাবে। পাঁচ একরের উপর ফ্যাক্টরিতে হাছানের মত আরো পাঁচশ লোক কাজ করে। শ্রমিকদের পিঠের চামড়া উঠার, মাথার হাঁড় গুঁড়ো হওয়ার জোগাড়। বাকিরা অফিসার; লেভেল লাগিয়ে এসির নিচে ঠান্ডা রুমে বসে। তবুও সেখানে তারা হিসাব নিকাশে গলদঘর্ম!

মাথায় কত ইচ্ছের কথা খেলে যায় হাছানের! মুহূর্তে নিজের সাধ আহ্লাদ ইচ্ছেগুলাকে ছাপিয়ে ছোট বাচ্চাদের নানা বায়না দাবি দাওয়া চোখের উপর স্পষ্ট প্রশ্ন বোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়ায়। রাতে এক ফুরসতে যখন সবাই নাক ডেকে ঘুমায় তখন হাছানের বাড়ির কথা মনে পড়ে। আব্দুলাপুরে এসেছে নয় মাসের মত। অনেক দিন বাড়ি যায় না হাছান। বাড়ি গেলে পথের খরচ যেন পকেট কাটে। বাড়িতে বউয়ের হাতে কিছু টাকা দিয়ে দু’দিন পরে আবার আব্দুলাপুরের দিকে রওনা দিতে হলে বউয়ের কাছে হাত পাততে হয়। শরমে চোখ তুলে তাকান দায়। আম্বিয়া চ্যাঁচামেচি করে। হাতের এ সামান্য কটা টাকায় একত্রিশ দিনের মাসটির কিছুই হবে না। চাল কিনলে ডাল বাকি। সংসারের তেল, নুন, আটার টাকা বকেয়া জমেছে। নুরু মাঝির মুদি দোকানে বাকির টাকা জমতে জমতে টালি খাতার পাতা আর বাকি নাই, সব কটা শেষ। ও দিকে আর যাওয়া যায় না।

‘দেনা পরিশোধ না করলে বাকির নতুন পাতায় কলম যাবে না’, বলে দিয়েছে নুরু মাঝি।
ছেলে মেয়েদের নিয়ে কার কাছে হাত পাতবে! লজ্জায় কান কাটা যায়। জাকিরের মা সোয়া চার সের চাল পাওনা। টুকটাক আরো হাত খরচের নানা বৃত্তান্ত জমে পাহাড় হয়ে আছে। সেগুলো শোধ করতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। নাহলে কথার মারে শরীরের চামড়া খসে যাবে, মানির মান মাটিতে গড়াবে। এ সবের হিসাব করলে হাছানের আরো টাকা দেয়ার কথা। সেখানে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে যেতে টাকার জন্য হাত পাতা লাগে। করুণ অবস্থা চলে গেছে সহ্য সীমার বাইরে।

এসব মনে করে কখন যে হাছান স্মৃতিকাতর হয়ে কাঁদতে শুরু করে সে সম্বিত থাকে না। মাথার নিচে বালিশ ভিজে উঠেছে। নাকের ফ্যাঁসফেঁসানি শব্দে রহিম মিয়ার ঘুমে ব্যাঘাত হয়। লোকটা গুমরে উঠে। সারাদিনের খাটুনিতে হাঁটুর ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে কখন একটু চোখ লেগে আসছিল, এর মাঝেই হাছানের ফ্যাঁসফেঁসানি। বিরক্ত রহিম মিয়া মুখ খুলে চামড়া ছিঁড়ে নেয়। অশ্রাব্য ভাষায় হাছানের বাপান্ত করে ছাড়ে। লোকটা জানোয়ার না হলেও রাতের ঘুমে ব্যাঘাত হলে অন্ধকারেও সে বন্য কেউ যেন। রহিম মিয়া হুংকার দিয়ে আরো দু’জনের ঘুম ভাঙায়। পরে তাদের কাছে জবাবদিহি করতে করতে রহিম মিয়ার নিজেরও মাথা কুটে যায়।

-’মিয়া তুমি চিল্লাইলা কেন? হাছান তো চুপচাপ ছিল। তোমারে কামড়াইছে নাকি’।
রহিম মিয়া নাজেহাল হতে থাকলে বিপর্যস্ত হাছানকে এবার বিব্রতও হতে হয়। মনে হয় এটাও তার অপকর্ম। রহিম মিয়ার ঘুম না ভাঙ্গলে তো আর এতটা ঘটত না।

সময় যেতে থাকে। আজহার শব্দ করে জানালো, -’কাল কিন্তু কাম করতে অইব, কামড়াকামড়ি বন্ধ কর হগলে। এবার ঘুমা’।

কথাটা মন্ত্রের মত কাজ করে। আঁধারে প্রত্যেকের দেমাগে ঢুকে যায় আজহারের অমীয় বাণীটি। খুঁজে নেয় উগ্র-উদগ্র সবার শ্রান্ত ক্লান্ত দেহের অশান্ত বিবেচনাকে। ধীরে ধীরে অন্ধকারে রুমের উত্তাপও কমতে থাকে। শ্রান্ত ক্লান্ত শ্রমিকদের মেজাজ কখন ধপ করে জ্বলে উঠে আবার কখন নেতিয়ে পড়ে ঠিক নেই।
হাছানের সাথের অনেকে বছরের পর বছর বাড়ি যায় না। বাড়ি কোন দিকে এটা ভুলে না কেউই। কিন্তু হাতে টান থাকে। বাড়ির বউপোলা না খেয়ে মরছে। এর মাঝে গাড়ি ভাড়া দিয়ে বাড়ি যাওয়ার মানে হয় না। এদিকে অল্প বেতনে বাড়তি পরিশ্রম করে শ্রমিকদের শরীর শেষ। এরপরও গত সপ্তাহে রহিম-হাছানরা ম্যানেজারকে ধরেছিল। ওভারটাইম করলে কিছু মাইনে বাড়তি পাওয়া যায়। আলাওল হামিদরা এই করে কিছু বাড়তি পায়। হাছানের শরীর সায় দেয় না। তবুও সে এরাদা করে। আম্বিয়া, ছেলে-মেয়েদের অভুক্ত দুঃখী মুখ মনে পড়লে অশান্ত হয়ে উঠে লোকটা। গেল বার বাড়িতে আম্বিয়ার চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে কান ঝালাপালা হয়ে গিয়েছিল হাছানের। তবুও তাকে দোষ দিতে পারে না। সেও বুঝে। বাড়ন্ত তিনটা বাচ্চাকে নিয়ে দিন পার করতে গিয়ে আম্বিয়া যে প্রায় তেল সাবান ছাড়া দিন কাটায়, উনপেটে দিন গুজরান করে তা জানে হাছান।

অসুস্থ অবসন্ন শরীরে নুরু মাঝির দোকানের কথা খেয়াল হল। সেখানে দিনের পর দিন একটা খাতা মোটা হয়ে উঠেছে। হয়ত পাতা উল্টানো বন্ধ এখন। সে দোকানে আর বাকি চাইতে যায় না আম্বিয়া। যাওয়ার উপায় নেই। নুরু মাঝি বকেয়া পরিশোধের কথা তোলে। ভর দোকানে অপমান করে ছাড়ে। ভারী মালের বস্তা নিয়ে টানাটানি করতেই পরের ধাপের লেবার চলে এল। কাল রাতে ঘুমের ডিস্টার্ব করায় রহিম মিয়া চ্যাঁচামেচি করলেও দিনের বেলায় সে শান্ত। সবাই পরিশ্রান্ত। সে হাছানকে বলল, ‘দেখতেছি শরীর তোমার ভালো ঠেকছে না ভাইডি’।

হাছান বলার মত কিছু পায় না। বস্তার এক প্রান্তে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে রহিম মিয়া এসে আরেক প্রান্ত তুলে ধরে। মাথা পেতে বস্তা ধরে হাছান। মাথা পেতে শাস্তি বওয়ার মত অবস্থা। নাহলে উপায় অন্ত নাই। গাড়ি লোডের জায়গার ওখানে টেবিল পেতে আছে কেরানি একজন। প্রত্যেকের মাথা গুনে রাখে সে। গোনায় এক বস্তা মালও এদিক সেদিক হয় না। কে কয়টা আনল তার উপর ওভার টাইমের হিসাব। সময় কাটিয়ে ঘুরলে হবে না। কাজের বোঝাপড়া আছে এটা সবাই জানে। রোজার দিন, যে কয়জন রোজা আছে সবার জিব বের হয়ে আসছে। সলিম-আজাদরা রোজা নাই। কিন্তু রহিম মিয়া, হাছান সহ অনেকেই রোজা ভাঙতে পারে না। খালি পেটে কাজ করাও দায়। তবুও মাথায় সাজার বোঝা টানতে হয়। সংসারের ভার অসহ্যকর হয়ে উঠে হাছানের। তিনটা বাচ্চার সরল মুখ ভেসে উঠলে আবার কাজে মন দেয়। যতটুকু করে হাছান তা মনের জোরেই। উঠতি বাচ্চাদের মুখ পাখির ছানাদের মত। যত দিই ততই লাগে। নিজ বাচ্চাদের কথা এভাবে ভেবে ভেতরে ভেতরে লজ্জা পায়। এতটা অধম বাপ সে! নিষ্পাপ শিশুদের চারটা খাবার নিয়ে- দু’বেলার দু’মুঠো অন্ন নিয়ে তার মনে এ হারামি ভাবনা কেমনে খেলে গেল! প্রথমে নিজের সাথে লজ্জা কাটিয়ে উঠে, পরে দুঃখে নিমজ্জিত হয়। এ দুঃখ থেকে বাঁচানোর জন্য তার কেউ নেই। আম্বিয়ার মুখ স্মরণ করে। এখনো অল্প বয়স। এ বয়সেই সংসার সংসার করে না খেয়ে না পরে দেহশ্রী হারিয়ে পৌঢ় মহিলা হয়ে গেছে বেচারি।

রাতে শ্বাস উঠে হাছানের। আগের রোগ সুযোগ পেলেই মাথাচাড়া দিয়ে গিলে খেতে চায়। হাছানের কিছু করার থাকে না। ঘামে পুরো শরীর ভিজে গেছে। খাটিয়ার ছেঁড়া তোশকও ভিজে উঠে এক সময়। শরীর নিঃসাড় নির্জীব হয়ে এলে সলিমের নজর পড়ে। এগিয়ে এসে পাশে বসে, ‘এভাবে কত বলেছি তোর ওভারটাইমের দরকার নাই। শরীর আর আছে’?

সবাই অশিক্ষিত মজুর। অর্থাভাবে অর্ধাহারে জীর্ণ পরিবেশে জীবন সম্পর্কে উদাসীন। হাছান মাঝে মাঝেই পড়ে যেত। এ নিয়ে তাই কারো তেমন আগ্রহ নাই। তাছাড়া কে কাকে নিয়ে ভাববে। ফুরসত কই? কাত হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রামই সবার কাছে অদৃশ্য অমৃত।

ফ্যাক্টরি বন্ধের নাম নেই। দিন রাত পালাক্রমে শ্রমিক আসে, শিফট পাল্টে অফিসাররা অফিস করে। সাথের শ্রমিকদের বাড়তি আয় দেখে লোভে পড়ে হাছান। দেখাদেখি সেও ওভারটাইম করতে গিয়ে বিপদে পড়ে গেল। লোড সামলাতে পারে না। তবুও রোগা শরীরে উন্মাদনা ভর করেছিল। সন্তানদের মুখে হাসি ফোটাতে গিয়ে অতিরিক্ত শ্রমের কারণে ভেঙে পড়ে শরীর। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগে ফ্লোরে ধপাস করে পড়ে যায় শাকিলের বাবা। আগের সে হাছান আর নেই। সেই ডাঙার উপর মাটি কাটা শ্রম, পানি ঘোলা করে মাছ ধরা সময়; কোথায় শরীরের সেই ধার? বিস্মিত হাছানকে অর্ধ-অচেতন অবস্থায় রহিম সলিমরা প্রথমে ফ্যাক্টরির প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রে নেয়। সেখানে দুই ঘন্টা শরীর টিপেটুপে ডাক্তার মাথা নাড়ে। পরে বড় হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয় ম্যানেজার। এ শরীর আর সারার নয়।

বাড়িতে কেঁদে কেটে গভীর রাতে অভুক্ত বাচারা ঘুমিয়ে পড়েছে। আম্বিয়া কী করবে বুঝতে পারে না। হাছন মিয়ার খবর নেই। কারোর কাছ থেকে ধার করজ করবে সে সাহস অবশিষ্ট নেই আম্বিয়ার। দুই মাইল দ‚রে এক ভাইয়ের বাড়ি। খেয়ে পরে ভালই দিন কাটায় তারা। দজ্জাল বউয়ের কারণে বোনের খবর নেয়ার সাহস হয় না ভাইয়ের। সে দিকের পথ মাড়ানো যে বৃথা সেটা আম্বিয়া জানে। বাহারের বউ পাঁচ শ টাকা পাবে। সেদিকেও মুখ দেয়া যায় না। নিরুপায় মা শীতল চোখে ছেলের ঠান্ডা স্পন্দিত শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকে।

ছোট ভাইয়ের আহাজারি দেখে শাকিল থমকে গেছে। সে মাত্র আট বছরের শিশু তবুও সংসারের বড় ছেলে বলে কথা। দুঃখে দুঃখিত জননীর মুখের দিকে তাকাতে পারে না শাকিল। ছোট মেয়েটা ভাইয়ের সাথে সামান্য এ্যাঁ এ্যাঁ করে ঠান্ডা হয়ে গেছে।

নিশুতি রাত। বাচ্চারা বেঘোর ঘুমে। মাঝ রাতে বাড়ির বড় অশ্বত্থের মাথায় পেঁচা ডাকে। খেতে ইঁদুরের দাপাদাপি স্পষ্ট। ঘরের ছোট খোপের মত খোলা জানালার আচানক অন্ধকারে চোখ স্থির করে বসে থাকে আম্বিয়া।

রাত পোহাতে চায় না আর। অবুঝদের বুঝ দেওয়ার মতও কিছুই নেই আম্বিয়ার হাতে।
বড় নিঃশ্বাস ফেলে কাত হয়ে যায় দুঃখিত জননী।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন