শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

পরীক্ষা ছাড়াই অভ্যন্তরীণ নৌযান সার্ভে-নিবন্ধন!

তিন দপ্তরে মাসিক লেনদেন কোটি টাকা

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০০ এএম

ঘুষের টাকাসহ নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের উচ্চপদস্থ তিন কর্মকর্তাকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গ্রেফতার করার পরও এই সংস্থায় অবৈধ অর্থ লেনদেন বন্ধ হয়নি। অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ, খুলনা ও বরিশাল কার্যালয়ে অভ্যন্তরীণ নৌযানের সার্ভে (ফিটনেস পরীক্ষা) ও নিবন্ধনে ব্যাপক অনিয়ম করা হচ্ছে বলে এক জাহাজ মালিকের সাবেক ব্যবস্থাপক মো. এনামুল হক নৌ-প্রতিমন্ত্রী, নৌ-মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ও নৌ-অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ দুদক চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সবক’টি কর্মদিবসে কর্মস্থলে উপস্থিত না থেকেও নিয়ম লঙ্ঘন করে কাগজে-কলমে নৌযান সার্ভে করছেন। এভাবে সার্ভে-নিবন্ধনের কারণে নৌ-নিরাপত্তা হুমকির মুখে রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর চিফ ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড শিপ সার্ভেয়ার মো. মনজুরুল কবীর ইনকিলাবকে বলেন, কোনো অনিয়ম দুর্নীতি হয়ে থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। জাহাজ মালিকের সাবেক ব্যবস্থাপক মো. এনামুল হকের লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, অধিদপ্তরের ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড শিপ সার্ভেয়ার নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের মো. শাহরিয়ার হোসেন, খুলনা কার্যালয়ের মাহবুবুর রশীদ মুন্না ও বরিশাল কার্যালয়ের আবু হেলাল সিদ্দীকি নতুন নৌযান নিবন্ধন এবং পুরনো নৌযান বার্ষিক সার্ভের সময় সংশ্লিষ্ট সার্ভেয়ারদের নির্দিষ্ট অংকের টাকা না দিলে নানা রকম হয়রানির শিকার হতে হয়। তবে দালাল মারফত আগেভাগে টাকা পরিশোধ করলে নৌযান পরিদর্শন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই নিবন্ধন ও সার্ভে সনদ দিয়ে থাকেন সার্ভেয়াররা। এসব অনিয়মের মাধ্যমে এই তিন কার্যালয়ের তিন কর্মকর্তা প্রতিমাসে প্রায় এক কোটি টাকা আয় করছেন। এদের মধ্যে খুলনার সার্ভেয়ার সপ্তাহে মাত্র তিনদিন কর্মস্থলে থাকলেও প্রতিমাসে ৬০০ এবং নারায়ণগঞ্জের সার্ভেয়ার প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৩-৪ ঘণ্টা কর্মস্থলে থেকেই মাসে অন্তত ৩০০ নৌযান সার্ভে ও নিবন্ধন করছেন। এছাড়া বরিশালের সার্ভেয়ার আবু হেলাল সিদ্দীকিও নিয়মিত কর্মস্থলে উপস্থিত না থেকে একইভাবে অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে প্রতিমাসে ৩০০ নৌযান সার্ভে ও নিবন্ধন করছেন এবং দালাল মারফত অর্থ লেনদেন করে আসছেন। তিনি নৌ অধিদপ্তরের স্থায়ী কর্মকর্তা নন, তাকে প্রায় দুই বছর আগে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি) থেকে সংযুক্তিতে এখানে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম ফখরুল ইসলামকে ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই ৫ লাখ টাকাসহ তার দপ্তর থেকে, সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী ড. এস এম নাজমুল হককে ২০১৮ সালের ১২ এপ্রিল ৫ লাখ টাকাসহ রাজধানীর সেগুনবাগিচার একটি হোটেল থেকে এবং ঢাকা (সদরঘাট) কার্যালয়ের শিপ সার্ভেয়ার মীর্জা সাইফুর রহমানকে ২ লাখ টাকসহ মতিঝিল প্রধান কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করে দুদক। দীর্ঘ কারাবাসের পর তারা জামিনে মুক্তি পেলেও গ্রেফতারের পর থেকেই সাময়িক বরখাস্ত রয়েছেন তারা।

এনামুল হকের অভিযোগে বলা হয়, খুলনার সার্ভেয়ার মাহবুবুর রশীদ মুন্নার পরিবার ঢাকায় থাকার কারণে তিনি সপ্তাহের ৪ দিনই ঢাকায় অবস্থান করেন। অথচ তিনি দৈনিক গড়ে ২০টি নৌযান সার্ভে ও নিবন্ধন করছেন। যদিও অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী একজন সার্ভেয়ার দিনে সর্বোচ্চ ১০টি নৌযান সার্ভে করতে পারবেন। নৌযানের আয়তন ও শ্রেণিভেদে প্রতি নৌযান নিবন্ধন বাবদ এক লাখ থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকেন। আর সার্ভে বাবদ নেন ৩০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত। মুন্নাকে এসব কাজে সহায়তা করছেন অধিদপ্তরের সাবেক এক কর্মকর্তা, যিনি দুদকের হাতে গ্রেফতারের পর বরখাস্ত অবস্থায় আছেন। মুন্না ও এই কর্মকর্তা মিলে রাজধানীর বনশ্রী আবাসিক প্রকল্পের আফতাব নগরে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে কাগজে-কলমে সার্ভে-নিবন্ধনের কারবার চালাচ্ছেন। এভাবে তারা দু’জন প্রতিমাসে নিবন্ধন ও সার্ভে মিলিয়ে ৫০ লাখ আয় করছেন।

অভিযোগ বলা হয়, বরখাস্ত হওয়া এই কর্মকর্তারা বরিশালের সার্ভেয়ার আবু হেলাল সিদ্দীকিকেও একইভাবে সহায়তা করছেন। এই সার্ভেয়ারও সপ্তাহে তিন-চারদিন ঢাকায় অবস্থান করে প্রতিমাসে তিন শতাধিক নৌযান সার্ভে ও নিবন্ধন করছেন। তিনিও প্রতি নৌযান নিবন্ধন বাবদ ১ লাখ থেকে দু’লাখ এবং প্রতি নৌযান সার্ভে বাবদ ২৫ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিচ্ছেন। এভাবে তিনি প্রতিমাসে অবৈধভাবে অন্তত ২৫ লাখ টাকা আয় করছেন। নারায়ণগঞ্জের সার্ভেয়ার শাহরিয়ার হোসেনের পরিবারও ঢাকায় থাকে। তিনি ঢাকা থেকেই প্রতিদিন কর্মস্থলে যান। এই কর্মকর্তা একদিনও দুপুর ২টার আগে সেখানে যান না এবং বিকেল ৫টার পরপরই কর্মস্থল ত্যাগ করেন। তবে তিনিও প্রতিদিন গড়ে ১০টি নৌযান সার্ভে ও নিবন্ধন করছেন। মাস শেষে এই সংখ্যা হয় ৩০০। শাহরিয়ার হোসেনকে এসব কাজে সহযোগিতা করেন দেড় বছর আগে অবসরে যাওয়া অধিদপ্তরের এক শিপ সার্ভেয়ার। অবসর গ্রহণের পর এই কর্মকর্তা ঢাকার মতিঝিল এলাকায় একটি অফিস ভাড়া নিয়েছেন। যেখানে বসে তিনি মালিকপক্ষের কাছ থেকে সার্ভে ও নিবন্ধনের জন্য নৌযানের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করেন। এরপর নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের পিয়ন মামুনুর রহমান প্রতিদিন বিকেলে এসে সেসব কাগজপত্র নিয়ে যান এবং সার্ভেয়ার শাহরিয়ার পরেরদিন দপ্তরে বসে সেসব কাগজে স্বাক্ষর করেন।

নারায়ণগঞ্জের শিপ সার্ভেয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়, মালিক নৌযান সার্ভে ও নিবন্ধনের জন্য দালালের কাছে না গিয়ে সরাসরি কার্যালয়ে গিয়ে আবেদন করেন। সেসব নৌযানও তিনি নিজে পরিদর্শন করেন না। বিশ্বস্ত পিয়ন মামুনুর রহমান ওইসব নৌযান মাপ-জোক করে ছবি তুলে আনেন। মালিকের কাছ থেকে অঘোষিত নিয়মমাফিক নির্দিষ্ট অংকের টাকাও নেন মামুন। এরপর সার্ভেয়ার নিজ দপ্তরে বসে সার্ভে-নিবন্ধন সনদ দিয়ে দেন। শাহরিয়ার হোসেনও প্রতি নৌযান সার্ভে বাবদ ৩০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা এবং নিবন্ধনের জন্য ১ লাখ থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকেন। এভাবে তিনি মাসে অন্তত ২৫ লাখ টাকা আয় করছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।

এ বিষয়ে খুলনার সার্ভেয়ার মাহবুবুর রশীদ মুন্না ইনকিলাবকে বলেন, আমি ঢাকা ও খুলনায় কাজ করছি। তবে পরীক্ষার বিষয়ে আমি কিছু বলতে পরব না। নারায়ণগঞ্জের সার্ভেয়ার শাহরিয়ার হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, আমি অফিসে আমার দায়িত্ব ছাড়া অন্য কোন কাজ করি না। আর আমার পরীক্ষা নেয়ার দায়িত্ব নেই।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন