বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

পাঁচ কারণে সালমান শাহ’র আত্মহত্যা

তদন্ত-পরবর্তী পিবিআইয়ের সংবাদ সম্মেলন

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম

দীর্ঘ ২৪ বছর পর নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সালমান শাহ’র মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করতে পেরেছে আইন-শৃংখলা বাহিনী। হত্যা না আত্মহত্যা তার মৃত্যু নিয়ে প্রায় আড়াই দশক ধরে এমন জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) বলছে, আত্মহত্যাই করেছিলেন সালমান শাহ। প্রতিবেদনে তার আত্মহত্যার পেছনে পাঁচটি কারণও তুলে ধরেছে সংস্থাটি। গতকাল সোমবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআই সদর দফতরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার এ বিষয়ে প্রায় ৬০০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন তুলে ধরেন। এ সময় তিনি বলেন, দীর্ঘ তদন্তের পর সংস্থাটি সালমান শাহের আত্মহত্যার পেছনে ৫টি কারণ উল্লেখ করেছে। কারণগুলো হলো- চিত্রনায়িকা শাবনূরের সঙ্গে তার অতিরিক্ত অন্তরঙ্গতা। স্ত্রী সামিরার সঙ্গে দাম্পত্য কলহ। বেশি আবেগপ্রবণ হওয়ার কারণে একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা। মায়ের প্রতি অসীম ভালোবাসা, যা জটিল সম্পর্কের বেড়াজাল তৈরি করে অভিমানে রূপ নেয়া এবং সন্তান না হওয়ায় দাম্পত্য জীবনে অপূর্ণতা।
সামিরার বরাত দিয়ে পিবিআই প্রধান বলেন, শাবনূরকে বিয়ে করে সালমান শাহ দুই স্ত্রী নিয়ে সংসার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সামিরা রাজি ছিলেন না। এখান থেকেই পারিবারিক দম্পত্যের কলহ শুরু হয়। তা ছাড়া আগে থেকেই সামিরার সঙ্গে সালমানের মায়ের ঝগড়া-বিবাদের ফলে সালমান শাহ ১৯৯১ সালে দুই বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। সেসময় সালমান শাহ একবার ৯০টি ঘুমের ট্যাবলেট খেয়েছিলেন এবং একবার স্যাভলন খেয়েছিলেন।
তবে সালমান শাহ’র সঙ্গে অতিরিক্ত অন্তরঙ্গ সম্পর্কের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন শাবনুর। এই চিত্রনায়িকার বরাত দিয়ে পিবিআই প্রধান বলেন, একজন অভিনয় শিল্পী হিসেবে সহযোগী শিল্পীর সঙ্গে যেমন সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন, সালমান শাহ’র সঙ্গে তার তেমন সম্পর্কই ছিল। এর বাইরে কোনো সম্পর্ক ছিল না। ১০ সাক্ষীর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি পর্যালোচনা করে এবং ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন এবং সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকসহ সবার মতামত বিশ্লেষণ করে প্রমাণ পাওয়া যায়, সালমান শাহ খুন হননি। তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
বনজ কুমার জানান, পিবিআই তাদের তদন্তের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় বিবেচনা করেছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রথম ও দ্বিতীয় সুরতহাল প্রতিবেদন, প্রথম ও দ্বিতীয় ভিসেরা প্রতিবেদন, কেমিক্যাল প্রতিবেদন, প্রথম ও দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, বিশেষ মেডিকেল বোর্ডের মতামত, হস্তলিপি বিশারদের মতামত, ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও ভবনে প্রবেশ ও বের হওয়া সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞের মতামত। এছাড়া রিজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ ও জরিনা বেগমের অডিও রেকর্ড, সাক্ষীদের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দি, ঘটনা সংশ্লিষ্ট সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রেকর্ড করা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় দেয়া জবানবন্দি, জব্দ করা আলামত পর্যালোচনা, আগের তদন্ত প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনা এবং বিভিন্ন দালিলিক সাক্ষ্য, পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য, কাগজপত্র ও অন্যান্য সাক্ষ্য পর্যালোচনার বিষয়গুলোও পিবিআইয়ের তদন্তে বিবেচনা করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনের এক পর্যায়ে সালমান শাহ মৃত্যুর ঘটনাপ্রবাহ আকা ছবির মাধ্যমে তুলে ধরে পিবিআই।
এতে দেখানো হয়, ঘটনার শুরুতে ডাবিং থিয়েটারে সালমান ও শাবনূরকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে রাগ করে বেরিয়ে যান স্ত্রী সামিরা। ঘটনার আগের রাত সাড়ে ১১টায় সালমানের সেলফোনে চিত্রনায়িকা শাবনূরের কাছ থেকে ফোন আসে। এ সময় সালমান শাহ কথা বলতে বলতে বাথরুমে ঢুকে যায়। বাথরুমে গিয়ে সালমান শাহ চিৎকার করে বলছিলেন যে, তাকে যেনো আর ফোন না দেওয়া হয়। এরপর রাত ১২টার দিকে তার মোবাইলে আবারও কল দেন শাবনূর। এ সময় সামিরা রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার উদ্দেশে নিচতলার লবিতে চলে যান। লবিতে সালমানের ব্যক্তিগত সহকারী আবুল হোসেন খান বাসায় ফিরিয়ে আনার জন্য সামিরাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। সামিরা বাসায় ফিরে কান্নাকাটি করতে থাকেন। রাত অনুমান সোয়া ১২টার দিকে শাবনূরের মোবাইল থেকে আবারও কল আসে। শাবনূরের কল এসেছে দেখতে পেয়ে সালমান শাহ রাগে সিটিসেল মোবাইলটি মেঝেতে আছাড় দিয়ে ভেঙ্গে ফেলেন। এছাড়া শাবনূরের উপহার দেওয়া ফোনটিও ভেঙ্গে ফেলেন। পর দিন সালমান শাহ বাসার কাজের সাহায্যকারী মনোয়ারা ভাঙ্গা মোবাইলটি ময়লার ঝুড়িতে রেখে দেয়। এরপর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সালমানের বাবা কমর উদ্দিন আহমদ চৌধুরী বাসায় আসেন। এ সময় সামিরা তার শ্বশুরকে চা-নাস্তা খেতে দেন।
ঘটনার দিন সকালে সালমান শাহ ঘুম থেকে উঠে কিচেন রুমে কাজে সাহায্যকারী মনোয়ারার কাছে পানি চান। মনোয়ারা এক মগ পানি দেন। সালমান শাহ পানি পান করে আরও এক মগ পানি চেয়ে পান করেন। পরে মালি জাকির কলিংবেল বাজায়। সালমান নিজেই দরজা খুলে দেন। এসময় জাকির সালমান শাহের কাছে তিন মাসের বকেয়া বেতন চান। কিন্তু কোনো কথা না বলে ভেতরে চলে যান। পরে সালমান শাহ দারোয়ান দেলোয়ারকে ইন্টারকমে ফোন করে বলেন, তার বাসায় যেনো কাউকে আসতে দেয়া না হয়। এরপর বেডরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে স্ত্রী সামিরার দিকে একদৃষ্টিতে কিছু সময় তাকিয়ে ছিলেন। সামিরা তখন বিছানায় শোয়া অবস্থান টিভি দেখছিলেন। সামিরা তখন সালমানকে জিজ্ঞাসা করে, কী দেখছো? সালমান শাহ কোনো কিছু না বলে বাথরুমে চলে যান। সেখান থেকে বের হয়ে তিনি ড্রেসিং রুমে চলে যান এবং ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেন। এ সময় কাজের সাহায্যকারী ডলি তার ছেলে ওমরকে বাথরুম থেকে গোসল করিয়ে বের হয়। ওমরের কাপড়-চোপর ড্রেসিং রুমের ভেতরে থাকায় ওমর ও তার মা ডলি দরজা নক করেন। দরজা না খোলায় ওমর বাইর থেকে বার বার ডাকতে থাকে। ওমর ও ডলি ডাকার পরেও দরজা না খোলায় বিষয়টি সামিরাকে জানালে সামিরা ড্রেসিং রুমের চাবি এনে দরজা খোলে। তখন ওমর, ডলি, মনোয়ারা ও আবুল দরজার সামনে উপস্থিত ছিলো।
এতে আরো বলা হয়, ড্রেসিং রুমের দরজা খুলে সালমান শাহকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পায়। এ সময় সামিরা চিৎকার দিয়ে সালমান শাহকে নিচ থেকে উঁচু করে ধরে। তাকে আবুল ও মনোয়ারা সহায়তা করে। ডলি রান্না ঘর থেকে বটি এনে অ্যালুমিনিয়ামের মই বেয়ে ওপরে উঠে ফাঁসের রশি কেটে দেয়। বেলা অনুমান সাড়ে ১১টার দিকে সালমান শাহকে ধরাধরি করে পাশের বেডরুমে শোয়ানো হয়। সামিরা মাথায় পানি দেয়, ডলি ও মনোয়ারা তেল গরম করে সালমানের বুকে, হাতে ও পায়ে মালিশ করে। খবর পেয়ে দারোয়ান দেলোয়ার সালমান শাহ ফ্ল্যাটে ছুটে আসে। এরপর সালমানের বাবা, মা ও ভাইসহ অন্যান্য স্বজনরা ছুটে আসেন। তাকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নেয়া হয়। হলি ফ্যামিলি থেকে সালমান শাহকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মারা যান চলচ্চিত্র নায়ক চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার ইমন ওরফে সালমান শাহ। েেস সময় এ বিষয়ে অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেছিলেন তার বাবা প্রয়াত কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী। এরপর ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ এনে মামলাটিকে হত্যা মামলায় রূপান্তরিত করার আবেদন জানান তিনি। ওই সময় অপমৃত্যুর মামলার সঙ্গে হত্যাকান্ডের অভিযোগের বিষয়টি একসঙ্গে তদন্ত করতে থানা পুলিশের পরিবর্তে সিআইডিকে নির্দেশ দেন আদালত। এরই মধ্যে তার মৃত্যুর ২৩ বছর পেরিয়ে গেছে। দীর্ঘ সময়েও চিত্রনায়কের মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করা যায়নি। এর মাঝে কয়েক দফা তদন্তে সালমানের মৃত্যুকে আত্মহত্যা উল্লেখ করে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। তবে তা বরাবরই নাকচ করেছেন সালমানের মা নীলা চৌধুরী। এ অবস্থায় ২০১৬ সালের শেষ দিকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নতুন করে এ মামলার তদন্তভার দেওয়া হয়। এর সূত্র ধরেই গতকাল সোমবার তদন্ত প্রতিবেদন বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে পিবিআই।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন