বন্ধুপ্রতীম দেশ ভারত, ল্যাটিন আমেরিকার ব্রাজিল, ইউরোপের তুরস্কের মতো দেশ দীর্ঘদিন ধরে যে মধ্য আয়ের ফাঁদে আটকে আছে; বাংলাদেশ যাতে একই পথের পথিক না হয়, সরকারকে তার একটি সতর্কবার্তা দিল পরিকল্পনা কমিশন। আগামী ২০৪১ সালে বাংলাদেশের উচ্চ আয়ের দেশে যাওয়ার পথে মধ্য আয়ের ফাঁদ যাতে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে সেজন্য নীতি প্রণেতাদের সজাগ ও সতর্ক থাকার তাগিদ দেওয়া হয়েছে গতকাল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভায় অনুমোদন পাওয়া দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় (২০২১-২০৪১)। কমিশন বলছে, একটি দ্রুত বর্ধনশীল উন্নয়নগামী অর্থনীতির জন্য মধ্য আয় কোনো গন্তব্য হতে পারে না। বরং দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে এই মধ্য আয় ফাঁদ। মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) এনইসি সভায় অনুমোদন পেয়েছে উচ্চ আয়ের দেশে যাওয়ার পথনকশা প্রেক্ষিত পরিকল্পনা। ২০ বছর মেয়াদি এই পথনকশার ওপর ভিত্তি করে দেশে মোট চারটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে সরকার। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভাপতিত্ব করেন। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সাংবাদিকদের বলেন, ২০৪১ সালে আমরা বাংলাদেশকে কোথায় দেখতে চাই; ‘রূপকল্প ২০৪১’ সেসব বিষয় বলা আছে। তিনি বলেন, রূপকল্প ২০৪১ চারটি প্রাতিষ্ঠানিক স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আমরা বিশ্বাস করি, প্রবৃদ্ধি ও রূপান্তরের প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে জনগণ সম্মিলিতভাবে সুশাসন, গণতন্ত্রয়ান, বিকেন্দ্রীকরণ ও সক্ষমতা বিনির্মাণ এই চারটি প্রাতিষ্ঠানিক স্তম্ভ রক্ষণাবেক্ষণ করবে।
রূপকল্প ২০৪১ এ জোর দেওয়া হয়েছেÑগণতন্ত্র ও গণতন্ত্রয়ানে। তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন একটি বহুত্ববাদি পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের কথাও বলা আছে প্রেক্ষিত পরিকল্পনায়। ২০৪১ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি কোথায় থাকবে তার একটি প্রক্ষেপণ করা হয়েছে দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনায়। যেখানে আগামী ২০ বছর পর বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ৯ শতাংশ অর্জিত হওয়ার প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। তবে পরিকল্পনা কমিশনের আশঙ্কা, যদি কোনো কারণ এই দ্রুতগতি অর্থনীতিকে ব্যাহত করে তবে সেটি হতে পারে মধ্য আয় ফাঁদের সূত্রপাত। যা উচ্চ আয়ের মর্যাদা অর্জকে দেরি করবে। সরকারকে সর্তক করে দিয়ে প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ যদি প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় ব্যর্থ হয়, উদ্ভাবন ও আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, বাংলাদেশ যদি মানসম্মত প্রস্তুত করা পণ্য রপ্তানিতে নি¤œ মজুরি প্রতিযোগিদের সঙ্গে প্রতিযোগিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে না পারে তবে মধ্য আয়ের ফাঁদে আটকে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল হবে বাংলাদেশের জন্য। মালয়েশিয়ার উদাহরণ টেনে কমিশন বলেছে, দেশটি খুব শিগগিরই ১২ হাজার ৫০০ ডলারের মাথাপিছু আয় নিয়ে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নত দেশ হতে যাচ্ছে। কারণ, দেশটিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা, শক্তিমত্তা এবং স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা সুফল নিয়ে এসেছে। অথচ থাইল্যান্ড বহু বছর ধরে মধ্য আয়ের ফাঁদে পড়ে আছে। কারণ, দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। রপ্তানি প্রবণতায়ও মন্দা। অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালন দক্ষতা অত্যন্ত দুর্বল। বাংলাদেশ সরকার বিষয়টি যাতে হালকাভাবে না নেয় সেই সতর্কবাণী দেওয়া হয়েছে প্রেক্ষিত পরিকল্পনায়।
এনইসি সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারের মহেশখালি উপজেলায় সোনাদিয়া এলাকায় ইকোট্যুরিজম গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বৃতি দিয়ে মন্ত্রী বলেন, সেখানে গভীর সমুদ্র বন্দর করলে ইকোলজিতে আঘাত আসতে পারে। সমুদ্র বন্দর অন্য কোথাও হতে পারে। সোনাদিয়া অত্যন্ত সুন্দর জায়গা সেখানকার জীববৈচিত্র্য রক্ষার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তাহলে কি সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ থেকে সরে আসল সরকার? এমন প্রশ্নে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদেরকে বলেছেন, সোনাদিয়াকে অক্ষত রেখে সেখানে ইকোট্যুরিজম করার।
আগামী ২০৪১ সালে বাংলাদেশ কোথায় থাকবে তার পথনকশায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এখন জনসংখ্যা ১৭ কোটি। ২০৪১ সালে বাংলাদেশে জনসংখ্যা থাকবে ১৯ কোটি ৮০ লাখে। জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধি তখন থাকবে শূণ্য দশমিক ৪ এ। এখন যে মূল্যস্ফীতি সাড়ে পাঁচ শতাংশের মধ্যে অবস্থান করছে, ২০৪১ সালে তা ৪ দশমিক ৪ শতাংশে রাখা হবে। যে বিনিয়োগ নিয়ে এত হাহাকার সেই বিনিয়োগ ২০৪১ সালে ৪৭ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার প্রক্ষেপণ করা হয়েছে প্রেক্ষিত পরিকল্পনায়। যেটি এখন ৩৫ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। মোট দেশজ সঞ্চয় বর্তমান ৩০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪২ দশমিক ৭ শতাংশে নিতে চায় সরকার। এছাড়া মোট রাজস্ব আদায়ের হার ২৪ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এসব প্রক্ষেপণ আসলে কতটা যৌক্তিক গতকাল এনইসি সভা শেষে প্রশ্ন ছিল পরিকল্পনামন্ত্রীর কাছে। জবাবে তিনি বলেন, যৌক্তিক বলেই তো আমরা ছাপিয়েছি। এসব অর্জন করা সম্ভব। তবে সেভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এই চ্যালেঞ্জ আমরা মোকাবিলা করব। সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা বিভাগের সচিব নূরুল আমিন, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম, শামীমা নার্গিস, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তীসহ অন্যরা।
এনইসি সভায় শর্তসাপেক্ষে প্রেক্ষিত পরিকল্পনা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বেশ কয়েকজন মন্ত্রী প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসেনি বলে দাবি করেন। তখন ওইসব মন্ত্রীদের বলা হয়েছে, যেসব বিষয় বাদ পড়েছে আগামী এক মাসের মধ্যে তা লিখিত আকারে পরিকল্পনা কমিশনে জমা দেওয়ার জন্য। যেগুলো পরবর্তীতে প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় যুক্ত করা হবে। আইসিটি প্রতিমন্ত্রী তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের হালনাগাদ তথ্য সংযোজনের দাবি করেন। দেশের পর্যটনের বিকাশে প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় আরো অনেক বিষয় যোগ করার দাবি করেন। শিল্প খাতে বেশ কিছু বিষয় বাদ পড়েছে বলে জানানো হয়। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে তেমন কিছু নেই বলে জানান সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নিয়ে প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় তেমন কিছু উঠে আসেনি বলে একজন মন্ত্রী জানান। যেসব বিষয় বাদ পড়েছে তা এক মাসের মধ্যে লিখিত আকারে দেওয়ার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। ড. শামসুল আলম প্রেক্ষিত পরিকল্পনাকে ঐতিহাসিক দলিল ও স্বপ্ন দলিল বলে উল্লেখ করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন