বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সিংহপুরুষ

প্রকাশের সময় : ১০ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

 সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ রহ.
এম এ বাছিত আশরাফ
সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.), যাকে ব্রিটিশরা জমের মতো ভয় পেত সেই মর্দে মুজাহিদকে রেনেসার কবি ফররুখ আহমদ তার কালজয়ী কবিতায় ‘রায় বেরেলীর জঙ্গি পীর’ আখ্যা দিতে গিয়ে লিখেন :
সবাই যখন আরাম খুঁজে
ছুটে ঘরের পানে
জঙ্গী পীরের ডাক শোনা যায়  
জঙ্গের ই ময়দানে।
সবাই ভাবে পীরের কথা
শুনেছি তো ঢের
এমন পীরের কথা তো ভাই
পাইনি কভু টের।...
সত্যিই সেদিন সেই পীর শুধু তাসবিহ হাতে মুরিদানকে নিয়ে খানকায় বসে থাকেননি, নিজের সুখ-শান্তি ত্যাগ করে যুদ্ধের ময়দানে এসে সিংহের মতো গর্জন করে উঠেছেন। পরাধীন ভারতবাসীদের কেউই তখনো ব্রিটিশদের শাসন ও শোষণ থেকে রক্ষার স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেনি। সাধারণ মানুষ কখনই ভাবত না তারা ব্রিটিশদের জুলুম, নির্যাতন এবং শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে পারবে। তাদের কাছে এমন একটি স্বপ্ন ছিল আঁধারে হারিয়ে যাওয়া আলোর মতোই। কখনই তা চিন্তা শক্তিতে স্বচ্ছ হয়ে ধরা দিত না। কিন্তু তারপরও কিছু মানুষ দৃপ্ত শপথে সেই স্বপ্ন দেখতেন আবার অন্যকে দেখাতেন। অন্যের চোখে সেই স্বপ্নের বীজও বুনে দিতেন। পরাধীন ভারতবাসীর চোখে মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়ে আঁধারকে দূর করার আলো জ্বালাতেন। যেসব মহামনীষী প্রতিবাদের আগুন জ্বালিয়ে ভারতবাসীকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিলেন তাদের অন্যতম সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.)। এই ক্ষণজীবী মহান পুরুষ ৬ সফর, ১২০১ হিজরি মোতাবেক ১৭৮৬ ঈসায়ী সালের ২৯ নভেম্বর সোমবার ভারতের উত্তর প্রদেশে এলাহাবাদের রায় বেরেলির সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে (সাইয়্যিদ বংশে) জন্মেছিলেন। যার নাম সব মুক্তিকামী মানুষেরই জানা।
জন্মসূত্রে সাইয়্যিদ বংশের উজ্জ্বল নক্ষত্র, আওলাদে রাসূল এই মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক, ইসলামের খাদেম, নিবেদিত প্রাণ ইসলাম প্রচারক এবং মাক্ববুল সিলসিলার উত্তরাধিকারী, তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে রয়েছে খেদমতে ইসলাম, খেদমতে খলক্বের অনুপম নিদর্শন। মজলুম মানব জাতির মুক্তির ক্ষেত্রে, মানুষের ইসলাহ/তাযকিয়া ও তরবিয়াতের ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক কার্যক্রমে তার অবদান ভারতবাসী তথা বিশ্বের মজলুমদের জন্য অনুকরণীয়। আখলাকে নববীর অনুপম আদর্শে আদর্শিত সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) ছিলেন সময়ের শ্রেষ্ঠ সাহসী সন্তান, তরিকতের উঁচু মর্গের বুজুর্গ, যামানার মুজাদ্দিদ, আদর্শ নবী প্রেমিক, ওয়ারিছে রাসূল (সা.)। বাতিলের বিরুদ্ধে আপসহীন ব্যক্তিত্ব, মানব দরদী এই মহান ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে দেশ-বিদেশের অসংখ্য বনি আদম তরিকতের উচ্চ মাক্বাম হাসিলের পাশাপাশি নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন করে ইহ ও পরজগতে কামিয়াবি হাসিল করতে সক্ষম হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতার কিছুটা নিদর্শন আমরা দেখেছি মুরশিদে বরহক্ব আল্লামা সাহেব ক্বিবলাহ ফুলতলী (রাহ.) এর মধ্যে।
সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) ইসলামের ইতিহাসে অপরাজেয় সৈনিক, রাসূল (সা.) প্রেমের অনলে পোড়া আল্লাহর তরবারি (সাইফুল্লাহ) হযরত খালেদ বিন ওয়ালিদ (রা.)-এর যোগ্য উত্তরসূরি পরিচয় দিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য প্রজ্ঞা সম্পন্ন বৈজ্ঞানিক কর্মসূচি সম্বলিত যে আধুনিক কলাকৌশল প্রয়োগ করেছিলেন, মুক্তিকামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে আজও বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দেয়। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সংগ্রামের পাশাপাশি পূর্ণাঙ্গ সমাজ-বিপ্লবের উদ্দেশ্যে ইসলামী আন্দোলন গড়ে তোলার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তও তিনি অনাগত ভবিষ্যতের জন্য রেখে গেছেন। ভারত উপমহাদেশের মুক্তিকামী মুসলমানদের ঈমানী প্রাণ প্রবাহ অক্ষুণœ রাখার লক্ষ্যে হযরত শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (রহ.)-এর রেখে যাওয়া কর্মসূচি অনুকরণ করেই হযরত সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) ও তার সঙ্গী সাথীরা পরবর্তী সময়ে একটি ইসলামী আন্দোলন পরিচালিত করেছিলেন। সুদৃঢ় ব্যক্তিত্ব, প্রখর দূরদৃষ্টি, তীক্ষè প্রজ্ঞা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দ্বারা হযরত সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) উপমহাদেশে প্রচ- আলোড়ন সৃষ্টিকারী এক আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন, যা কিনা উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক এবং ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়ের সূচনা করেছে। সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) তার বাস্তব সাংগঠনিক কাঠামো ও কর্মসূচি, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীবাহিনী এবং রণচাতুর্যের মাধ্যমে যে বিপ্লবের জোয়ার এনেছিলেন, তা ছিল আধুনিক সমাজ বিপ্লবেরই এক নবতর প্রক্রিয়া। সে বিপ্লব তদানীন্তন সা¤্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের মসনদ যেমনিভাবে প্রকম্পিত করেছিল তেমনিভাবে আজকের আধুনিক প্রযুক্তির যুগেও তার কর্মকৌশল বর্তমান সময়ের ইসলামী আন্দোলনের যে কোনো কাফেলার জন্য হতে পারে অনুপ্রেরণার এক সাবলীল উৎস ধারা। একটি স্বাধীন, সার্বভৌম,  ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) যেসব কর্মসূচি ও পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন, তা সব মুক্তিকামী মানুষের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।
বালাকোটের জিহাদ; ব্রিটিশদের চতুরি এবং পাঠানদের মোনাফিকী :
বনি আদমের ওপর জুলুম-নির্যাতন দেখলেই সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.)-এর প্রতিবাদী মন জেগে উঠত। আর উঠবেই না কেন, যার পুণ্যময়ী জননী গর্ভে থাকাকালীন অবস্থায় স্বপ্নে দেখেন যে, ‘রক্তে লেখা একখানি কাগজ পত্ পত্ করে উড়ে বেড়াচ্ছে’। ভারতের জমিনে যখন অসহায় মজলুমদের জীবন জুলুম আর নির্যাতনের আঘাতে জর্জরিত হচ্ছিল তখনই মেঘলা আকাশে প্রতিবাদের উল্কাপি- রূপে আবির্ভূত হয়ে দেখা দিয়েছিলেন সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.)।
সাইয়্যিদ সাহেবের জ্ঞানচক্ষু উন্মোচিত হয়ে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন, কেমন করে এ দেশের বিরাট মোগল সা¤্রাজ্য চূর্ণবিচূর্ণ ও ধ্বংস হয়ে গেছে। তার ধ্বংসস্তূপের ওপর যে দু-চারটি মুসলমান রাষ্ট্র মাথা তুলেছিল, তাও শেষ হয়ে গেছে। ব্রিটিশ ইংরেজ গোটা ভারতের উপরে তার আধিপত্য বিস্তার করে থাকলেও ভারত উপমহাদেশের এক বিরাট অঞ্চল শিখ রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে উঠেছিল। মুসলমানরা শুধুরাজ্য হারায়নি, আপন দ্বীন ও ‘সিরাতে মুস্তাকীম’ থেকে বহু দূরে সরে পড়েছে। তাদের আকিদা বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা ও আচার-অনুষ্ঠান, অনৈসলামিক চিন্তাধারা ও ধর্মকর্মের দ্বারা প্রভাবিত। মুসলমান আমির-ওমরা যারা অবশিষ্ট ছিলেন, তারাও ভোগবিলাসে লিপ্ত এবং তাদের জীবনের লক্ষ্য এ ছাড়া আর অন্য কোনো কিছু ছিল না। মুসলমানদের এ অবস্থা দেখে ব্রিটিশ জালিমদের ছত্রচ্ছায়ায় ভারতের মারাঠা ও পাঞ্জাবের সীমান্ত এলাকায় সুযোগ সন্ধানী শিখদের অত্যাচারের মাত্রা সীমাতিক্রম করেছিল। সেসব এলাকাগুলোতে মুসলমানদের জন্য বসবাস করা সম্পূণ রূপে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। জুলুম-নির্যাতন এতই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে এই জালিম শিখ হায়েনারা মুসলিম নারীদেরকে দাসীরূপে ব্যবহার করত। সীমান্তে মুসলমানদের ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিত, ফল-ফসলাদি বিনষ্ট করত। মুসলমানদেরকে তাদের ধর্মীয় দায়-দায়িত্ব পালনে বাধা প্রদান করত। মসজিদগুলোতে ঘোড়া বেঁধে রাখত। মিনারে উঁচু আওয়াজে আজান দিতে বাধা প্রদান করত। মানবতা যখন দ্বারে দ্বারে কাঁদছিল, তখন ভারত উপমহাদেশের মজলুম মুসলমানরা একজন মুক্তির দিশারীর অপেক্ষায় চিৎকার করছিল। এমনি সংকট মুহূর্তে জিহাদি প্রেরণায় উজ্জীবিত, ব্রিটিশ জালিমদের জুলুম থেকে মুক্ত করে ভারতে একটি প্রকৃত ইসলামী রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা হযরত সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) জিহাদের ডাক দিলেন। তার ডাকে ঘুমিয়ে পড়া মুসলমানদের মনে আবারও জিহাদের প্রেরণা জেগে ওঠে, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে ওঠে, ঘরবাড়ি ছেড়ে মুক্তিকামী মানুষ প্রস্তুতি নিতে থাকেন। যুদ্ধযাত্রার পূর্বে ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে অর্থ, যুদ্ধের হাতিয়ার, সরঞ্জাম, ঘোড়া, রসদ প্রভৃতি আনা শুরু হলো। আল্লাহর পথে জান কোরবান করার জন্য হাজার হাজার মুজাহিদ তার ঝা-ার নিচে জমায়েত হতে লাগলেন। এভাবে যাত্রাকালে তার মুজাহিদ বাহিনীর সংখ্যা দাঁড়ালো বারো হাজার। মুজাহিদরা ১২৪১ হিজরি সনের ৭ জমাদিউস সানি মোতাবেক ১৮২৬ ঈসায়ী সনের ১৭ জানুয়ারি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়েন। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে অত্যাচারী শিখদের এলাকায় উপনীত হন। উল্লেখ্য ইতিপূর্বে শিখদের সাথে মুসলিম বাহিনীর আরোও বেশ ক’টি যুদ্ধ হয়েছিল। যেমনÑ নওশেরার যুদ্ধ, সিদুর যুদ্ধ, আকুড়ার যুদ্ধ, পানজতারের যুদ্ধ, মায়ার যুদ্ধ, মর্দান যুদ্ধ ইত্যাদি।  সবকটি যুদ্ধেই শিখরা মোজাহিদ বাহিনীর সাথে পরাজিত হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন