বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

আসমানী ধর্মসমূহের মতে ব্যভিচারের পরিণতি

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০২ এএম

পূর্ব প্রকাশিতের পর
ইয়াহূদী পন্ডিতবর্গ হযরত ঈসা আ.-কে একাধারে অপরাধী ও আল্লাহর বিধান লংঘনকারী সাব্যস্ত করার জন্য যে ষড়যন্ত্র করেছিল তা থেকেও তাদের ধর্মে যে ব্যাভিচারের শাস্তি মৃত্যুদন্ড তা প্রমাণিত হয়। ইয়াহূদী অধ্যাপক ও ফরীশীগণ ব্যভিচারে ধৃতা এক নারীকে হযরত ঈসা আ.-এর দরবারে উপস্থিত করে বললো, হে গুরু! এই নারী ব্যভিচারে লিপ্ত অবস্থায় ধরা পড়েছে। ব্যবস্থায় মোশি (মূসা আ.) এই প্রকার লোককে পাথর মারার আজ্ঞা আমাদের দান করেছেন। তবে আপনি কি বলেন? তারা তাঁকে বিপদে ফেলার জন্যই একথা বললো, যাতে তাঁর নামে দোষারোপ করার সূত্র পেতে পারে। (দ্র. বাইবেলের নূতন নিয়ম, যোহন, ৮ ঃ ১-৬)। হযরত ঈসা আ.-এর বিরোধী ইয়াহূদী পন্ডিতদের উদ্দেশ্য ছিল, দ্বিবিধ। হযরত ঈসা আ. যদি তাওরাতের বিধানমত অভিযুক্ত নারীকে ব্যভিচারের শাস্তির রায় না দেন তবে তারা তাঁর বিরুদ্ধে এই বলে অপপ্রচার চালানোর সুযোগ পাবে যে, একদিকে তিনি নিজেকে নবী বলে দাবি করছেন এবং তাওরাতের সত্যতা স্বীকার করছেন, অপরদিকে শাস্তির রায় না দিয়ে তাওরাতের বিধান সংঘন করছেন। আবার তিনি যদি তাওরাতের বিধামত উপরোক্ত নারীর মৃত্যুদন্ডের রায় দেন, তবে সমসাময়িক ইয়াহূদী রাজার আইনে তাঁকে সহজেই অপরাধী সাব্যস্ত করা যাবে যে, তিনি রাষ্ট্রীয় বিধান লংঘন করেছেন। উল্লেখ্য যে, তৎকালীন ইয়াহূদী রাষ্ট্রীয় বিধানে ব্যভিচারের শাস্তি মৃত্যুদন্ড বাতিল করা হয়েছিল।

হযরত ঈসা আ. নবী সুলভ প্রজ্ঞার মাধ্যমে যথার্থ রায়ই প্রদান করলেন। তিনি অভিযুক্ত নারীর প্রতি ইশারা করে ইয়াহূদী পন্ডিতদের বললেন, তোমাদের বক্তব্য অনুযায়ী, এই নারী যে গর্হিত অপকর্মে লিপ্ত হয়েছে, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কখনো সেই গর্হিত অপকর্মে লিপ্ত হয়নি সে তাকে পাথর মারুক। এই রায় শোনামাত্র ইয়াহূদী পন্ডিতবর্গ একে একে স্থান ত্যাগ করলো, শুধু ঐ নারীই একাকী দাঁড়িয়ে থাকলো। হযরত ঈসা আ. তাকে তওবা করালেন এবং উপদেশ দিয়ে বিদায় দিলেন। (দ্র. বাইবেলের নূতন নিয়ম, যোহন, ৮ ঃ ৭-১১)

অনুরূপ একটি ঘটনা মহানবী স.-এর সময়ও ঘটেছিল। আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত। ইয়াহূদীরা মহানবী স.-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে তাঁকে অবহিত করলো যে, তাদের মধ্যকার একজোড়া নারী-পুরুষ ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে ধরা পড়েছে। মহানবী স. তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ব্যভিচারের শাস্তি (রজম) সম্পর্কে তোমরা তাওরাতে কী বিধান পাচ্ছো? তারা বললো, আমরা এসব অপরাধীকে অপমান করি ও বেত্রাঘাত করি। (ইয়াহূদী পন্ডিত ও পরে ইসলাম গ্রহণকারী) আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রা. তাদের বলেন, তোমরা মিথ্যা বলছো। তাওরাতে রজম (পাথর নিক্ষেপে হত্যা)-এর বিধান রয়েছে। তারা তাওরাত কিতাব নিয়ে এলো এবং খুলে তাদের এক ব্যক্তি রজম সম্পর্কিত নির্দেশটি হাত দিয়ে ঢেকে রেখে তার আগে-পরের অংশ পড়লো। আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রা. বললেন, তোমার হাত সরাও। অতএব সে তার হাত সরালে রজম সম্পর্কিত বিধা দেখা গেলো। পাঠকারী লোকটি বললো, হে মুহাম্মদ! আপনি সত্য কথা বলেছেন। তাতে রজম সংক্রান্ত বিধান বিদ্যমান আছে। অতএব রসূলুল্লাহ স. অপরাধীদ্বয় সম্পর্কে রায় প্রদান করলে তদনুযায়ী তাদের রজম করা হয়। ইবনে উমর রা. বলেন, আমি যেনাকারী পুরুষটিকে দেখেছি যে, সে স্ত্রীলোকটিকে পাথরের আঘাত থেকে রক্ষার জন্য তার দিকে ঝুঁকে পড়তো।
উপরোক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে আল্লাহ তা’আলা আয়াত নাযিল করেন ঃ ‘আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদনুসারে যারা মীমাংসা করে না, তারাই কাফের’ (সূরা মাইদা, নং ৪৪)। ‘আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদনুসারে যারা মীমাংসা করে না, তারাই যালেম’ (ঐ সূরা, নং ৪৫) ‘আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদনুসারে যারা মীমাংসা করে না, তারাই পাপাচারী’ (ঐ সূরা, নং ৪৭)।

ইয়াহূদী রাষ্ট্রে এক পর্যায়ে তাওরাতের উপরোক্ত দন্ডবিধি বলবৎ থাকলেও পরবর্তী কালে এবং হযরত ঈসা আ.-এর আবির্ভাবের বহু পূর্বে ইয়াহূদী পন্ডিতবর্গ, আইনজ্ঞ, রাজন্যবর্গ ও জনসাধারণ উপরোক্ত বিধানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাতিল করে দিয়েছিল। রসূলুল্লাহ স. ইয়াহূদীদেরকে তাওরাতের বিধান বাতিল করে তদস্থলে মানব রচিত বিধান প্রবর্তনের কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলে, আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনেও রজমের বিধান কার্যকর ছিল। কিন্তু আমাদের সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিগণ ব্যাপকভাবে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তারা উপরোক্ত অপকর্ম করে ধরা পড়লে তাদেরকে বিচারের আওতায় না এনে ছেড়ে দেয়া হতো। কিন্তু কোন সাধারণ লোক উপরোক্ত অপরাধে ধৃত হলে তাকে আইনের আওতায় এনে রজম (পাথর নিক্ষেপে হত্যা) করা হতো। পরিশেষে আমরা বললাম, তোমরা সকলে এসো, আমরা সম্মিলিতভাবে একটি শাস্তির বিধান চালু করি, যা গণ্যমান্য ও সাধারণ সকলের বেলায় প্রযোজ্য হবে। সুতরাং আমরা ব্যভিচারের শাস্তি মুখমন্ডলে কালি মাখানো এবং বেত্রাঘাত করাকেই স্থির করে নিলাম, পাথর নিক্ষেপের পরিবর্তে। এই বিবরণ শুনে রসূলুল্লাহ স. বলেন, হে আল্লাহ! আমিই প্রথম ব্যক্তি যে তোমার নির্দেশ ‘রজম’-এর শাস্তি কার্যকর করে তোমার বিধানকে পুনর্জীবিত করলো, যা তারা বাতিল করে দিয়েছিল।

যেনা সম্পর্কে তাওরাত ও ইনজীলের বিধান ঃ ইয়াহূদীদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাত (বাইবেলের পুরাতন নিয়ম) এবং খৃষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাত ও ইনজীল (বাইবেলের নূতন নিয়ম)-এর যেনা (ব্যভিচার) সম্পর্কে যে আলোচনা রয়েছে তার সারমর্ম হলো ঃ আল্লাহ তাআলা তাঁর নবীকে নির্দেশ দিচ্ছেন ঃ (ক) যেনা একটি দুষ্টাচার; (খ) যে নারী-পুরুষ যেনায় লিপ্ত হবে তাদের উভয়কে কঠোর শাস্তি দিতে হবে; (গ) শাস্তির ধরন ও তা কার্যকর করার পদ্ধতি হলো- (১) উভয়ের মৃত্যুদন্ড হবে এবং (২) তা প্রকাশ্য দিবালোকে (৩) তাদের প্রতি পাথর নিক্ষেপ (রজম) করে কার্যকর করতে হবে; (ঘ) এই পদ্ধতিতে সমাজ থেকে উপরোক্ত দুষ্টাচারকে উৎখাত করতে হবে।
পাশ্চাত্যের ইয়াহূদী-খৃষ্টান পন্ডিগণের সমালোচনা ঃ এ পর্যন্ত ব্যভিচার সম্পর্কে বাইবেলে যেসব বক্তব্য আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে, আল-কুরআনের বক্তব্যের সাথে তার হুবহু সামঞ্জস্য রয়েছে। অপরাধ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি, অপরাধের শাস্তি এবং তা কার্যকর করার পদ্ধতি সব দিক থেকেই মিল রয়েছে। পাশ্চাত্যের ইয়াহূদী ও খৃষ্টান পন্ডিতগণ ইসলাম ধর্ম যেনার যে শাস্তি অনুমোদন করেছে, তাকে তারা বর্বর, মানবতা বিরোধী, আদিম ও বর্তমান সভ্যতার জন্য লজ্জাজনক ইত্যাদি শব্দে সমালোচনা করে থাকেন। কিন্তু তারা কখনো নিজেদের তাওরাত-ইনজীলের পাতাগুলো উল্টিয়ে দেখেন না যে, তাদের ধর্মও ইসলাম ধর্মের অনুরূপ ব্যভিচারের একই শাস্তির ব্যবস্থা রেখেছে।

আসলে তাদের সমালোচনার উদ্দেশ্য ভিন্নতর। তারা যেভাবে তদের নিকট রক্ষিত আল্লাহর কিতাবকে পশ্চাতপটে নিক্ষেপ করে সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে, তদ্রুপ মুসলমানদেরকেও তারা আল-কুরআন থেকে বিচ্ছিন্ন করে পথভ্রষ্ট করতে চায়। আল-কুরআন আমাদের সতর্ক করে দিচ্ছে ঃ ‘ইয়াহূদী-খৃষ্টানরা তোমার প্রতি কখনো সন্তুষ্ট হবে না, যাবত না তুমি তাদের জাতির অনুসরণ করো’ (সূরা বাকারা ঃ ১২০)। ‘হে মুমিনগণ! যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে (ইয়াহূদী-খৃষ্টান), তোমরা যদি তাদের দলবিশেষের অনুসরণ করো, তবে তারা তোমাদেরকে ঈমান আনার পর আবার কাফির বানিয়ে ছাড়বে’ (সূরা আল ইমরান ঃ ১০০)।

বর্তমান খৃষ্টান বিশ্বে যেনার মহামারী ঃ পাশ্চাত্যের খৃষ্টান দেশসমূহে যেনা-ব্যভিচার খুবই সহজলভ্য। তরুণ-যুবা, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা অতি ব্যাপক হারে যেনায় লিপ্ত। রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের প্রবীণ কর্তা ব্যক্তিরাও ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে ধরা পড়ে হেনস্তা হচ্ছেন, পদ হারাচ্ছেন। এক আমেরিকান সমজের তিরিশ লাগোয়া যুবক-যুবতীদের শতকরা তিরিশ ভাগ জারজ সন্তান, যাদের বেশির ভাগেরই পিতৃ-পরিচয় নেই। ভ্যাটিকানের পোপকে মাঝে-মধ্যে ইটালিয়ান সমাজকে নরকবাসী বলে মন্তব্য করতেও শোনা যায়।

খৃষ্টান ধর্মগুরুদের ভূমিকা ঃ খৃষ্টান বিশ্বে এবং স্বয়ং পোপের সাম্রাজ্যে ব্যভিচারের ও অবৈধ সন্তান উৎপাদনের যে ভয়াবহ সয়লাব চলছে, তার বিরুদ্ধে খৃষ্টান ধর্মগুরুদের সোচ্চার কোন কন্ঠ শোনা যাচ্ছে না। মানবতা বিধ্বংসী এই অনাচারকে সমূলে উৎখাত করার জন্য তাদের কোন কর্ম বা প্রচার পরিকল্পনা লক্ষ করা যাচ্ছে না। আসলে তারা তাদের সমাজ সম্পর্কে মারাত্মকভাবে হতাশ হয়ে পড়েছেন বলে মনে হয়। তারা চিন্তা করছেন যে, গোটা খৃষ্টান বিশ্ব ব্যাপী যেনা-ব্যভিচারের যে প্রকাশ্য ও ব্যাপক অনাচার চলছে তার ছোবল থেকে খৃষ্টান জাতিকে মুক্ত করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তারা হাল ছেড়ে দিয়েছেন।
বর্তমানে তারা একটি বিষয়ই জোরেশোরে প্রচার করছেন, ‘ঈশ্বর-পুত্র যীশু গোটা মানবজাতির পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য জীবন দিয়েছেন। যে কেউ যীশুতে বিশ্বাস স্থানপ করলে সে যত বড়ো পাপীই হোক সহজেই নিস্তার পেয়ে প্যারাডাইজ-এ পৌছে যাবে’। তাদের এই বিশ্বাসের পেছনে তাদের ধর্মগ্রন্থে কোন ভিত্তি আছে কিনা তা আমাদের অজ্ঞাত। তবে আমরা বাইবেল থেকে জানতে পারি ‘সন্তানের জন্য পিতার, কিংবা পিতার জন্য সন্তানের প্রাণদন্ড করা যাইবে না। প্রতিজন আপন আপন পাপপ্রযুক্তই প্রাণদন্ড ভোগ করিবে’ (বাইবেলের পুরাতন নিয়ম, দ্বিতীয় বিবরণ, ২৪ঃ১৬)। আল-কুরআনের বাণীঃ ‘প্রত্যেকে নিজ কৃতকর্মের জন্য দায়ী এবং কেউ কারো পাপের বোঝা বহন করবে না’।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন