মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ফের ‘ভয়ঙ্কর’ কিশোর গ্যাং

খলিলুর রহমান | প্রকাশের সময় : ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আবারো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। ওই গ্যাংয়ের সদস্যরা গত মঙ্গলবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় বাবার সামনে ছেলেকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে। এছাড়া গত রোববার রাতে হাতিরঝিল এলাকায় শিপন নামের এক কিশোরকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ সময় তাদের হামলার শিকার হয়েছেন মানিক নামের আরেক কিশোর। তবে মধুবাগের মেয়ের সাথে বেগুনবাড়ির ছেলের প্রেমের কারণে এ ঘটনা ঘটেছে জানা গেছে। 

এছাড়া ৯৯৯ এর মাধ্যমে চাঁদপুর শহরে ওই গ্যাংয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন পাপ্পু নামের আরেক কিশোর। তবে সন্তানকে পরিবার থেকে নৈতিক শিক্ষা দিলে এমন ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত মঙ্গলবার দুপুরে যাত্রাবাড়ী এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে বাবার সামনে ইমন (১৮) নামে এক ছেলেকে হত্যা করে। তার বাবার নাম আবু বকর। বাড়ি মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার নয়াবাড়ি গ্রামে। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে ইমন সবার বড় ছিল। শনিরআখড়ার গোবিন্দপুর এলাকায় পরিবারের সাথে থাকত।
নিহত ইমনের বাবা আবু বকর জানান, বাবা-ছেলে দুজনেই গোবিন্দপুরে গ্রামীণ নামের একটি পোশাক কারখানায় অপারেটর হিসেবে চাকরি করেন। গত মঙ্গলবার দুপুরে বাসায় খাবার খেতে যাওয়ার সময় গোবিন্দপুর সরকারি বিদ্যালয়ের সামনে নয়ন, রাজু, রুবেল, অনিকসহ কয়েকজন কিশোর তাদের গতিরোধ করে। তাদের মধ্যে রাজু, রুবেল ও অনিক আবু বকরকে ধরে রাখে। আর নয়ন তার ছেলেকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে। পরে সবাই পালিয়ে যায়।
এক পর্যায়ে স্থানীয়দের সহযোগিতায় ইমনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। পরে এ ঘটনায় আবু বকর বাদি হয়ে যাত্রাবাড়ী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার প্রেক্ষিতে জিহাদ, নয়ন ও অনিক নামের তিন কিশোরকে পুলিশ গ্রেফতার করে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা যাত্রাবাড়ী থানার এসআই শরিফ হোসেন দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, এ ঘটনায় গ্রেফতারকৃত অনিক নয়ন ও জিহাদ আদালতে ১৬৪ স্বীকারেক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। আদালতের নির্দেশে তাদেরকে গাজীপুরের কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। জড়িত অন্যদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
এর আগে গত রোববার রাতে রাকিব হাসান শিপন (১৮) ও আব্দুর রহমান মানিক (১৬) নামের দুই কিশোর হাতিঝিলে ঘুরতে যায়। এক পর্যায়ে হাতিরঝিলের বেগুনবাড়ি সেতু এলাকায় দুই মোটরসাইকেলে কয়েকজন যুবক এসে তাদের গতিরোধ করে। এরপর তারা দু’জনকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে পালিয়ে যায়।
স্থানীয়রা তাদেরকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে রাকিব হাসান শিপনকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। আব্দুর রহমান মানিককে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় হাতিরঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায় পুলিশ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে। এরা হলো- আজাদ, সুজন ও ইব্রাহীম। তাদের কাছ থেকে একটি সুইচ গিয়ার চাকু উদ্ধার করা হয়।
গতকাল ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আবদুল বাতেন জানান, বেগুনবাড়ি ও মধুবাগ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে উঠতি বয়সী ছেলেদের মধ্যে দ্ব›দ্ব দীর্ঘদিনের। এছাড়াও মধুবাগ এলাকার একটি মেয়ের সাথে বেগুনবাড়ির আজাদের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। গত ২১ ফ্রেব্রুয়ারি পারিবারিকভাবে ওই মেয়ের বাসায় আজাদের পরিবার বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু বেগুনবাড়ির ছেলে মধুবাগ এলাকার মেয়েকে বিয়ে করবে এই ভেবে মধুবাগের ছেলেরা ক্ষিপ্ত হয়ে আজাদ ও তার পরিবারকে আটকে অপমান করে। এর জের ধরে দুই গ্রুপের মধ্যে দ্ব›দ্ব চরমে পৌঁছালে শিপনকে হত্যা করা হয়।
এদিকে, ঢাকার বাইরেও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। গত রোববার চাঁদপুর শহরের রেলওয়ে আক্কাস আলী হাইস্কুল কেন্দ্র থেকে পরীক্ষা শেষে বের হয় পারভেজ পাপ্পু নামের এক পরীক্ষার্থী। স্কুলের গেটে অপেক্ষমান কয়েকজন কিশোর তাকে ধরে নিয়ে যায়। ইজিবাইকে উঠিয়ে শহরের শেষপ্রান্ত মাঝিবাড়ি এলাকায় নিয়ে তাকে বেধড়ক পিটুনি দেয়। এ দৃশ্য কয়েকজন যুবক দেখে ৯৯৯ এ ফোন করেন। দ্রুত পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পাপ্পুকে উদ্ধার ও চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে। এ ঘটনার সাথে জড়িত আটক ১১ জনের মধ্যে ১০ জনই এসএসসি পরীক্ষার্থী বলে জানা গেছে।
চাঁদপুরের অতিরিক্ত এসপি মো. জাহেদ পারভেজ চৌধুরী দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, এ ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। ওই মামলায় আটকদের আদালতে হাজির করা হয়। পরে আদালতের নির্দেশে তাদের গাজীপুরের কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। তিনি আরো জানান, আটককৃতরা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য কি না তা বলা যাচ্ছে না। তদন্ত শেষে বিষয়টি বলা যাবে।
সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি রাজধানীর উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর রোডে ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবীরকে খেলার মাঠে পিটিয়ে এবং কুপিয়ে মারাত্মক আহত করে প্রতিপক্ষ। তাকে উত্তরার একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।
পরে এ ঘটনায় আদনানের বাবা কবীর হোসেন বাদি হয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলার তদন্তে কিশোর গ্যাংয়ের তথ্য উঠে আসে। এরপর থেকে রাজধানীতে একাধিক অভিযান চালিয়ে গ্যাংয়ের শতাধিক সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। উত্তরা ছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় একাধিক গ্যাংয়ের সন্ধান পায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
পুলিশ বলছে, রাজধানীতে অর্ধশতাধিক কিশোর গ্যাং রয়েছে। এর মধ্যে ‘নাইন এমএম’, ‘একে ৪৭’, ‘ফাইভ স্টার’, ‘বাংলা’, ‘গ্লোরিয়ায় লাভলেট’, ‘জুম্মন গ্যাং’, ‘চান-জাদু’, ‘ডেভিল কিং ফুল পার্টি’, ‘ভলিয়ম টু’ ও ‘ভান্ডারি গ্যাং’, ‘টিকটক গ্যাং’, ‘পোঁটলা সিফাত গ্যাং’, ‘স্টার বন্ড গ্রুপ’, ‘মোল্লা রাব্বি গ্রুপ’, ‘গ্রুপ টোয়েন্টিফাইভ’, ‘লাড়া দে’ উল্লেখযোগ্য।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অ্যাডভেঞ্চার বা ক্ষমতা দেখানোর লোভ, মাদক, বন্ধুদের পাল্লায় পড়া ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতাসহ নানা কারণে কিশোর গ্যাংগুলো তৈরি হচ্ছে। তবে বাবা-মা সন্তানদের সঠিকভাবে সময় দিলে বা সন্তানরা কোথায় যাচ্ছে, কি করছে, কাদের সাথে মিশছে ও তাদের চাহিদা কী এসব সম্পর্কে খোঁজ খবর না রাখাতে এ অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আবদুল বাতেন বলেন, অভিভাবকরা সন্তানদের প্রতি খেয়াল রাখবেন। তারা কি করছে, কার সাথে মেলামেশা করছে, তাদের চালচলন ও পোশাকে বখাটেপনা আছে কিনা? এসব বিষয়ে খেয়াল রেখে সন্তানকে পরিবার থেকে নৈতিক শিক্ষা দিলে এমন ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে না।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী পরিচালক এএসপি সুজয় সরকার দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাবও কাজ করছে। রাজধানীসহ সারা দেশে কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান র‌্যাবের ওই কর্মকর্তা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Ali ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:৪১ এএম says : 0
Quote of the society: "Good people never becoming bad before ended the breathing."
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন