শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

তালেবান-যুক্তরাষ্ট্র ঐতিহাসিক চুক্তি

| প্রকাশের সময় : ২ মার্চ, ২০২০, ১২:০২ এএম

যুদ্ধাবসান ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বহুল আলোচিত শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। উভয়পক্ষের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা ও সমঝোতার পর কাতারের রাজধানী দোহায় এই ঐতিহাসিক চুক্তি সই হয়। তালেবানের পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন মোল্লা আবদুল গনি বরদার এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে আফগানবিষয়ক বিশেষ দূত জালমি খলিলজাদ। চুক্তিস্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিতি ছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও। তালেবান প্রতিনিধি দল ছাড়াও সেখানে হাজির ছিলেন পাকিস্তান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, উজবেকিস্তান ও তাজাকিস্তানের প্রতিনিধিবর্গ। চুক্তিস্বাক্ষরের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার প্রতিক্রিয়ায় উচ্চ আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তিনি তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সে মোতাবেক কাতারের মধ্যস্থতায় দু’পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। দু’বছর ব্যাপী এই আলোচনা নানা টানাপোড়েন এবং কখনো কখনো অনিশ্চয়তার মুখে পড়লেও কেউ ছেড়ে যায়নি। আলোচনা সচল থাকে শেষ পর্যন্ত এবং তারই সুফল হিসাবে স্বাক্ষরিত হলো চুক্তি। চুক্তিস্বাক্ষরের পেছনে অবশ্যই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঐকান্তিক ইচ্ছা ও গভীর আগ্রহ সক্রিয় ছিল। তা না হলে চুক্তি হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিলনা। ট্রাম্পের অনেক সিদ্ধান্তই নেতিবাচক ও সমালোচনাযোগ্য। ইরানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি থেকে সরে আসা কিংবা ডিল অব দি সেঞ্চুরি ইত্যাদির কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। কিন্তু তালেবানের সঙ্গে আলোচনা ও তাদের সঙ্গে একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়ার সিদ্ধান্ত অত্যন্ত ইতিবাচক। তার প্রশাসনের অনেকে কিংবা উপদেষ্টদের কেউ কেউ হয়তো তার সিদ্ধান্ত সমর্থন করেননি বা করতে চাননি। তবে তিনি এসবের তোয়াক্কা করেননি। এজন্য তিনি বিশেষ ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। ওদিকে তালেবানের নেতারাও শান্তির পক্ষে অবস্থান নিয়ে ইতিবাচক মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। তাদের মধ্যেও মতপার্থক্য ছিল না, এমন নয়। তবে শেষ পর্যন্ত তা টেকেনি। তালেবাননেতাদের অবস্থান নেতিবাচক হলে আলোচনাই হতো না, চুক্তি তো পরের কথা। শুভবুদ্ধিই তাদের চুক্তিস্বাক্ষরে অনুপ্রাণিত ও বাধ্য করেছে। সঙ্গতকারণেই চুক্তিস্বাক্ষরকে আমরা স্বাগত জানাই এবং এটা সম্ভব করে তোলায় দু’পক্ষকেই সাধুবাদ জানাই।

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে দীর্ঘতম যুদ্ধ হিসাবে এ যুদ্ধ পরিগণিত হয়েছে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে আফগানিস্তানভিত্তিক আল কায়েদার হামলার কয়েক সপ্তাহ পর দেশটিতে মার্কিন সামরিক আগ্রাসন ও হামলা শুরু হয়। তার পশ্চিমা মিত্ররাও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। সেই থেকে গত ১৮ বছর ধরে যুদ্ধ চলছে। এ যুদ্ধে উভয় পক্ষে ব্যাপক লোকক্ষয় ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তালেবান ও আফগান সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য কতজন এ যুদ্ধ নিহত বা আহত হয়েছে, মার্কিনসহ বিদেশী সৈন্যই বা কতজন নিহত অথবা আহত হয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। বেসামরিক আফগান নাগরিক কতজন হতাহত হয়েছে তাও জানা যায় না। আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি ২০১৯ জানুয়ারিতে জানান, ২০১৪ সাল থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর ৪৫ হাজার সদস্য নিহত হয়েছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাহিনীর সাড়ে তিন হাজার সদস্য, যার মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার মার্কিন সেনা, নিহত হয়েছে। জাতিসংঘের ২০১৯ সালের প্রতিবেদন মতে, যুদ্ধে ৩২ হাজার বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াটসন ইন্সটিটিউটের হিসাবে, ৪২ হাজার যোদ্ধা নিহত হয়েছে। যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই থেকে তিন ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। অন্য এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ২০০১ সাল থেকে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক ও সিরিয়া দ্বন্দ্বে প্রায় ৫ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলারের মূল্য দিতে হয়েছে। যুদ্ধে নয়, মানব কল্যাণে এই অর্থ ব্যয় হলে তারা আরো নিরাপদ হতে পারতো। শান্তি যে যুদ্ধের মাধ্যমে আসতে পারে না, অতীতে বিভিন্ন যুদ্ধের মত আফগানযুদ্ধেও সেটা প্রমাণিত হয়েছে। যুদ্ধ প্রাণহানি ও ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই দেয় না, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়ার, লিবিয়া ইত্যাদি এখনকার শোচনীয় অবস্থা তার সাক্ষ্য বহন করে। আফগান-মার্কিন যুদ্ধকে এক অনি:শেষ যুদ্ধ হিসাবে অভিহিত করেছেন বিশেষজ্ঞগণ। আফগান জাতির ইতিহাস যারা জানেন, তারা স্বীকার করবেন, বহিরাগত কোনো শক্তি এ জাতিকে পরাভূত করতে পারেনি। ব্রিটিশ মহাশক্তি পারেনি, রুশ পরাশক্তিও পারেনি। যত শক্তিধরই হোক যুক্তরাষ্ট্রকেও ছিল এই পরিনতিই বরণ করতে হতো। এটা ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। যুক্তরাষ্ট্রের সমর বিশারদ ও সেনানায়কদের অনেকেই স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন, যুদ্ধে তারা জিতবেন না। জেতার কোনো সম্ভাবনাই নেই। এমতাবস্থায়, যুদ্ধ থেকে সম্মানজনকভাবে সরে দাঁড়ানোর উপায় খুঁজতে গিয়েই তালেবানের সঙ্গে আলোচনা ও শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টি সামনে আসে। এ চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্যে দিয়ে এটা সাধারণভাবে প্রমাণিত হলো যে, কোনো স্বাধীনতাপ্রিয় ও আত্মমর্যাদাশীল জাতি বা দেশকে কোনো বাইরের শক্তি অবনত বা পরাধীন করতে পারে না। তাদের ওপর নিজ সংস্কৃতি বা কোনো কিছু চাপিয়ে দিয়ে বিজয় অর্জন করতে পারে না।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, তালেবানের শর্ত মেনেই যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। আবার তালেবানও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু শর্ত কবুল করে নিয়েছে। চুক্তি অনুুযায়ী, আগামী ১৪ মাসের মধ্যে আফগানিস্তান ছাড়তে হবে মার্কিন ও ন্যাটো সেনাদের। এখন সেখানে প্রায় ১২ হাজার বিদেশী সৈন্য রয়েছে। চুক্তি মতে, এখন থেকে আফগানিস্তানে আর কোনো হামলা চালাবে না তালেবান। এছাড়া তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় আল কায়েদার কোনো তৎপরতা চালাতে দেবেনা। স্বাক্ষরিত চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব উভয়পক্ষেই সমান। বলা হয়েছে, অত:পর আফগান সরকার ও তালেবান কর্তৃপক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলতে থাকবে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র দায়িত্বশীল দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করেছে এবং তালেবান যাতে কথা রাখে সেদিকে খেয়াল রাখবে। তালেবান মুখপাত্র জবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেছেন, আমরা আশা করি, যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিশ্রুতির প্রতি অনড় থাকবে। তিনি এও জানিয়েছেন, যে কোনো ধরনের হামলা থেকে বিরত থাকার জন্য তালেবানের সদস্যদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি বলেছেন, শান্তিচুক্তির সাফল্য তালেবানের প্রতিশ্রুতি পালনের ওপর নির্ভর করছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশী বলেছেন, এ শান্তিচুক্তি তরান্বিত করতে পাকিস্তান তার দায়িত্বের অংশ পূরণ করেছে। একটি শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল, একতাবদ্ধ, গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ আফগানিস্তানের জন্য পাকিস্তান সমর্থন দিয়ে যাবে। বলা বাহুল্য, শান্তিচুক্তি মানে শান্তি নয়, এটা শুরু মাত্র। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও যেমনটা বলেছেন, এ চুক্তির মধ্য দিয়ে শান্তির সূচনা হলো। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেসও বলেছেন, আফগানিস্তানে একটি স্থায়ী রাজনৈতিক নিষ্পত্তির লক্ষ্যে এ চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। ‘শান্তির, সূচনা,’ ‘রাজনৈতিক নিষ্পত্তির পথে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি’ এগিয়ে নিতে আন্তরিক সদিচ্ছা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও বিচক্ষনতার পরিচয় দিতে হবে, আফগান সরকার, তালেবান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। তালেবানের ব্যাপারে দেশে-বিদেশে অনেক নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। তালেবানকে তা অপনোদন করতে হবে। ধর্মনিষ্ঠার পাশাপাশি তাদের আধুনিক, উদার, সহৃদয় ও সহনশীল হতে হবে। ইতোমধ্যে তালেবান জানিয়েছে, তারা সহিংস পথ ছেড়ে উদার ইসলামের দিকে এগিয়ে যাবে। তারা তাদের আদর্শের আধুনিকায়ন করছে। নারীদের ব্যবসা, মালিকানা, শিক্ষা, চাকরি, সঙ্গী নির্বাচন ইত্যাদি অধিকার দেবে। এ দৃষ্টিভঙ্গী ও মনোভাব অত্যন্ত গ্রহণীয় ও ইতিবাচক। তাদের নতুন পথে অগ্রযাত্রকে আমরা স্বাগত জানাই। আফগানিস্তান শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হোক, এটাই আমাদের একান্ত কামনা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন