বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

কুলকাঠিতে শাসক ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠির নির্মম মুসলিম গণহত্যা

মাহমুদ ইউসুফ | প্রকাশের সময় : ২ মার্চ, ২০২০, ১২:০২ এএম

মার্চ ২, ১৯২৭। কুলকাঠি গণহত্যা। বরিশালের ইতিহাসের মর্মান্তিক ট্রাজেডি। শাসকচক্র ও সাম্প্রদায়িক শক্তি কত নির্মম, নিষ্ঠুর হতে পারে সেদিন বোঝা গিয়েছিল। ঘাতকরা কত মমতাহীন, কত হৃদয়হীন কুলকাঠি হত্যাকন্ডে কাহিনী না জানলে বুঝা যাবে না। হৃদয়বিদারক, লোমহর্ষক, কলঙ্কময় ঘটনা হলো কুলকাঠিতে নির্বিচার গণহত্যা হয়েছিল। আজ থেকে ৯৩ বছর আগে বাংলা ১৩৩৩ সনের ১৮ ফাল্গুন মসজিদের পবিত্রতা রক্ষা করতে গিয়ে বাকেরগঞ্জ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ই. এন. ব্লান্ডির হুকুমে গুর্খা সৈন্যদের গুলিবর্ষণে শহিদ হন ঝালকাঠি জেলার কুলকাঠি এলাকায় ১৯ জন মুসলিম। একই সময় আহত হন আরো বহু মানুষ। ঐতিহাসিক ও বেদনাময় এ দিনটি সম্পর্কে বরিশালের ইতিহাস গবেষক আজিজুল হক বান্না বলেন, ‘কুলকাটির হত্যাকান্ড বরিশালের মুসলমানদের মধ্যে নৃশংসতার স্মৃতি জাগায়।’ [বরিশালে ইসলাম, পৃষ্ঠা ২৮৩]

ঝালকাঠি শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত সুগন্ধা নদীর দক্ষিণ তীরে সদর উপজেলার পোনাবালিয়া ও নলছিটি উপজেলার কুলকাঠি দুটি ইউনিয়ন ছিলো ঘটনাস্থল। হিন্দু সম্প্রদায় গান-বাজনা, ঢোল-বাদ্য বাজিয়ে মাসজিদ সংলগ্ন সড়ক দিয়ে মেলায় যাতায়াত করায় মুসলিমদের ইবাদতে ব্যাঘাত ঘটে। তারা মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েই যাচ্ছিল অব্যাহতভাবে। বিষয়টি নিয়ে মাসজিদের খতিব মৌলভি সৈয়দ উদ্দিনের নেতৃত্বে মুসল্লিরা হিন্দু নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনা করে সুফল লাভে ব্যর্থ হয়। এ অবস্থায় মুসলিমরা মাসজিদের পাশের সড়ক দিয়ে স্বাড়ম্ভরে ঢোল বাজিয়ে যেতে না দেয়া, অপরদিকে হিন্দুরা বাধ্য-বাজনা সহকারেই শিব মন্দিরে যাবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করে। খবর পেয়ে নামজাদা হিন্দু নেতা সতীন্দ্রনাথ সেন একদল ‘হিন্দু স্বেছাসেবক’ নিয়ে শিববাড়ি-কুলকাঠি এলাকায় অবস্থান নেন। শান্তি ভঙ্গের আশঙ্কায় বাকেরগঞ্জের তদানীন্তন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ই. এন. ব্লান্ডি, পুলিশ সুপার মি. টেলর এবং সদর এসডিও জিকে বিশ্বাস ২ মার্চ বুধবার, গুর্খা বাহিনী নিয়ে কুলকাঠি আসেন। দুই পক্ষের বিরোধের এক পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট ব্লান্ডি মুসলমানদের ওপর গুলি করার জন্য গুর্খা সৈন্যদের নির্দেশ দিলে ঘটনাস্থলেই শাহাদাত বরণ করেন ১৯ জন মুসল্লি আর আহত হন অনেকেই। কংগ্রেস নেতা ড. শ্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘মুসলমান ইনসান হৌ তো জানোয়ার কৌন হো অর্থাৎ মুসলমানরা যদি মানুষ হয় তাহলে জন্তু জানোয়ার কারা?’ পশু হত্যার মতোই ইংরেজ সরকার ও সাম্প্রদায়িকগোষ্ঠি মানুষ হত্যায় মেতে ওঠে কুলকাঠিতে। মুহূর্তের মধ্যে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে অসংখ্য মুসলমান। সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। চাখারের উকিল মফিজউদ্দিন ও সৈয়দ হাবিবুর রহমান প্রমুখের নেতৃত্বে ১৯২৭ সালে কুলকাঠি হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে পিরোজপুরে আন্দোলন সংগঠিত হয়। কুলকাঠিতে মুসলিমদের ওপর গণহত্যার নাটের গুরু ছিলেন সতীন্দ্রনাথ সেন ও তাঁর সত্যাগ্রহ আন্দোলন। সিরাজউদ্দীন আহমেদ লিখেছেন, ‘নিজ ধর্মের উপর তার অগাধ ভক্তি বরিশালের রাজনীতির ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করে। অনেক কংগ্রেস নেতা ও বিপ্লবী দল তার সাথে একমত ছিল না এবং তাকে সত্যাগ্রহ আন্দোলন হতে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ জানায়। কিন্তু তবু তিনি পটুয়াখালীতে সত্যাগ্রহ আন্দোলন চালিয়ে যান।’ [বরিশালের ইতিহাস, পৃষ্ঠা ৬০১-৬০২]

কুলকাঠি-পোনাবালিয়ার হত্যাকন্ডেে পুরো বাকেরগঞ্জ জেলাসহ দেশজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। বরিশালে ময়না তদন্তের পর হেমায়েত উদ্দিন মাঠে অনুষ্ঠিত জানাজায় শোকে মুহ্যমান হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন। পরে শহিদদের স্বজনরা গ্রামে এনে মাসজিদের কাছে দাফন করেন। শহিদদের নাম: বাবর উল্লাহ হাওলাদার, গাজি আফেল, নঈম উদ্দিন হাওলাদার, এয়াসিন আকন, আতামুদ্দিন হাওলাদার, হাসান উল্লাহ হাওলাদার, মোসলেম উদ্দিন, মোহন মোল্লা, সিরাজ উদ্দিন, সুন্দর খান, ছবদার খান, মফেজ হাওলাদার, রহমালি হাওলাদার, বলু খান, রিয়াজ উদ্দিন, জাহের তালুকদার, জহির উদ্দিন হাওলাদার, আবুল হোসেন হাওলাদার ও ফরমান উল্লাহ। তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের পত্রপত্রিকায় ফলাও করে এ নৃশংস হত্যকান্ডের খবর প্রকাশ করা হয়। খবর পেয়ে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক কুলকাঠিতে ছুটে এসে এক জনসভা করেন। হত্যাকন্ডেের নায়কব্লোন্ডিকে ‘ব্লাডি’ বলে আখ্যায়িত করেন। নরহত্যার অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়। সরকার পক্ষ মামলায় হেরে গিয়ে প্রত্যেক শহিদ পরিবারের জন্য চরমোয়াজানে জমি বরাদ্দ দেয়। তবে সরকারপক্ষ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ব্লান্ডি ক্ষমা প্রার্থনাও করেন। ১৯ শহিদের স্মৃতিরক্ষার্থে কুলকাঠির চন্ডিপ্রসাদ হাইস্কুলটির নামকরণ করা হয় ‘কুলকাঠি শহীদিয়া ইউনিয়ন একাডেমী’ যা বর্তমানে কুলকাঠি শহিদীয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় নামে পরিচিত। পরে সেখানে ‘শহীদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ ও ‘কুলকাঠি শহীদিয়া দাখিল মাদ্রাসা’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মরহুম কামরুদ্দীন আহমদ লিখেছেন, ‘মসজিদের সম্মুখের রাস্তা দিয়ে জোর করে বাদ্য বাজিয়ে মিছিল করার জন্য হিন্দুদের জেদ ও মুসলমানদের হিন্দুরা দেখতে পায় এমনি স্থানে গরু জবাই-এ নিয়ে বরিশালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধতে লাগল। সবচেয়ে বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটে ১৯২৭ সনে কুলকাঠিতে, সেখানে পোনাবালিয়ার মসজিদের সম্মুখে। বরিশালে বিখ্যাত হিন্দু নেতা সতীন সেন (পরবর্তীকালে বরিশাল কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট) নেতৃত্বে এমনি একটি মিছিল নামাজের সময় মসজিদের সম্মুখে পৌঁছালে মুসলমানেরা বাধা দেবার জন্য প্রস্তুত হয়। পুলিশ পরিস্থিতির কথা পূর্বাহ্নেই অনুমান করেছিল। উপরে খবর দেবার ফলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ই. এন. ব্লান্ডি, পুলিশ সুপার টেইলর, ভূতনাথ দারোগা (তখন সে ইন্সপেক্টর হিসাবে প্রমোশন পেয়েছে) সরেজমিনে উপস্থিত ছিলেন। মুসলমানরা বাদ্য বাজিয়ে মিছিল যেতে দিতে অস্বীকার করলে-১৪৪ ধারা জারী করা হয় এবং তাদের পথ থেকে সরে যেতে বলে-কিন্তু তাতে কোন ফল হয় না-তখন গুলি চালানোর জন্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদেশ দেয়, যার ফলে সতের জন মুসলমান ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। তাছাড়া মসজিদের মধ্যে যারা ছিল তারাও অনেকে আহত হন, এর ফলে বরিশালের মুসলমানদের মধ্যে যারা ছিল তারাও অনেকে আহত হন, এর ফলে বরিশালের মুসলমানদের মধ্যে এক তীব্র আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে এর কিছুকাল আগে পটুয়াখালীর ডেপ্টি ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল হালিম চৌধুরীকে মসজিদ থেকে সকালে নামাজ পড়ে বেরুবার সময় সতীন সেন নিজে লোহার রড্ দ্বারা আঘাত করেন-আঘাত মাথায় না লেগে তার ডান কাঁনে লাগে এবং তিনি ভূমিতে পরে যান, পরবর্তীকালে হালিম চৌধুরী সাহেবের সন্তানরা-কবির চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী ও নাদেরা বেগম সাম্প্রদায়িকতার বিরোধীতা করেছেন এবং ধর্মনিরপেক্ষতায় আস্থা রেখেছেন।’ [কামরুদ্দীন আহমদ: বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ, অখন্ড সংস্করণ, ধ্রুপদ সাহিত্যাঙ্গন, বাংলাবাজার ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০০৬, পৃষ্ঠা ৫৯] এত বড় ঘটনা কালের সাক্ষী হিসেবে থাকলেও বর্তমান প্রজন্মের কাছে সে ইতিহাস অজানাই থেকে যাচ্ছে। আর পাঠ্যপুস্তকে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, ইতিহাসের নামে মতলববাজদের ভাঁড়ামীপূর্ণ কীর্তিকাহিনী। সিলেবাস প্রণেতাদের উচিত এসব জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা একাডেমিক বই-পুস্তকের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট উপস্থাপন করা।
লেখক: গবেষক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন