রাজধানী ঢাকা বায়ুদূষণের শিকার শহরগুলোর তালিকায় প্রায়ই শীর্ষে থাকছে। আর বায়ুদূষণের প্রধান কারণ হচ্ছে ধুলা। অপরিকল্পিতভাবে শহরের যেখানে-সেখানে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও উন্নয়ন কাজের জন্য রাজধানীর বাতাসে ছড়াচ্ছে ধুলা। আর তাতে বিষাক্ত হচ্ছে রাজধানীর বাতাস। বায়ুমান সূচকে ঢাকার বাতাস প্রায়ই ২৫০ পিএম থেকে ৩০০ পিএম-এ পৌঁছে যাচ্ছে। যা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। এই ধুলাদূষিত বিষাক্ত বাতাস থেকে বাঁচতে অনেকে মুখে মাস্ক পরে রাস্তায় চলাচল করছেন। তার পরও নগরবাসী সর্দি-কাশিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরাই এসব রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।
কিছুদিন আগেও বায়ুদূষণের প্রধান কারণ ছিল রাজধানীর আশপাশে গড়ে উঠা অবৈধ ইটভাটার কালো ধোঁয়া। উচ্চ আদালতের নির্দেশে পরিবেশ অধিদপ্তর গত মাসে অভিযান চালিয়ে অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে দিয়েছে। তার পরও বায়ুদূষণের শহর হিসেবে ঢাকা ঘুরে ফিরে প্রথম স্থানে থাকছে কেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত চার কারণে রাজধানীবাসী বায়ুদূষণের শিকার হচ্ছে। এর মধ্যে ধুলাদূষণ হলো অন্যতম প্রধান কারণ। দ্বিতীয়ত, পুরনো যানবাহনের আধিক্য ও এসবের কালো ধোঁয়া। তৃতীয়ত, শহরের আশপাশের শিল্প-কলকারখানার দূষণ। চতুর্থত, শহরের ভেতরে যে ময়লা আবর্জনা জমে সেগুলো পোড়ানোর ধোঁয়া। পরিবেশ অধিদপ্তর যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ায় এই পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন ঘটছে না বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থানও প্রথম দিকেই। রাজধানী ঢাকায় দেড় কোটিরও বেশি মানুষের বসবাস। পরিবেশবিদরা বলছেন, অন্য দেশগুলো তাদের বড় শহরগুলোর বায়ুদূষণ রোধে যেখানে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, সেখানে ঢাকা অনেকটাই ব্যর্থ। ধুলাদূষণ রোধে সকাল বিকাল পানি ছিটানো এবং নির্মাণ কাজের স্থান ঢেকে রাখার জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশ থাকার পরও পরিবেশ অধিদপ্তর কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। শহরের মধ্যে উন্নয়নকাজের ফলে সৃষ্ট ধুলাদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না দুই সিটি করপোরেশন। দূষণের আরেক বড় উৎস ঢাকার বর্জ্য, আর এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনারও আধুনিকায়ন করতে পারেনি দুই সিটি করপোরেশন।
বায়ুদূষণ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম বলেন, অন্যদেশের তুলনায় আমাদের দেশে দূষণ বেশি। কারণ আমাদের এক্টিভিটি বেশি। কন্সট্রাকশন বেশি, আর নিয়ন্ত্রণের কোনও ব্যবস্থাও নেই। দিল্লি বা কাঠমান্ডুতেও দূষণ হচ্ছে। তারাও মাঝে মাঝে দূষণের শীর্ষে চলে আসে। কিন্তু ঢাকার মতো ধারাবাহিকভাবে প্রথম হয়নি। এছাড়া এসব দেশ বায়ুদূষণ রোধে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। আমরা সে তুলনায় কিছুই করছি না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধুলোবালির মধ্যে মূলত ছয় ধরনের পদার্থ ও গ্যাসের কারণে ঢাকায় দূষণের মাত্রা বেড়ে গেছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণা অর্থাৎ পিএম ২.৫ এর কারণেই ঢাকায় দূষণ অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। ক্ষতিকর ছয় ধরনের পদার্থের মধ্যে প্রথমেই আছে পিএম (পার্টিকুলেটেড ম্যাটার) ২.৫ অথবা ২ দশমিক ৫ মাইক্রো গ্রাম সাইজের ক্ষুদ্র কণা। এরপর পিএম-১০ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এই ধূলিকণার আকার বোঝাতে হলে উদাহরণ হিসেবে বলতে হবে, মাথার চুলের ডায়ামিটারের (ব্যাস) ৬ ভাগের এক ভাগ হচ্ছে ২ দশমিক ৫। এটি এত ক্ষুদ্র, যা খালি চোখে দেখা যায় না। বাকি চারটির মধ্যে আছে সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন, কার্বন মনোক্সাইড এবং সিসা। এই ছয় পদার্থ ও গ্যাসের ভগ্নাংশ গড় করেই বায়ুর স‚চক নির্ধারণ করা হয়। সেই সূচককে বলা হয় এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স।
বায়ুদূষণের সূচকে ঢাকার সূচক ৫০ হলে তা দূষণের পর্যায়ে পড়বে না। কিন্তু গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের বেশ কয়েকদিন বারবার সূচকের মাত্রা ২৫০ পিএম থেকে ৩০০ পিএম-এ গিয়ে ঠেকেছে। যখন ঢাকা প্রথম স্থানে থাকে তখন দেখা যায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা শহরগুলোর তুলনায় ঢাকার সূচকের মান প্রায় ১০০ বেশি, যা খুবই উদ্বেগজনক।
১০১ থেকে ১৫০ স‚চক হলে সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। ১৫০-২০০ স‚চক হলে সেটি অস্বাস্থ্যকর। আর সূচক যদি ২০০ থেকে ৩০০ হয় তাহলে সেটি খুবই অস্বাস্থ্যকর। ৩০০-এর ওপরে হলে সেটিকে দুর্যোগপূর্ণ বলা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের বায়ুমান যাচাই বিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘এয়ার ভিজ্যুয়াল’-এর বায়ুমান সূচকে (একিউআই) এ বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা ১০ মিনিটে ঢাকা বায়ুদূষণের শীর্ষে ছিল। সেদিন সূচক ছিল সর্বোচ্চ ৩৩২। এরপর ২৭ ফেব্রুয়ারি বিকালে ঢাকা ছিল অষ্টম অবস্থানে। সূচক ১৫১। তখন তিন দিন অল্প বৃষ্টির কারণে বায়ুদূষণের মাত্রা কিছুটা কমে আসে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরিফ জামিল বলেন, রাজধানীতে বায়ুদূষণের মাত্রা ভয়াবহ। উন্নয়নের নামে যেখানে সেখানে খোঁড়াখুঁড়ির ফলে ধুলায় ধূসর হচ্ছে ঢাকার বাতাস। উচ্চ আদালত ধুলার স্থানে দুবেলা পানি ছিটাতে বললেও এটা কার্যকর হচ্ছে না। এ ছাড়া ঢাকায় অজস্র পুরানো আনফিট গাড়ি চলাচল করছে। এসব গাড়ি থেকে বের হচ্ছে কালো ধোঁয়া। এতেও ঢাকার বায়ুদূষিত হচ্ছে। সব মিলিয়ে ঢাকা শীর্ষ বায়ুদূষণের শহর হচ্ছে বার বার। তিনি বলেন, বায়ুদূষণের তালিকার শীর্ষ থেকে নামতে হলে সরকারি সংস্থাগুলোকে তাদের কাজের পরিধি বড় করতে হবে, দায়িত্বশীল হয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
তবে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে এ বিষয়ে একমত নয় পরিবেশ অধিদপ্তর। তারা বলছে, বায়ুদূষণ কমাতে এরইমধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই চলছে বায়ুদূষণ বিরোধী অভিযান। এরইমধ্যে ভেঙে দেওয়া হয়েছে অবৈধ অনেক ইটভাটা। বন্ধ করা হয়েছে অনেক শিল্প-কারখানা। বড় বড় রাস্তায় প্রায়ই পানি ছিটানো হচ্ছে। পুরনো গাড়ি চলাচল যাতে না করতে পারে সেজন্য নির্দেশনা অনুযায়ী অভিযান চালানো হচ্ছে। এমনকি সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে লিফলেট বিলি, পোস্টার ছাপানো এবং বিলবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। পরিবেশ অধিদফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কাজী তামজীদ আহামেদ বলেন, ‘আমরা বায়ুদূষণ রোধে প্রায় প্রতিদিনই অভিযান পরিচালনা করছি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন