বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ভারতে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি এবং মুসলমান নিধনের নেপথ্য রাজনীতি

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৪ মার্চ, ২০২০, ১২:০২ এএম

উপমহাদেশের রাজনীতি ও সামাজিক-অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে ভারতীয় সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাতচল্লিশের ভারতবর্ষ ভাগের পর থেকে ভারতে একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির মূল চালিকা শক্তি হিসেবে যে বিষয়টি সদা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে তা’ হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের আওতায় সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের একটি আইনগত ভিত্তি গড়ে তোলা। তবে উপমহাদেশের বিভক্তি নিয়ে যেমন শুরু থেকেই চরম মতভেদ ছিল, কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষতার বাইরে এবং আড়ালে হিন্দুত্ববাদী একটি চরম ধর্মান্ধ মুসলিম বিদ্বেষী শক্তি সব সময়ই সক্রিয় ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোটের রাজনীতির মুখোশে এরা ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করে এক সময় রাষ্ট্রক্ষমতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। ভারতে শত বছরের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ইতিহাস থাকলেও আরএসএস, বজরংদল সমর্থিত হিন্দুত্ববাদী বিজেপির দিল্লির রাজনীতির নিয়ন্ত্রক শক্তিতে পরিণত হওয়ার ইতিহাস একবিংশ শতকের সাম্প্রতিক ঘটনা। পশ্চিমা ধাঁচের আধুনিক গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রতিযোগিতায় বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে ৭ দশক ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল ভারত। সেই অগ্রগসরমান ভারতের রাজনীতিতে ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক বিভেদ ছড়িয়ে সব অর্জনকে ¤øান ও থমকে দেয়ার পাশাপাশি শতকোটি মানুষের ভারত রাষ্ট্রকে একটি মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দেয়ার ন্যক্কারজনক অপরিণামদর্শী তৎপরতায় পুরো উপমহাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও মানবাধিকারের দাবি চরম হুমকির মধ্যে পড়তে শুরু করেছে। গত বছরের আগস্টে কাশ্মিরের স্বায়ত্বশাসন ও বিশেষ মর্যাদা তুলে নেয়ার মধ্য দিয়ে সেখানে যে মানবিবক বিপর্যয় সৃষ্টি করা হয়েছিল, তা থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি কেন্দ্র শাসিত সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির। প্রায় ৬ মাস ধরে কাশ্মিরকে শুধু বিশ্ব থেকেই নয়, ভারত থেকেও কার্যত বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। লাগাতার কার্ফিউ, গণগ্রেফতার, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা হরণ, মানুষের স্বাভাবিক চলাচল ও কাজকর্মের সুযোগ সীমিত করার পাশাপাশি মোবাইল নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগের সব মাধ্যমগুলোকে বন্ধ রেখে কাশ্মিরে কী করা হচ্ছে সে সম্পর্কে কেউ কিছু বলতে পারে না। ভারতীয় বাহিনী কাশ্মিরের সব প্রতিবাদী কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়ার পাশাপাশি টার্গেটেড কিলিং এবং এথনিক ক্লিনজিংয়ের মতো অপরাধ করছে বলে কেউ কেউ ধারণা করছেন। প্রকৃত ঘটনা বা অবস্থা যাই হোক, বিশ্ব থেকে ও গণমাধ্যম থেকে কাশ্মিরকে আড়ালে রাখার মধ্য দিয়ে ভারত সরকার কাশ্মিরে সন্দেহজনক বা আশঙ্কাজনক কিছু একটা করছে এমন ধারণা করা অমূলক নয়। সত্য প্রকাশের সব পথ যখন রুদ্ধ হয়ে পড়ে তখন প্রকৃত ঘটনাও অনুমানে গুজবে পরিণত হতে পারে। ভারতীয় ও আন্তজার্তিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো কাশ্মিরের পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ অব্যাহত রেখেছে।

কাশ্মিরিদের প্রতিবাদ বা বোবাকান্নাকে ধামাচাপা দেয়ার সক্ষমতা ভারতীয় রাষ্ট্রশক্তির নেই বলেই সব অপরাধ-অপকর্ম বিশ্বসম্প্রদায়ের দৃষ্টির বাইরে রাখতেই সেখানে একটি অন্ধকার কনফাইনমেন্ট সৃষ্টি করা হয়েছে। ভারতীয় সংবধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে কাশ্মিরে স্বায়ত্ব শাসন ও বিশেষ মর্যাদা হরণের পর থেকে উত্তপ্ত ও বিস্ফোরন্মুখ কাশ্মিরে খুব শীঘ্রই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রæতি দিলেও অদ্যাবধি তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কাশ্মিরের বর্বর শাসন, বিতর্কিত এনআরসি এবং সিএএ আইনের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের নাগরিকত্বহীন করার বাস্তবতায় পাকিস্তানের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ ও উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি ভারতে মসলমান গণহত্যার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। গত একমাস ধরে ভারতে মুসলমান অধ্যুষিত শহর, অঞ্চল, জামেয়া মিল্লিয়া, হায়দারাবাদ ইউনিভার্সিটিসহ সিএএ’র প্রতিবাদে মুখর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পুলিশের রক্তাক্ত প্রাণঘাতি অ্যাকশন এবং সর্বসাম্প্রতিক দিল্লির দাঙ্গায় মুসলমানদের রক্ত ঝরার মধ্য দিয়ে ইমরান খানের আশঙ্কাই যেন বাস্তবে প্রমাণিত হতে দেখা যাচ্ছে।

সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরোধীদের শায়েস্তা করতে রাস্তায় নেমে আসা হিন্দুত্ববাদীরা মুসলিম অধ্যুষিত উত্তর-পূর্ব দিল্লিকে দাঙ্গার আগুন ও তান্ডবের নগরীতে পরিণত করেছে। নতুন প্রজন্ম ছেচল্লিশের দাঙ্গার ইতিহাস হয়তো শুনেছে, গুজরাটের দাঙ্গার ইতিহাসও হয়তো অনেকে শুনেছে, কেউ কেউ প্রত্যক্ষ করেছে। তারা এখন দিল্লির দাঙ্গা দেখছে, দাঙ্গার আগুনে, জয়শ্রীরাম বলে উন্মত্ত হিংসার অস্ত্রে নিরীহ মানুষের দেহকে ছিন্নভিন্ন করার বিভৎস ঘটনাবলীর নতুন সাক্ষী হলো ভারতের রাজধানী দিল্লির মানুষ, সমগ্র ভারতবাসী ও বিশ্বসম্প্রদায়। উত্তর-পূর্ব দিল্লি যখন হিংসার আগুনে জ্বলছিল তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম ভারত সফরে চোখ ধাঁধানো আলোক সজ্জায় জ্বলমল করছিল দিল্লির প্রধান রাজপথ ও রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন ও হোটেলগুলো। উত্তর-পূর্ব দিল্লির মুসলমান নরনারীরা যখন হিন্দুত্ববাদী উন্মত্ত হায়েনাদের হাত থেকে বাঁচতে পুলিশ, প্রশাসন ও ক্ষমতাসীনদের সাহায্য চেয়ে আর্তনাদ করছিল, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তখন মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাথে রাজকীয় নৈশভোজে মগ্ন। আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নরেন্দ্র মোদির ধর্মীয় স্বাধীনতার নীতির প্রশংসার পাশাপাশি মুসলমান জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কড়া হুঁশিয়ারি ও ঐক্যবদ্ধ অ্যাকশনের ঘোষণা দিচ্ছিলেন। তাঁদের এমন ঘোষণায় অনুপ্রাণিত হয়েই উন্মত্ত সঙ্গীণ হাতে জয়শ্রীরাম বলে মুসলমান এবং সাম্য ও মানবাধিকারপন্থী প্রতিবাদী মানুষের উপর হিং¯্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। শিশু-সন্তানদের নিয়ে নিরীহ নিরস্ত্র মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটাছুটি করেছে। আবার কেউ কেউ প্রাণ বাঁচানোর আশা ছেড়ে দিয়েই সর্বশক্তিতে প্রতিরোধ গড়ে তোলারও চেষ্টা করেছে। এভাবেই পাল্টা হামলার শিকার হয়েও কিছু মানুষ হতাহত হয়েছে। গত সোমবার পর্যন্ত্র দিল্লির দাঙ্গায় অর্ধশতাধিক মানুষের প্রাণহানি এবং ৩ শতাধিক আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। দুই দিনের দাঙ্গায় ৫ শতাধিক গাড়ি, প্রায় একশ বাড়ি, ৫৭টি দোকান ছাড়াই বেশ কয়েকটি কারখানা, গুদামঘর ছাড়াও বেশ কয়েকটি স্কুল-মাদরাসা ও মসজিদ আক্রান্ত হয়েছে দিল্লী পুঁজিবাজারে তরফ থেকে ২৫ হাজার কোটি রুপি লোকসানের কথা বলা হয়েছে । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, উন্মত্ত হিন্দুত্ববাদী কয়েকজন একটি মসজিদের সুউচ্চ মিনারে চড়ে মিনারে শোভিত চাঁদ-তারার কারুকাজ ভেঙ্গে সেখানে হিন্দুত্ববাদের পতাকা উড়িয়ে দিচ্ছে। বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, মুসলমান মালিকানাধীন এক বাড়ির ড্রয়িংরুমে শতাধিক নারী ও শিশু প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ির মালিক অসহায় মানুষদের আশ্রয় দিয়েছেন। অন্যদিকে মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় হিন্দু মন্দির রক্ষায় মুসলমানদের পাহারা বসানোর খবরও পাওয়া যায়। মুসলমানদের পক্ষ থেকে হিন্দুদের মন্দির আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা না থাকলেও দাঙ্গার হিংসা আরো ছড়িয়ে দিতে নেপথ্যের কুশীলবরা হিন্দু মন্দিরে আক্রমণ করে মুসলমানদের উপর দায় চাপিয়ে দাঙ্গা বাড়িয়ে তোলার আশঙ্কা থেকেই হয়তো মন্দির পাহারার ব্যবস্থা করেছিল তারা। বিজেপি’র নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন মুসলিম বিদ্বেষী, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের পরিপন্থী বিবেচনায় অধিকাংশ ভারতীয় এবং বিশ্বসম্প্রদায়ের দ্বারা নিন্দিত ও পরিত্যাজ্য হয়েছে। এ ধরনের একপেশে আইনের কারণে এমনিতেই বড় ধরনের সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তার আগেই হিন্দুত্ববাদীরা প্রতিবাদী মানুষের উপর নৃশংস তান্ডব ও হত্যাকান্ড চালিয়ে ভারতে হিন্দু-মুসলমানের সহাবস্থানের পরিবেশ নস্যাৎ করে ভারতকে মুসলমানদের অসহনীয় করে তোলাই যেন দাঙ্গাকারীদের মূল লক্ষ্য। এটি যেন ভারতকে আবার ভাগ করারই অপপ্রয়াস। বিজেপি নেতারা যে যা’ই বলুন, ২০ কোটি মুসলমানকে ধর্মান্তরকরণ দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া বা মেরে ফেলা সম্ভব নয়। সিএএ আইন পাশ করার সময় ভারতের পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে মুসলমান ও ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিনিধিরা একে নতুন করে ভারত ভাগের ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করেছিলেন।

সাতচল্লিশে দ্বিজাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে ভারত ভাগের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল ছেচল্লিশের দাঙ্গার মধ্য দিয়ে। হিন্দু-মুসলমানরা হাজার বছর ধরে ভারতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ঐতিহ্য ধরে রখতে সক্ষম হলেও পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষতা ও আধুনিক গণতন্ত্রের যুগে এসে কেন হিন্দু-মুসলমানরা পরস্পরের প্রতি এমন বৈরী ও অসহিষ্ণু হয়ে উঠল? হিন্দু-মুসলমানের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও ঐক্য ভারতে মুসলমান শাসন দীর্ঘায়িত করলেও পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শাসকরা ডিভাইড অ্যান্ড রোল নীতির ভিত্তিতে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ-বৈরিতা লাগিয়ে রাখাকেই অধিক সুবিধাজনক বলে মনে করেছিল। ইনকাম্বেসি ফ্যাক্টর কাজে লাগিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর সমর্থন পেতে মুসলিম বিদ্বেষী হিংসা ছড়িয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে তারা ভারতে দাঙ্গার বিষবৃক্ষ রোপণ করে। হিন্দুদের প্রতি বৃটিশদের পক্ষপাত এবং তাদের প্রতি মুসলমানদের আপসহীন অবস্থানে ঠেলে দেয়। পলাশি যুদ্ধের মাত্র ১৫ বছরের মাথায় বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ও কোম্পানির দেওয়ানি লাভের কারণে এ দেশের হিন্দু-মুসলমান ফকির-সন্যাসীরা ক্ষতিগ্রস্ত ও ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল। ১৭৭১ সালের ফকির-সন্যাসী বিদ্রোহ থেকে এ দেশের স্বাধীনতার আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। সেই ফকির বিদ্রোহ থেকে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ এবং পরবর্তী সব বিদ্রোহ ও আন্দোলন সংগ্রামে রক্তদানকারীদের বেশিরভাগই ছিল মুসলমান। দিল্লির ইন্ডিয়া গেটে যে সব শহীদদের নাম লেখা আছে তার বেশিরভাগই মুসলমান। সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি’র নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধিতাকারী ভারতীয় রাজনীতিক ও পার্লামেন্টারিয়ানদের অনেকেই এই তথ্যটিকে সামনে নিয়ে এসেছেন। মুসলমান সুলতান ও মোঘল স¤্রাটরা ভারত শাসনকালে কখনোই ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে জবরদস্তি করেননি। একজন পশ্চিমা ইহুদি পন্ডিত শেলডন পোলকের মতে, মুসলমান শাসকরা যদি চাইতেন, ভারতে একজন হিন্দুও থাকতো না। তবে ইংরেজরা তাদের ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি ভারতীয়দের মধ্যে প্রোথিত করার পাশাপাশি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শাসন-শোষণ চিরস্থায়ী করার সব চেষ্টাই অব্যাহত রেখেছিল। মুসলমানরা আপসহীন ভূমিকায় না থাকলে বৃটিশদের হাত থেকে ভারত এখনো হয়তো মুক্তি পেত না। সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদীদের হিংসার তান্ডব ও রক্তাক্ত দাঙ্গায় ভারতে মুসলমানের এত রক্ত না ঝরলে ভারত ভেঙ্গে এতগুলো টুকরো হওয়ার আদৌ কোনো প্রয়োজন হতো না। ভারতের স্বাধীনতার ৭০ বছর পেরিয়ে এসে ২০ কোটির বেশি ভারতীয় মুসলমানদের নিয়ে ভেদবুদ্ধি ও নিষ্ঠুর খেলায় মেতে ওঠার নেপথ্যেও পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির স্বার্থ ও কলকাঠি সক্রিয় রয়েছে। ট্রাম্পের ভারত সফরের সময় তার মুসলিম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক বিতর্কিত বক্তব্যের পর দিল্লিতে শুরু হওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনাবলী কি কাকতালীয় নাকি সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির নেপথ্য বার্তা বহন করছে, এই প্রশ্ন অমূলক নয়। আফগানিস্তান ও ইরাকের পর সিরিয়া-লিবিয়া ও ইয়েমেনে যে গণহত্যা চলছে তাতে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতির কুশীলবরা সরাসরি ভূমিকা রাখলেও পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির মদদ ও লজিস্টিক সাপোর্ট এসব যুদ্ধের মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। মার্কিন, বৃটিশ ও ফরাসি অস্ত্রে মুসলমানের হাতে মুসলমানের রক্ত ঝরছে, প্রাণ হারাচ্ছে। কাশ্মিরে, গুজরাটে, দিল্লিতে হিন্দুত্ববাদী গণহত্যার লক্ষ্য ও প্রকৃতি উপমহাদেশের রাজনীতিতে এক সংকট হয়ে দেখা দিতে শুরু করেছে। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থকে খন্ডিত, একদেশদর্শী, জাতিগত বা সাম্প্রদায়িকভাবে দেখার সুযোগ নেই। ভারতে মুসলমান বিদ্বেষী হিন্দুত্ববাদী নৃশংসতা, রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর বৌদ্ধ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস এবং মিয়ানমার বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে জাতিধর্ম নির্বিশেষে বিশ্বসম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ অঙ্গীকার আমাদেরকে বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে বাঁচাতে পারে। তা না হলে ভারতের মুসলিম বিদ্বেষী রাজনীতি উপমহাদেশের জন্য বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

বৃটিশ ঐতিহাসিকরা ভারতের যে ইতিহাস রচনা করেছিলেন, তার মধ্যেই হিন্দু-মুসলমান বিরোধের বীজ বপন করা হয়েছিল। চতুর্দশ শতকে দিল্লির তুঘলক রাজবংশের শেষ প্রান্তে এসে ফিরোজ শাহ তুঘলক উদার, জনহিতকর ও কল্যাণকামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন। সেখানে তার প্রধান অপরাধ হচ্ছে, তিনি ভারতে ইসলামি শরিয়া আইন প্রবর্তনের চিন্তা করেছিলেন এবং তিনি দিল্লির নানা স্থানে অনেক মসজিদ, মাদরাসা, মক্তব, কলেজ, হাসপাতাল স্থাপন করার পাশাপাশি সমাজে আলেম-ওলামা-মাশায়েখদের বিশেষ মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছিলেন। জায়গির প্রথা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে জমিদারি প্রথা তথা ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণ করেছিলেন। বিশেষত: ইসলামি শরিয়া আইন এবং প্রভাবশালী হিন্দু রাজাদের বিরুদ্ধে তার সামরিক অভিযান ও কর্মকান্ডে গোঁড়া হিন্দুদের সমর্থন না থাকায় ফিরোজ শাহ তুঘলকের কিছু সামরিক-অর্থনৈতিক পদক্ষেপকে ‘তুঘলকি কান্ড’ অভিহিত করে বহুগুণে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করা হয়েছে। দিল্লির পরবর্তী সুলতানরা অবশ্য ফিরোজ শাহ তুঘলকের পদাঙ্ক থেকে সরে গিয়ে হিন্দুদের মন রক্ষা করেই দেশ শাসনের নীতি গ্রহণ করেছিলেন। স¤্রাট আকবর ইসলামের শিক্ষার সাথে হিন্দু ধর্মের সমন্বয়ে যে নতুন ধর্মীয় চিন্তাকে তুলে ধরেছিলেন, তা হিন্দু অভিজাতদের সমর্থন লাভে সক্ষম হয়েছিল। রণথাম্ভোর, কালিঞ্জরের মতো রাজপুত দুর্গ, পাটনা, গুজরাটসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য মোঘল সা¤্রাজ্যভুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে গ্রেটার ইন্ডিয়ার ভিত্তি গড়ে ওঠে দিল্লির নিয়ন্ত্রণ সুবিস্তৃত হয় এবং তার প্রতি হিন্দু অভিজাত শ্রেণির সমর্থন বেড়ে যায়। এখন ভারত যখন হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ঘূর্ণিপাকে নাস্তানাবুঁদ, এমনকি বিজেপির একশ্রেণির নেতা-কর্মী ভারতের জাতির পিতা হিসেবে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকেও অগ্রাহ্য করতে চায়, তখনো ভারতের কোনো কোনো উদারপন্থী হিন্দু স¤্রাট আকবরকে ভারতের জাতির পিতা বলে মেনে নেয়ার পক্ষে মত দিচ্ছেন। অন্যদিকে ধর্মান্ধ বিজেপি নেতা-কর্মীরা ভারত থেকে মুসলমানদের সব চিহ্ন মুছে ফেলতে পারলেই যেন স্বস্তি পান। এ এক গুরুত্বর মানসিক বিকার। হাজার বছরের সামাজিক-রাজনৈতিক সহাবস্থানের ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তারা মুসলমানদের রক্তে হোলিখেলায় মেতে উঠতে চায়। ফেব্রæয়ারিতে দিল্লির সহিংসতাকে শব্দের রাখঢাক, মারপ্যাঁচে ‘দাঙ্গা’ বলে অভিহিত করলেও আসলে তা ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্ধ্যোপাধ্যায় একে পরিকল্পিত হত্যাকান্ড বলেই অভিহিত করেছেন। আবার লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকা দিল্লির সহিংসতাকে প্রকাশ্য মুসলিম নিধন বলে অভিহিত করেছে। যেখানে মুসলমানদের রক্তপিপাসু উন্মত্ত হিন্দুত্ববাদীদের সাথে দিল্লির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিরব দর্শক অথবা হত্যাকারীদের সহায়ক হিসেবে দেখা গেছে। এ এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য। শুধুমাত্র সিএএ বিরোধী প্রতিবাদী কণ্ঠগুলোকে স্তব্ধ করে দিতে শত শত সশস্ত্র যুবক জয়শ্রীরাম শ্লোগান দিয়ে মুসলমানদের বাড়িঘরে তান্ডব চালিয়ে, পুড়িয়ে দিয়ে, গুলি করে এবং রাম দা দিয়ে কুপিয়ে শত শত মানুষকে হতাহত করার মধ্য দিয়ে সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণ্য, ন্যক্কারজনক বর্বরতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ২০০২ সালে দাঙ্গার সময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদি। সরকারি হিসাবে হিন্দুত্ববাদীদের হাতে সহস্ত্রাধিক মানুষ নিহত হয়েছিল, এর শতকরা ৮০ ভাগের বেশি ছিল মুসলমান। গুজরাটের কসাই নামে কুখ্যাতি পাওয়া নরেন্দ্র মোদিকে মুসলমান হত্যার জন্য পুরস্কার হিসেবে ভোট দিয়ে দিল্লির ক্ষমতায় পাঠিয়েছে ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা। এখন দিল্লিতে আম আদমি পার্টির কাছে মোদির বিজেপি পরাস্ত হলেও গুজরাট কায়দায় মুসলমান নিধনে তাদের তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। দিল্লির পুলিশ বাহিনীকে স্পষ্টতই হিন্দুত্ববাদীদের আজ্ঞাবহ হিসেবে দেখা গেছে। নিজেদের বাড়িঘর, জানমাল রক্ষায় পুলিশের কাছে হাজার হাজার টেলিফোন গেলেও তিনদিন তারা নিরব দর্শক অথবা মুসলিম নিধনে সহায়ক শক্তির ভূমিকা পালন করেছে। তবে দিল্লির মূল ধারার রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি এই পরিকল্পিত গণহত্যাকে সমর্থন করতে পারেনি। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সফরের সময় এই নিধনযজ্ঞ শুরু হওয়ায় বিশ্ব গণমাধ্যমের দৃষ্টি এখানে নিবদ্ধ থাকায় গণহত্যার সময় আরো দীর্ঘায়িত করে গুজরাটের মাত্রায় উন্নীত করা সম্ভব হয়নি। জায়নবাদীরা ইসলামোফোবিয়া ছড়িয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে সারাবিশ্বে মুসলিম বিদ্বেষী নৃশংসতা উস্কে দিয়েছে। দিল্লিতে ডোনাল্ড টাম্পের সফরের সময় নরেন্দ্র মোদির কর্মীদের মুসলমান নিধনের ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দাঙ্গার মোড়কে পরিকল্পিত গণহত্যা। ভারতে মুসলমানদের রাষ্ট্রহীন করার হিন্দুত্বাদী রাজনৈতিক তৎপরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহসকে স্তব্ধ করাই এর মূল লক্ষ্য। ভারতের মুসলমানরা তা রুখে দিবেই। ধর্মনিরপেক্ষ ও সহাবস্থানের ভারত তা রুখে দাঁড়াতে না পারলে অখন্ড ভারতের ধ্বংস অনিবার্য।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
বিবেক ২৬ জুলাই, ২০২০, ২:৩৩ এএম says : 0
শ্রদ্ধেয় বারি সাহেব, বাংলাদেশে স্বাধীনতার সময়ে ২৭ শতাংশ হিন্দু ছিল, তারা আজ কোথায়! ভারত ভাল আছে। এ দেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ আর পাঁচটা সম্প্রদায়ের মতোই ভাল আছে। কিছু ছোট খাটো সমস্যা লেগে থাকে। সে সব দেশেই সব সময়ে হয়ে থাকে। এ নিয়ে চিন্তা করবেন না। কারণ আখেরে আমাদের দেশের সংবিধাম ধর্মনিরপেক্ষ। আপনাদের টা ঠিক কী সেটা মনে আছে তো ! আগে নিজের দেশের সংখ্যালঘুদের বাঁচান। তারপরে অন্যের বাড়ির বিষয় নাক গলাতে আসবেন.
Total Reply(0)
সোহান ২৮ অক্টোবর, ২০২০, ৬:০৩ পিএম says : 0
বিবেক সাহেব, স্বাধীনতার সময় ২৭% হিন্দু ছিল, এই ইনফর্মেশন আপনি কোথায় পেয়েছেন। আপনাদের দেশের সংবিধান হলো কথিত "ধর্মনিরপেক্ষ" সংবিধান। যে দেশের ১৯৪৭ সালে শত শত দাঙ্গা হয়েছে, হাজার হাজার মুসলমান মারা গেছে। আপনাদের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ, বাস্তবতায় নেই। যে দেশ এনআরসির নামে মুসলমানদের নাগরিকত্বহীন করে, অন্যদেশের হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেয়, যে দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে গুজরাটের দাঙ্গায় অভিযোগ ওঠে, যে দেশের প্রধানমন্ত্রী কে বলে গুজরাটের কসাই, যে দেশ উগ্র হিন্দুত্ববাদী আদর্শ বাস্তবায়ন করে, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর সংগঠিত দাঙ্গায় যারা অভিযুক্ত তাদেরকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়, সেদেশ কীভাবে ধর্মনিরপেক্ষ হয়। আপনাদের উচিত আপনাদের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি বাদ দিয়ে সরাসরি হিন্দুরাষ্ট্র বলে ঘোষণা করা। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত কতগুলো দাঙ্গা সংগঠিত হয়েছে আর কত হিন্দু মারা গেছে, আর ভারতে পর্যন্ত কতগুলো দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে, আর কত হাজার মুসলমান মারা গেছে তার তুলনা করিয়েন। তাহলে উত্তর পেয়ে যাবেন। আর আপনাদের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি একপ্রকার প্রতারণা। যে দেশের সরকার প্রধান থেকে শুরু করে বেশিরভাগ মানুষ উগ্র হিন্দুত্ববাদী চেতনা লালন করে, যে দেশের সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত হিন্দুত্ববাদী আদর্শ বাস্তবায়ন করে তাই আপনাদের উচিত সংবিধানে কথিত ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি বাদ দিয়ে ভারতকে সরাসরি হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণা করা।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন