ফ জ লে রা ব্বী দ্বী ন
‘গ্রামের খোলা দিগন্তে যাদের বেড়ে ওঠা, তারা একটু দুরন্তই হয় বটে! আর সেই দুরন্ত ছেলেগুলোকে শহরের চার দেয়ালের মাঝে কখনো আটকে রাখা যায় না। তারা হচ্ছে প্রকৃতির শরীর দিয়ে গড়ে ওঠা প্রকৃতির মানুষ।’
সমাজ বইয়ের ‘প্রকৃতি ও মানুষ’ অধ্যায়টা শেষ করতে না করতেই নির্জনের মাথায় নতুন একটা ভুত চাপল। গ্রামের ছেলেমেয়েরা তাহলে দুরন্ত হয়! কিন্তু শহরের সাথে এত বৈচিত্র্য কেন? শহরের ছেলেমেয়েরাও তো গ্রামের ছেলেমেয়েদের মতো পড়ালেখা করে, স্কুলে যায়, ছুটির দিনে সময় হলে ঘুরতেও যায়। তাহলে কিসের জন্য এত অমিল? না, ব্যাপারটাকে ফেলে দিলে চলবে না। বাস্তব চোখে দেখতে হবে।
নির্জন খুব বুদ্ধিমান ছেলে। শহরেই বেড়ে উঠেছে বলে গ্রামের দুনিয়া সম্পর্কে তেমনটা জ্ঞান নেই। তবে তারও একটা ছোট্ট গ্রাম আছে। খুব ছোট বেলায় মা তাকে একবার বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে আর যাওয়া হয়নি। সেখানে তার দাদু থাকে। তাই মনে মনে একটা কষ্টের রেশ সবসময় থেকে যায় দাদুকে না দেখতে পেরে।
আকাশটা কেমন যেন মেঘাচ্ছন্ন করে এলো। ঠিক নির্জনের মনের মতো। তারপর হঠাৎ বৃষ্টি। আষাঢ়ের বৃষ্টি। বর্ষার টুপটাপ শব্দের বৃষ্টি। সে বৃষ্টি কেবল জানালার বাইরেই পড়ছে না, নির্জনের চোখেও ভেসে উঠেছে প্লাবণের মতো বাঁধ ভাঙা ঢেউ।
হঠাৎ ঘরে মা এসে হাজির। ‘কিরে নির্জন, একা একা ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি করছিস? দেখ্ তোর দাদু এসেছে গ্রাম থেকে।’
‘দাদু এসেছে মানে?’ নির্জন যেন কথাটা শুনে আকাশ থেকে পড়ল। প্রায় সাত বছর ধরে দাদুকে সে দেখে না। চোখটা পেছনের দিকে ঘুরাতেই মায়ের সাথে দাদুর দাঁড়িয়ে থাকাটা আবিষ্কার করতে পারল সে। তারপর যেন সবকিছু গল্পের মতো পৃথিবীটা বদলে গেল তার। সময়ের গল্পের নির্জন যেন চঞ্চলের বড় চাবিকাঠি। এত চঞ্চলতা তার মাঝে লুকিয়ে ছিল ভাবতেই পারছে না বাড়ির কেউ। নির্জন তার দাদুকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘তোমাকে আর কোথ্থাও যেতে দেব না দাদু। তুমি সবসময় আমার সাথেই থাকবে আর গাঁয়ের দুরন্ত ছেলেমেয়েদের গল্প শুনাবে।’
নির্জনের কথা শুনে দাদু মিটমিট করে হাসতে থাকে। আবার হঠাৎ করে কষ্টও পায়। ফুটফুটে শহরের এই ছেলেগুলো সারাদিন ব্যস্ত থাকে পড়ালেখায়। কাধে ব্যাগ ঝুঁলিয়ে, চোখে হাই পাওয়ারের মোটা কাচের চশমা পরে সারাদিন খালি বই ঘেঁটে চলে আর কপালের ঘাম মুছতে থাকে। আবার একটু সময় হলেই কম্পিউটারের দুনিয়ায় পদার্পণ করে। না পারে পাখির ডাক শুনতে আর না পারে ধান ক্ষেতের মধ্য দিয়ে ঘুড়ি নিয়ে দৌড়াতে।
নির্জন দাদুর কাছে এসে একবার বলল, ‘আমায় তোমার গ্রাম দেখতে নিয়ে যাবে দাদু?’
এ কথা শুনে দাদু যেন কথা হারিয়ে ফেললেন। বিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন,
Ñতোমার ছুটি হয়েছে দাদুভাই?’
Ñহ্যাঁ দাদু, সামনে ঈদ উপলক্ষে এক সপ্তাহ ছুটি পেয়েছি। ঠিক করেছি এই সাতদিন গ্রাম দেখতে যাব। বইতে পড়েছি গ্রামে নাকি পাখ-পাখালিরা সারাদিন বন-বাদাড়ে ঘোরাঘুরি করে আর কিচিরমিচির করে ডাকে। সারা মাঠ-ঘাট ফসলে ভরা থাকে আর রাখালেরা বটগাছের তলায় বসে বাঁশি বাজিয়ে বাজিয়ে গরু চড়ায়। অনেক উৎসব নাকি পালন করে গাঁয়ের মানুষ। ঈদ উৎসবের দিনে বাংলার ঐতিহ্যবাহী অনেক কিছুই তারা পালন করে। বাড়ির বউয়েরা স্বাধের পিঠা বানায় আর বাড়ি ভর্তি নাইওর আসে। আমি গ্রামে গেলে গ্রামের সেই ছোট্ট নদীটাতে গোছল করব। ওহ্ আমিতো সাঁতারই পারি না, তাহলে নদীতে গোছল করব কীভাবে? দাদু তুমি আমাকে সাঁতার শিখিয়ে দেবে না?’
দাদু নির্জনের কথায় হাসে আর হ্যাঁ হ্যাঁ করে উত্তর দেয়।
ঈদের আর কয়েকদিন বাকি। নির্জন তার দাদুর সাথে খুব ভোর বেলায় গ্রামে যাওয়ার জন্য ট্রেনের টিকিট কেটে রেখেছে। ট্রেন স্টেশন তার বাড়ি থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তারা ট্রেন স্টেশনেও গিয়ে পৌঁছায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটা এসে হাজির হবে দুই নাম্বার লাইনে। কিন্তু নির্জন কেমন যেন ছটফট করতে শুরু করল। দাদু তার অস্থিরতাকে দেখে কিছু বুঝে উঠতে পারল না। নির্জন তার দাদুকে জোর গলায় একবার বলল, ‘দাদু, তুমি এখানে বসে থাক আমি বাসা থেকে এক্ষুণি আসছি।’
দাদুর কপাল দিয়ে ঘাম ঝরা শুরু করল। ট্রেনটা দু-এক মিনিটের মধ্যেই চলে আসবে। এদিকে নির্জনও বাড়ির দিকে ছুটছে। (অসমাপ্ত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন