বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

অর্থপাচার বেড়েই চলেছে

| প্রকাশের সময় : ৫ মার্চ, ২০২০, ১২:০২ এএম

দেশ থেকে অবৈধভাবে অর্থপাচারকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সংকট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে এ ব্যাপারে গণমাধ্যমে ও সরকারি মহলে কথাবার্তা হচ্ছে। মানিলন্ডারিং বন্ধে সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তরফে নানা উদ্যোগের কথাও শোনা গেছে। তবে অর্থপাচার বন্ধ হয়নি, এমনকি আগের চেয়ে বেড়ে যাওয়ার আলামত পাওয়া যাচ্ছে। এর মানে হচ্ছে, মানিলন্ডারিং বা অবৈধ অর্থপাচার বন্ধে সরকারের পদক্ষেপগুলো তেমন কোনো কাজে আসেনি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ‘জিএফআই বা গ্লােবাল ফিনানসিয়াল ইন্টিগ্রিটি’র সর্বশেষ রিপোর্টে বাংলাদেশ থেকে বছরে অন্তত ১ লাখ কোটি টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া যায়। ইতিপূর্বেও বিভিন্ন সময়ে জিএফআই বাংলাদেশের মানিলন্ডারিং, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা সম্পর্কে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। গত মঙ্গলবার প্রকাশিত রিপোর্টে বিশ্বের ১৩৫টি দেশে ২০০৮ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত অর্থপাচারের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। তালিকায় থাকা অন্যান্য দেশ এ বিষয়ে জাতিসংঘে তথ্য সরবরাহ করলেও বাংলাদেশ থেকে ২০১৬ ও ২০১৭ সালের তথ্য না পাওয়ায় সংস্থাটি ২০১৫ সাল ও আগের তথ্যের ভিত্তিতে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ১৫১ কোটি মার্কিন ডলার পাচার হয়েছে বলে জিএফআই জানিয়েছে। বাংলাদেশি টাকায় এর অঙ্ক দাঁড়ায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা। এ পরিমাণ অর্থ দিয়ে পদ্মাসেতুর মতো চারটি সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। নানা মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তারা জানিয়েছে, গত ৭ বছরে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের পরিমাণ প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা। টিআইবি’র মতে, জিএফআই’র এই প্রতিবেদন আংশিক বা খন্ডিত, প্রকৃত চিত্র আরো ভয়াবহ।

মানিলন্ডারিং একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা হলেও বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের মাত্রা তার সামগ্রিক অর্থনৈতিক সামর্থ্য ও বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিহীন। অর্থ পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাম থাকলেও বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বের ৩০ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের অন্তর্ভুক্ত নয়। দেশ থেকে টাকা পাচারের নানাবিধ কারণ এবং পন্থা সক্রিয় রয়েছে। জিএফআই রিপোর্টে ব্যবসা-বাণিজ্যিক লেনদেনের মধ্য দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ ওভার ইনভয়েসিং এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমেই বেশি পরিমাণ অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটছে। সেই সাথে বিদেশ বিনিয়োগের নামে, হুন্ডি এবং দেশে কর্মরত অবৈধ শ্রমিকদের আয় ও সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু লোকের অর্থ অবৈধভাবে পাচার হচ্ছে। আর দেশের দুর্নীতিবাজ আমলা, মন্ত্রী-এমপিসহ বিভিন্ন স্তরের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, ব্যবসায়ীরা অবৈধ উপায়ে অর্জিত টাকা সাদা করার জন্য বিদেশে পাচার করতে মূলত আমদানি-রফতানি খাতকে বেছে নিয়েছে। তা ছাড়া প্রবাসে কর্মরত লাখ লাখ কর্মীর কষ্টার্জিত অর্থ বিদেশি মুদ্রায় দেশে ফেরত না পাঠিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার একটি কার্যকর পন্থা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে হাতে গোণা কয়েকজন তৃতীয় সারির রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে আটক করে বাহবা কুড়ালেও ঘুষ-দর্নীতি, চাঁদাবাজি, কমিশন, মুক্তিপণ বন্ধে স্থায়ী উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

দেশ থেকে টাকা পাচারের হার এবং নানাবিধ প্রক্রিয়া ও পন্থার কথা প্রকাশিত হওয়ার পাশাপাশি এসব ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, দুর্নীতিদমন কমিশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মানিলন্ডারিং বিরোধী নানা পদক্ষেপ ও নজরদারি থাকলেও অর্থ পাচারের মূল কারণসমূহ দূর করার তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। গত এক দশকে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরসহ আর্থিক খাত চরম বিশৃঙ্খলা, অব্যবস্থাপনা ও বল্গাহীন লুটপাটের শিকার হয়েছে। দেশে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ না থাকা, নিরাপত্তা না থাকা, রাজনৈতিক-সামাজিক অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তার অভাবে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ থমকে দাঁড়িয়েছে। তবে নিয়ন্ত্রণহীন ঘুষ-দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, কমিশন বাণিজ্য, মাদক ব্যবসায়, ক্যাসিনো ব্যবসা ও ভূমি দস্যুতার মাধ্যমে এক শ্রেণির মানুষ রাতারাতি আঙুল ফলে কলাগাছ হয়েছে। অবৈধ পথে অর্জিত অর্থ বৈধ চ্যানেলে বিদেশে পাচার করতে আমদানি-রফতানির ভূয়া ডক্যুমেন্ট ব্যবহার করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া বছরের পর বছর ধরে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়। মিথ্যা ঘোষণা এবং ভূয়া ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ভিন্ন পণ্য আমদানি কিংবা মাটি বা ময়লা ভর্তি কনটেইনার আমদানির তথ্যও মাঝে মধ্যে প্রকাশিত হয়। তবে এ ধরনের ঘটনার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তির দৃষ্টান্ত না থাকা এবং নিশ্চিদ্র নজরদারি ও তদারকি না থাকায় বাণিজ্যিক চ্যানেলে টাকা পাচার বন্ধ হচ্ছে না। খালিদ মাহমুদ, ইসমাইল সম্রাট, জিকে শামীম, এনু-রূপম থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক পাপিয়া কান্ড পর্যন্ত যে সব অবৈধ অর্থের মালিক ধরা পড়েছে তারা সকলেই সরকারি দলের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের ছত্রছায়ায় অপকর্ম চালিয়েছে। সে সব নেপথ্যের প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের কিছুই হয় না। অন্যদিকে দুর্নীতি দমনের নামে, রাজস্ব ফাঁকি বন্ধের নামে এবং দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, দুদক এবং এনবিআরের অহেতুক হয়রানির শিকার হওয়ার কারণে দেশে বিনিয়োগ ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ায় অনেকে বিদেশে বিনিয়োগ ও টাকা পাচারকে বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করছে। পাচারকৃত অর্থ অনেকেই বিদেশে বিনিয়োগ করছে বলে জানা যায়। হয়রানি বন্ধ ও বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত হলে হয়তো টাকা পাচার এত বাড়তে পারতো না। দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা, সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ ও সুশাসন নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই কেবল অর্থপাচার সহনীয় মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন