বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

আত্মঘাতী হামলা রোধে ইসলাম

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ৫ মার্চ, ২০২০, ১২:০২ এএম

আত্মঘাতী হামলা একটি মানবতা বিরোধী অপরাধ। বর্তমান পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই আত্মঘাতী হামলার ঘটনা ঘটছে। তাই এটি একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যায় রুপ নিয়েছে। শাওল শাইয়ের মতে, সর্বপ্রথম আত্মঘাতী হামলা সংঘটিত হয় দশম শতাব্দীতে শী‘আ হাশ্শাশীন সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে অষ্টম শতাব্দীর শুরুতে এশিয়ার মানুষেরা পাশ্চাতের দখলদারদের নির্যাতন থেকে মুক্তি পেতে তাদেও বিরোদ্ধে এই আত্মঘাতী হামলার পথ বেছে নেয়। আধুনিক যুগের প্রথম আত্মঘাতী হামলা সংঘটিত হয় ১৯৮৩ সালে লেবাননে। সর্বমোট ৫০টি আত্মঘাতী হামলার ঘটনা ঘটে লেবাননে। এর অর্ধেক সংখ্যক হামলা ঘটে সেক্যুলার সংগঠন, কমিউনিস্ট পার্টি, সমাজতান্ত্রিক দলের নেতৃত্বে এবং বাকি অর্ধেক হামলা সংঘটিত হয় লেবাননের মুসলিম দল কর্তৃক। তবে পরবর্তীতে এমন হামলার পরিমাণ অনেক কমে যায়। পক্ষান্তরে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে আত্মঘাতী হামলা দিন দিন বাড়তেই থাকে। বিচ্ছিন্নতাবাদী তামিল সংখ্যালঘু সংগঠন তাদের স্বাধীনতার জন্য শ্রীলংকাতে সংখ্যাগুরু সিনহালিজ গ্রুপের বিরোদ্ধে আত্মঘাতী হামলা ঘটায়। আরেকটি সেক্যুলার সংগঠন ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সালের মধ্যে তুরস্কে মোট ১৬টি আত্মঘাতী হামলা পরিচালনা করে, যাদের অধিকাংশ ছিল মার্কসবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী কুর্দি, যদিও এর সদস্যরা নামে মাত্র মুসলিম হিসেবে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে বহু আত্মঘাতী গ্রুপ ও সন্ত্রসী সংগঠন আত্মপ্রকাশ করেছে এবং গোটা বিশ্বব্যাপী এই হত্যাকান্ড দিন দিন বেড়েই চলছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এসব গ্রুপ ও সংগঠন সন্ত্রাসী হামলার মাধ্যমে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। এবং মানুষের নিরাপত্তায় বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। আত্মঘাতী হামলার সামাজিক অথনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও মানসিকসহ বিভিন্ন কারণ রয়েছে। কিন্ত সম্প্রতি আত্মঘাতী হামলার ভয়াবহতা ধর্মকে লক্ষণীয়ভাবে স্পর্শ করছে। গবেষণায় আত্মঘাতী হামলার সাথে ধর্মের কিছুটা সম্পর্ক খুজে পাওয়া যায়। বিশ্বের প্রধান ছয় ধর্মের অনুসারীদের মাঝে চালিত এক সমীক্ষায় বেড়িয়ে এসেছে, যায়া বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় সহযোগিতামূলক কাজে অংশগ্রহণ করে তাদের সাথে আত্মঘাতী হামলার ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু মুসলিমদের মাঝে যারা নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত অংশগ্রহণ করে, তাদের সাথে আত্মঘাতী হামলার সম্পর্ক নেই। এতে প্রমাণিত হয় যে, শুধু ইসলামের মূলধারায় যারা একনিষ্ঠ, তাদের আত্মঘাতী হামলার সাথে কোন রকম সম্পর্ক নেই। কোন কোন লেখক আধুনিক যুগের আত্মঘাতী হামলার মূলে একমাত্র ধর্মীয় উগ্রবাদকে দায়ী করেন। আবার কেউ যে কোন সন্ত্রাসী হামলাকে যে কোন উপায়ে শুধু ইসলামের সাথে সম্পর্কিত করেন। এমন প্রচারণা এক দিকে ইসলামের অনুসারীদেরকে দোষারোপ করে বিভিন্ন রকম ভোগান্তিতে ফেলে দিচ্ছে; অন্য দিকে সাধারণ মুসলিম, নওমুসলিম এবং ইসলাম গ্রহণ করতে ও জানতে আগ্রহীদেরকে ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তিতে ফেলা হচ্ছে। সর্বোপরি মুসলিমসহ অন্যদেরও সাধারণ জীবন যাপনের নিরাপত্তা বিঘ্ন হচ্ছে। এজন্য মুসলিমদের ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মীয় উৎসের আলোকে আত্মঘাতী হামলার মূল্যায়ন করা একান্ত প্রয়োজন। কারণ যদিও কোন ধর্মের অনুসারীদের আচরণের মাধ্যমেই অন্য ধর্মালম্বীরা এই ধর্মকে বিচার করে থাকে; কিন্তু ধর্মে মূলধারা তথা অধিকাংশ অনুসারীদের আচরণই কেবল এমন বিচারে কিছুটা সঙ্গত হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে অনুসারীদের ধর্মগ্রন্থই এবং ধর্মেও মূল ধারার রচনাসমগ্রই তাদের ধর্মকে প্রকৃতভাবে প্রতিনিধিত্ব করে এবং এর মাধ্যমেই ধর্মকে বিচার করা যৌক্তিক।

আত্মঘাতী হামলায় আক্রমণকারী ব্যক্তি ও আক্রান্ত মানুষদেও প্রাণহানি ঘটে এবং অনেকে নৃশংসভাবে আহত হয়। মানব হত্যা ও আত্মহত্যা উভয় প্রকারের হত্যাকান্ডই এমন আত্মঘাতী হামলায় সয়ঘটিত হয়। তাই মানব হত্যা ও আত্মহত্যার সমন্বিত বিধানই আত্মঘাতী হামলার ইসলামী বিধান। জীবনের নিরাপত্ত প্রতিটি মানুষের সর্বোচ্চ মৌলিক অধিকার। তাই ইসলাম জাতি- ধর্ম নির্বিশেষে সকল নিরপরাধ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বিধান এবং অপরাধীদের শাস্তির বিধান করেছে। মুসলিমদের পাশাপাশি নিরপরাধ অমুসলিমদেরও নিরাপত্তা বিধান করেছে ইসলাম। ইতঃপূর্বে সংক্ষিপ্তভাবে মানব হত্যা নিষেধাজ্ঞার উল্লেখ করা হলেও মানব হত্যা নিষিদ্ধকরণ ও দমনে ইসলামে বহুমুখী কর্মসূচি রয়েছে। মানব হত্যা দমনে ইসলামের নিম্নাক্তে বিধানগুলো উল্লেখযোগ্য।

মানব হত্যা দমনে পার্থিব দন্ডবিধিতে ইসলঅম এর সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করেছে। তবে হত্যার বিভিন্নতার কারণে শাস্তির ধরনও ভিন্ন। ইচ্ছাকৃত মুসলিম হত্যার জন্য ইসলাম কিসাসের বিধান জারী করেছে। ইসলাম ইচ্ছাসদৃশ হত্যার জন্য কঠিন রক্তপণ এবং হত্যাকারী নিহতের মিরাস হতে বঞ্চিত হবার বিধান আরোপ করেছে। ভুলবশত হত্যার জন্য রক্তপণ, কাফফারা এবং হত্যাকারী নিহতের মিরাস ও অসিয়ত হতে বঞ্চিত হবার বিধান আরোপ করা হয়েছে। অমুসলিম জিম্মী যে জিয্য়া প্রদান করে মুসলিম দেশে অবস্থান করার অনুমতি পেয়েছে তাকে কোন মুসলিম হত্যা করলেও তার জন্য রক্তমূল্যের বিধান ইসলাম আরোপ করেছে। একইভাবে মুসলিম জনপদের সাথে কোন অমুসলিম ব্যক্তি কিংবা জনগোষ্ঠি চুক্তিবদ্ধ হলে ইসলামী বিধানে তারাও মুসলিম জনপদে নিরাপদ। কোন অমুসলিম তার প্রয়োজনে অনুমতি সাপেক্ষে মুসলিম দেশে সাময়িকভাবে প্রবেশ করলে সেও নিরাপদ। যদি কোন মুসলিম এ ধরনের জিম্মী, চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম কিংবা নিরাপত্তাকামীকে হত্যা করে, তাহলে তার উপর কিসাসের বিধান আরোপিত হবে। এটি ইমাম আবু হানিফা রহ. ও তার অনুসারী সহযোগীবৃন্দ এবং ইবন আবু লায়লার অভিমত। উল্লেখ্য যে, মুসলিম ও অমুসলিম হত্যার শাস্তির ভিন্নতা থাকলেও ইসলাম উভয় হত্যাকেই সমভাবে নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে উভয়ের জীবনের নিরাপত্তা বিধান করেছে।

ইসলামের দৃষ্টিতে কুফরি হচ্ছে সবচেয়ে বড় অপরাধ এবং এর পারলৌকিক শাস্তিও সর্বোচ্চ শাস্তি। মুসলিম হত্যার অপরাধ এতই জঘন্য যে, ইসলাম এটিকে কুফরি হিসেবে ঘোষণা করেছে। হাদিস শরীফে এসেছে: আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: মুসলিমকে গালি দেয়া ফিসক এবং তাকে হত্যা করা কুফরি। পাশাপাশি মানব হত্যাকে ইসলাম সর্বাপেক্ষা বড় গুনাহের অন্তর্ভুক্ত করেছে। হাদিদ শরীফে এসেছে: আনাস (রাঃ) নবী করীম (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি (সাঃ) বলেন: সর্বাপেক্ষা বড় গুনাহ হচ্ছে আল্লাহর সাথে শিরক করা, মানব হত্যা করা, মাতা-পিতার অবাধ্য হওয়া, মিথ্যা কথা বলা বা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া। মানব হত্যাকারীকে ইসলাম মুসলিম জনগোষ্ঠির গন্ডি বহির্ভুত হিসেবে বিবেচনা করে। হাদিস শরীফে এসেছে: আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) নবী করীম (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: যে ব্যক্তি আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবে সে আমাদের দলভুক্ত নয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আরো বলেন: আবু হুরায়ারা (রাঃ) নবী করীম (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি (সাঃ) বলেন: কেউ যদি আমার উম্মতের উপর এমন যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় যে, সে যাচাই বাছাই ছাড়াই ভালো মন্দ সকল লোককেই হত্যা করে এবং মুমিনদের বিরুদ্ধে অন্যায় আচরণের পরিণতি সম্পর্কে মোটেও ভয় করেনা এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েও রক্ষা করে না, এমনাবস্তায় আমার সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই, আমারও তার সাথে কোন সম্পর্ক থাকবে না। ইসলাম মানব জীবনকে এমন উচ্চাসনে উন্নিত করেছে যে, একজন মুসলিমের হত্যা আল্লাহর কাছে গোটা পৃথিবী ধ্বংসের চেয়েও গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। হাদিস শরীফে এসেছে: আব্দুল্লাহ ইবন আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবী করীম (সাঃ) বলেন: একজন মুমিনের হত্যার চাইতে দুনিয়া নিঃশেষ হয়ে যাওয়া আল্লাহর কাছে অধিকতর সহজ।

মানব হত্যার এমন জঘন্যতার কারণেই রাসুলুল্লা (সাঃ) তার প্রদত্ত শেষ ভাষণে এর নিষেধজ্ঞার কথা উল্লেখ করেন। হাদিস শরীফে এসেছে: আবু বাকরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, কুরবানির দিন নবী করীম (সাঃ) আমাদের উদ্দেশ্যে খুৎবা প্রদান করেছেন। তিনি বলেন... নিশ্চয়ই তোমাদের রক্ত ও সম্পদ আজকের এই দিন, এই মাস এবং এই ভূখন্ডের মত হারাম (পবিত্র ও সুরক্ষিত) ঐ দিন পর্যন্ত যে দিন তোমরা তোমাদের রবের সাথে সাক্ষ্যৎ করবে। মানব হত্যায় শুধুমাত্র হত্যাকারীর সরাসরি ইচ্ছাতেই সংঘটিত হয় না; বরং কেউ কেউ তার উপরস্থ ব্যক্তিবর্গের উৎসাহ কিংবা নির্দেশে এমন হত্যাকান্ড ঘটাতে বাধ্য হয়। বাধ্য-বাধকতার কখনও হত্যাকারীর নিজস্ব ইচ্ছার জাগ্রত হয়, আবার কখনও অনন্যোপায় হয়েও হত্যাকান্ড ঘটিয়ে থাকে। মানব হত্যা দমনে ইসলাম নির্দেশকারী ও উৎসাহদাতাসহ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত সকলকে দন্ডবিধির আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। হত্যাকান্ডের বাধ্য করাকে ইসলামী আইনে হত্যাকান্ডে উৎসাহ দান হিসেবে গণ্য হয়েছে। ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম শাফেঈর মতে বাধ্যকারীর উপর কিসাসের বিধান কার্যকর হবে। মানব হত্যা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ অপরাধ বিধায় পরকালে এর বিচার সর্বপ্রথম করা হবে। হাদিস শরীফে এসেছে: আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম (সাঃ) বলেন: (বিচার দিবসে) মানুষের মাঝে সর্বপ্রথম রক্ত পাতের বিচার করা হবে। পরিণতিতে মানব হত্যাকারী সৃষ্টিকর্তার অসন্তুষ্টি ও লানত প্রাপ্ত হবে এবং জাহান্নমে চিরকাল শাস্তি ভোগ করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম; সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন, তাকে লানত করবেন এবং তার জন্য মহা শাস্তি প্রস্তুত রাখবেন।

আধুনিক যুগে শরীয়া শব্দটি বিশেষত দু‘টি অর্থে ব্যবহৃত হয়। প্রথমত পূর্ণাঙ্গ দ্বীন অর্থে, এটি ইসলামের মৌলিক ও শাখা- প্রশাখা এবং তাত্তি্বক ও প্রায়োগিক সকল দিককে শরীয়তের অন্তর্ভুক্ত করে। দ্বিতীয়ত শরীয়া ফিকহ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। ফিকহ অর্থে শরীয়া দ্বারা ইসলামের শুধু প্রায়োগিক বিষয়সমূহকে বুঝানো হয়, যা ইবাদাত, মুয়ামালাত বা ব্যবসায়িক লেনদেন, পারিবারিক নীতিমালা, সমাজ ব্যবস্থা, রাষ্ট্র পরিচালনা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইত্যাদিকে অন্তর্ভুক্ত করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বুঝা যাচ্ছে, ইসলামের আইনগত দিককেই শরীয়া বলা হয়। তবে এটি প্রচলিত আইন ব্যবস্থা থেকে ভিন্ন এবং অধিকতর সুষ্ঠু ও কার্যকর। এর বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা তাকে প্রচলিত সব আইন ব্যবস্থা থেকে স্বতন্ত্র ও শ্রেষ্ঠতর করে রেখেছে। প্রতিটি আসমানী গ্রন্থেই সমকালীন মানব সমাজকে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সকল বিধিবিধান ছিল। এ বিধিবিধানগুলোই মূলত ‘শরীয়া’ হিসেবে আখ্যায়িত। সকল শরীয়ার মৌলিক উদ্দেশ্য ছিল মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের মাধ্যমে মানবকল্যাণ সাধনে দিক নির্দেশনা প্রদান করা। এ প্রসঙ্গে ইমাম কুরতুবী রহ.[১২১৪-১২৭৩ খ্রি] বলেন: বিচক্ষণ স্কলারগণ এ ব্যাপারে একমত যে, নবী-রাসূলগণের আনীত শরীয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে সৃষ্টির ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ সাধন করা। ইমাম শাতিবীও রহ. [১৩২০-১৩৮৮ খ্রি] এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ রাসূল (সাঃ) এর আনীত জীবনবিধান ‘ ইসলামী শরীয়া’ (শারী‘য়াহ ইসলামিয়াহ) হিসেবে পরিচিত। ইসলামী শরীয়া মানবকল্যাণ নিশ্চিতকরণে মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোকে সংরক্ষণ করতে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে। যে সব মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের মাধ্যমে মানবকল্যাণ নিশ্চিতকরণের এই মহান লক্ষ্য সাধিত হয় সেগুলোর সমষ্টিকে ইসলামী আইনে ‘মাকাসিদুশ শারী‘য়াহ’ বা ‘ইসলামী শরীয়ার মৌলিক উদ্দেশ্য’ অথবা ‘শরীয়া মাকাসিদ’ (Objectives of Shariah/ Objectives of Islamic Law) বলা হয়।

ইসলামী শরীয়ার এমন মানবকল্যাণ দর্শনের ব্যাপারে পরবর্তী সকল নির্ভরযোগ্য স্কলার ঐকমত্য পোষণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে ইবনুল কাইয়্যিম রহ. [১২৯২- ১৩৪৯ খ্রি.] এর মতে শরীয়ার মূলসূত্র ও ভিত্তি হচ্ছে, অন্তর্নিহিত রহস্য ও প্রজ্ঞা (হিকমাহ) এবং মানুষের ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ সাধন। শরীয়া পুরোটাই ন্যায়, অনূগ্রহ, প্রজ্ঞা এবং কল্যাণে ভরপুর। সুতরাং যে কোন বিষয় ন্যয়পরায়ণতা বহির্ভূত হয়ে অন্যায়ের দিকে ঝুকে পড়লে, অনুগ্রহ বিচ্যুত হয়ে রুঢ় হলে, কল্যাণ, বিচ্যুত হয়ে অকল্যাণে পরিণত হলে এবং উদ্দেশ্যবিহীন হয়ে অনর্থক হয়ে পড়লে সেটি আল্লাহর শরীয়ার অন্তর্ভূক্ত নয়, যদিও [কারো কারো মতে] সেটিকে ব্যাখ্যার মাধ্যমে শরীয়ার গন্ডির মধ্যে বিবেচনা করা হয়। শাহ ওয়ালীউল্লাহ আদ দেহলভী রহ. [১৭০৩- ১৭৬২ খ্রি.] বলেন, যদি এমন ধারণা পোষণ করা হয় যে, শরীয়াতের বিধিবিধান ও আহকাম কোন ধরনের মানব কল্যাণমুখি নয়, তবে এটি এমন এক ভুল ধারণা, যা রাসূলুল্লাহর সুন্নাহ এবং সোনালী যুগের ইজমা‘র (সমকালীন সকল আলিমের ঐক্যমত্য) মাধ্যমে ভ্রান্ত হিসেবে প্রমাণিত। অতএব, শরীয়া মাকাসিদের ভিত্তিতে যে বিধান রচিত হয়, তা সকল মানুষের কল্যাণ সাধনে সক্ষম।

আত্মঘাতী হামলা শরীয়ার অন্তর্নিহিত রহস্য ও প্রজ্ঞা এবং মানুষের ইহকাল ও পরকালের কল্যাণের পরিপন্থী। কারণ আত্মঘাতী হামলার মাধ্যমে ব্যক্তি পৃথিবীতে মানব সৃষ্টিরউদ্দেশ্য-আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যকে ব্যাহত করে। সকলেই তাদের পার্থিব জীবনের কল্যাণ হাসিল থেকে বঞ্চিত হয়। পরকালীন জান্নাতের বিনিময়ে ক্রয়কৃত মানুষের জীবনকে আল্লাহ তা‘আলা পুনরায় মানুষের নিকট আমানত রেখেছেন। আত্মঘাতী হামলাকারী এই আমানতকে চিরতরে বিনষ্ট করে ফেলে। অধিকন্তু আত্মহত্যা ও মানব হত্যার অপরাধের শাস্তি স্বরুপ পরকালেন চূড়ান্ত কল্যাণ থেকে সে নিজেকে বঞ্চিত করে।
আত্মঘাতী হামলা শরীয়ার ‘পঞ্চ অপরিহার্যতা (five necessities) এর দ্বিতীয়টি- জীবন রক্ষা (protection of life) এর সম্পূর্ণ বিপরীত বিধায় এটি আবশ্যকীয়ভাবে সর্বাগ্রে বর্জিত কাজ। জীবন রক্ষার বাস্তবায়নে ইসলামী শরীয়া নানা রকম বিধান আরোপ করেছে। তন্মধ্যে কিছু বিধান জীবন রক্ষার জন্য অপরিহার্যভাবে করণীয় এবং কিছু বিধান অপরিহার্যভাবে বর্জনীয় । এভাবে করণীয় ও বর্জনীয় বিধানের মাধ্যমে ইসলাম জীবন রক্ষা করাকে অপরিহার্য করেছে। তাই জীবন রক্ষায় সর্বাধিক চেষ্ট ও লড়াই করা মানুষের অপরিহার্য কর্তব্য। এমন হত্যাকান্ড ইসলামী শরীয়ার ন্যায়পরায়ণতা (Justice) ও স্বাধীনতা (Freedom) এই দুইটি সাধারণ কল্যাণ ( (public benefits) কে ব্যাহত করে। কারণ আত্মঘাতী হামলাকারী আত্মহত্যা ও মানব হত্যার মাধ্যমে স্বীয় আত্মা ও অন্যদের প্রতি চরম জুলুম করে থাকে এবং তাদের বেঁচে থাকার স্বাধীনতাকে হরণ করার মাধ্যমে সকলের জীবনকে এই পৃথিবীতে উদ্দেশ্যহীন করে তুলে। আত্মঘাতী হামলার মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের নিরপরাধ আত্মা ও একাধিক মানুষকে হত্যার মাধ্যমে ব্যাপক হত্যাকান্ড চালিয়ে থাকে। এমন হত্যাকান্ড ইসলামসহ সকল শরীয়ার ( ধর্মীয় বিধানের) অপরিহার্য সামগ্রিক উদ্দেশ্যের পরিপন্থী বিধায় কোন শরীয়াই এর অনুমোদন দেয় না। অধিকন্তু এমন হত্যাকান্ড দমনে ইসলাম সর্বধিক বিধান প্রণয়ন করেছে এবং হত্যাকান্ড ঘটে গেলে অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করেছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন