বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

উচ্ছেদ উচ্ছেদ খেলা

রাজধানীর ফুটপাথ, রাস্তা, মার্কেট, গ্যারেজ সবই দখলে

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৭ মার্চ, ২০২০, ১২:০০ এএম

রাজধানীর গুলিস্তানের ফুটপাত দখল করে হকারদের দোকান বসানোর খবর অতি পুরনো। এখন রাস্তা দখল করে চুটিয়ে ব্যবসা করছে হকাররা। তাতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে যান চলাচল। যানজটের সৃষ্টি হয়ে আটকে থাকছে গাড়ি। অথচ সেদিকে পুলিশের কোনো নজর নেই। হকাররা জানায়, রাস্তা দখল করে দোকান বসানোর জন্য পুলিশকে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়। গুলিস্তান সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সের হয়ে লাইনম্যানরা এই টাকা আদায় করে। সে কারণেই রাস্তায় দায়িত্বরত পুলিশ সবকিছু দেখেও দেখে না। যানজটে গাড়ি আটকে থাকলে তারা গাড়িগুলোকে সরাতে ব্যস্ততা দেখালেও রাস্তা দখলমুক্ত করার কোনো উদ্যোগ নেয় না। শুধু ফুটপাত ও রাস্তা নয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৮টি মার্কেটের পার্কিংয়ের জায়গা এখন দখলদারদের কবলে। এসব পার্কিং স্পেসে দোকান বরাদ্দ দেওয়ায় সেসব ব্যবহার হচ্ছে বাণিজ্যিক কাজে। এতে মার্কেটের কাজে আনা গাড়িগুলোকে রাখতে হয় রাস্তার ওপরে। স্বাভাবিকভাবেই মার্কেটগুলো ঘিরে তৈরি হচ্ছে তীব্র যানজট। বিপাকে পড়ছেন গাড়ি নিয়ে আসা ক্রেতা-ব্যবসায়ীরা।

রাজধানীর ফুটপাত দখলমুক্ত করতে এর আগে বহুবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। একদিকে উচ্ছেদ হয়েছে, অন্যদিকে হয়েছে দখল। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বহুবার উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে গুলিস্তানের ফুটপাতকে দখলমুক্ত করতে পারেন নি। ডিএমপি কমিশনারও ফুটপাতকে দখলমুক্ত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সফল হতে পারেন নি। কিছুদিন পর পর চলেছে উচ্ছেদ উচ্ছেদ খেলা। শুধু গুলিস্তান নয়, রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনের চিত্র একই। এর বাইরে রাজধানীর প্রতিটি এলাকায় রাস্তা দখল করে গাড়ি পার্কিং, দোকান নির্মাণ, সাইনবোর্ড লাগানো তো আছেই। ইদানিং এসবের সাথে যুক্ত হয়েছে ভ্যানগাড়ি। গোটা রাজধানীর অলিতে-গলিতে এখন ভ্যানগাড়ির দোকান। রাস্তা দখল করে ভ্যানগাড়িতে এখন সবই বিক্রি হয়।

রাজধানীতে ঢাকঢোল পিটিয়ে চালানো হয় অভিযান। তারপরও দখলমুক্ত হয় না ফুটপাতগুলো। অনুসন্ধানে জানা গেছে, হকারদের দখলদারিত্বের নেপথ্যে রয়েছে প্রভাবশালীদের চাঁদাবাজি। প্রতিদিন চাঁদাবাজির লাখ লাখ টাকা যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও পুলিশের পকেটে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে মোট হকার দুই লাখ ৬০ হাজার। যাদের দৈনিক চাঁদা গুণতে হয় গড়ে ১৯২ টাকা করে। এ হিসাবে রাজধানীতে প্রতিদিন হকারদের কাছে থেকে চাঁদা তোলা হচ্ছে প্রায় ৫ কোটি টাকা।

এদিকে রাজধানীজুড়ে ফুটপাত দখলের দায় নিতে রাজি নয় সিটি করপোরেশন কিংবা মহানগর পুলিশ। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন বলছেন, উচ্ছেদের পর নজরদারি না থাকার কারণেই দখলমুক্ত থাকছে না ফুটপাত। আর পুলিশের ভাষ্য, ফুটপাতকে দখলদারমুক্ত রাখতে হলে জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে।
ফুটপাত তো বটেই, রাস্তা দখল করে রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা গুলিস্তানের চলছে হকারদের রমরমা ব্যবসা। গুলিস্তানের সুন্দরবন স্কয়ারের সামনে রাস্তার বেশিরভাগ অংশ দখল করে হকাররা পসরা সাজিয়ে বসে। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার থেকে নেমে একটু সামনে এলেই চৌরাস্তা। এই চৌরাস্তার এক পাশে পুরোটাই হকারদের দখলে। সুন্দরবন স্কয়ারের পাশ দিয়ে যে রাস্তা ফুলবাড়ীয়া টার্মিনালের দিকে গেছে তা বন্ধই থাকে। যে কারণে গাড়িগুলোকে ঘুরে যেতে হয়। আবার গুলিস্তান মোড় থেকেও সদরঘাটের রাস্তায় যাওয়ার লিংক রোডটি পুলিশ রেকার রেখে হকারদের বসার সুযোগ করে দেয়। এতে ওই রাস্তাও দিনের অধিকাংশ সময় বন্ধই থাকে। শুধুমাত্র রাস্তা দখল করে রাখার কারণে গুলিস্তান এলাকার সবদিকেই দিনভর যানজটের ভোগান্তি পোহাতে হয়। অথচ পুলিশের সেদিকে কোনো নজর নেই। ভুক্তভোগিদের ভাষায় পুলিশ এসব ক্ষেত্রে অনেকটাই নিস্ক্রিয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, গুলিস্তানের সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেট, ফুলবাড়িয়া সুপারমার্কেট-১, ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২, পল্টন শপিং কমপ্লেক্স, আহসান মঞ্জিল সুপারমার্কেটে, ঢাকা ট্রেড সেন্টারে, কাপ্তানবাজার কমপ্লেক্সে-১ এবং কাপ্তানবাজার কমপ্লেক্স-২-এর পার্কিং স্পেসে গাড়ি রাখার জন্য কোনো জায়গা খালি নেই। প্রতিটির পার্কিং স্পেসেই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে দোকান। শুধু পার্কিং স্পেস নয়, দখল করা হয়েছে মার্কেটে চলাচলের সিঁড়ি, গণশৌচাগারসহ সব জায়গা।

ময়মনসিংহ থেকে সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটে এসেছিলেন আব্দুস সালাম। এলাকায় তার দোকানের জন্য মালামাল কিনে থাকেন এই মার্কেট থেকে। তিনি বলেন, একটা মার্কেটে পার্কিং স্পেস তো দূরের কথা, সিঁড়ি দিয়েও হাঁটার অবস্থা নাই। সিঁড়ির ধাপে ধাপে মালামাল রাখা হয়েছে। দু’জন লোকও একসঙ্গে হাঁটা যায় না। একই অবস্থা আহসান মঞ্জিল মার্কেট, কাপ্তানবাজার মার্কেট, পল্টন মার্কেট ও ফুলবাড়িয়া মার্কেটেও। সবগুলো মার্কেটের পার্কিং স্পেস, সিঁড়ি ও পাবলিক টয়লেটের জায়গাসহ খালি জায়গাগুলো দখল হয়ে আছে।

এসব মার্কেটের একাধিক দোকানদার জানান, ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী অঙ্গ-সংগঠন যুবলীগ, শ্রমিক লীগের নেতাকর্মীরাই মার্কেটের পার্কিং স্পেস দখলে জড়িত। তারা সিটি কর্পোরেশনের অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে গত ৭ থেকে ১০ বছর ধরে দখল করে রেখেছেন এসব জায়গা। পার্কিং স্পেসে ছোট ছোট দোকান বরাদ্দ দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।

দোকানদাররা বলছেন, এ বিষয়ে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। গত ৫ বছরে একাধিকবার অবৈধ দখলে থাকা এসব স্পেস উদ্ধারের উদ্যোগ নিলেও দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। একাধিকবার উচ্ছেদ অভিযানে গিয়েও ব্যবসায়ীদের বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে হয়েছে। আবার আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়েও বের হয়ে গেছেন অনেকেই।

ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, মার্কেটের পার্কিং স্পেসের অবৈধ দোকান উচ্ছেদের জন্য ২০১৬ সালে ডিএসসিসির তৎকালীন প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা খালিদ হোসাইনকে প্রধান এবং তৎকালীন প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মোস্তফা কামাল ও আইন কর্মকর্তা আরিফ হোসেনকে সদস্য করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে আটটি মার্কেটের পার্কিং স্পেসে দুই হাজার ৩৫০টি দোকান চিহ্নিত করে প্রতিবেদন জমা দেয়। এরপর আর কোনো সুরাহা হয়নি।

গুলিস্তান থেকে পুরনো ঢাকার দিকে যেতে সবগুলো রাস্তার ফুটপাতের উপর মালামাল রাখা। ব্যবসায়ীরা মালামাল রেখে ফুটপাতে দখলে রেখেছেন। সেদিকেও পুলিশের কোনো নজর নেই। পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা জানান, এজন্য পুলিশকে চাঁদা দিতে হয়। মাঝে মধ্যে এসব নিয়েও উচ্ছেদ উচ্ছেদ খেলা চলে।

রাজধানীর অন্যান্য এলাকার চিত্রও একই। রাজধানীর উত্তরা, বনানী, মহাখালী, বাড্ডা এলাকায় কয়েক দিন আগে চলে উচ্ছেদ অভিযান। উচ্ছেদের পরদিন আবার দখলদারমুক্ত স্থানগুলো দখল হয়ে গেছে। যাত্রাবাড়ীর শনিরআখড়া এলাকায় আন্ডারপাসের পাশে সড়ক ও জনপথের জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে বাজার। প্রতিমাসেই সওজ কর্তৃপক্ষ এই বাজার একবার করে উচ্ছেদ করে। এর পরদিন আবার আগের মতো বাজার বসে। প্রশ্ন হলো, এভাবে সরকারের টাকা খরচ করে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে তাহলে লাভ কি? ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, উচ্ছেদ করার দায়িত্ব প্রশাসনের। কিন্তু আবার যাতে দখলদাররা বসতে না পারে সেটা নজরদারি করার দায়িত্ব পুলিশের। যদি পুলিশের পক্ষে সম্ভব না হয় নজরদারি করা বা ধরে রাখা তাহলে এটা পৃথিবীর কেউ রাখতে পারবে না। আমি এক হাজার বার উচ্ছেদ করবো, তারা এক হাজার বারই বসবে। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এখানে ওয়ার্ড কাউন্সিলর বা জনপ্রতিনিধি, ক্রাইম পুলিশ-ট্রাফিক পুলিশ সবাইকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। নগর বিশেষজ্ঞ ইকবাল হাবিব বলেন, বারবার উচ্ছেদ অভিযান চালানোর পরও ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে না পারার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব দায়ী। তিনি বলেন, এসব ব্যবসার সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক মাস্তানরা যুক্ত। তাদেরকে তুষ্ট করার মধ্যে দিয়েই রাজনৈতিক নেতারা নেতা হন। পুরো বিষয়টা একটা কঠোর রাজনৈতিক অনুশাসন সদিচ্ছার সাথে যুক্ত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (7)
Md Swapon Ahmmed ৭ মার্চ, ২০২০, ১২:৫২ এএম says : 0
সারা দেশে উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত থাকুক, দেশের সম্পদ লুটপাট বন্ধ করা হউক। দেশের সম্পদ সবার জন্য সঠিক ভাবে ব্যবহার করা হউক। আইনশৃংখলা বাহিনীর দুর্নীতি বন্ধ করা হউক।
Total Reply(0)
Monir Monir ৭ মার্চ, ২০২০, ১২:৫৩ এএম says : 0
যারা এসব জায়গা দখল করেছে তাদের আইনের আোতায় আনা দরকার। না হলে ভবিষ্যতে আবারো এরা এরকম করমে।
Total Reply(0)
Sayeedul Islam Sayeed ৭ মার্চ, ২০২০, ১২:৫৩ এএম says : 0
স্থায়ী ভাবে উচ্ছেদের চেষ্টা করুন!
Total Reply(0)
S. Palash ৭ মার্চ, ২০২০, ১২:৫৩ এএম says : 0
Kisoi hobay na 30 bosor dhoray dekchi
Total Reply(0)
Maruf Hossain ৭ মার্চ, ২০২০, ১২:৫৪ এএম says : 0
শুধু এই বিষয়ে নয়, সব জায়গাতে সকল বিষয়ে বাংলাদেশে কানামাছি খেলা হয়। গরিব মনমানুষিকতা।
Total Reply(0)
Abdullah Al Hossain ৭ মার্চ, ২০২০, ১২:৫৫ এএম says : 0
সাংবাদিকরা যদি নদী দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে বেশি বেশি প্রচার করে তাহলে ভালো
Total Reply(0)
Abdullah Al Hossain ৭ মার্চ, ২০২০, ১২:৫৫ এএম says : 0
আমি সরকারের কাছে করজোড়ে মিনতি করব এ দেশের নদী গুলো কে রক্ষা করুন । নদী বাঁচলে বাঁচবে দেশ । প্রশাসন ইচ্ছা করলে অনেক কিছু করতে পারে।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন