শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

জিহাদ ও সন্ত্রাস : প্রক্রিয়া প্রতিক্রিয়া

প্রকাশের সময় : ১২ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

প্রিন্সিপাল মুফতী হাবিবুর রহমান মিছবাহ

বেশ কয়েক বছর ধরে সন্ত্রাসী হামলাগুলোকে জঙ্গি হামলা বলে চালিয়ে দিচ্ছে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা। আর সন্ত্রাসীদের বলা হচ্ছে জঙ্গি। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো টুপিধারী সন্ত্রাসীদেরই কেবল ওরা জঙ্গি বলে থাকে। এটি আশ্চর্যও বটে। টুপিধারী সন্ত্রাসীই যেন পুরো বিশ্বের কাছে আতংকের মূল। কোট-স্যুট পরা খুনি, ছাত্রবেশী খুনি, ব্যাংকারবেশী ডাকাতরা যেন দেশের জন্য কোনো হুমকিই নয় (!) তাই এ সমস্ত অপরাধীদের নিয়ে তেমন কোনো চিন্তার ছাপ দেখা যায় না দেশের কর্তাদের কপালে। এখানে কয়েকটি বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই। প্রথমত; এটি অন্তত এতদিনে স্পষ্ট হয়েছে যে, জঙ্গি দমনের নামে আঙ্গুলটি আসলে বরাবরই ইসলাম, মুসলমান তথা ওলামায়ে কেরামের দিকেই তোলা হচ্ছে। গণমানুষের মাঝে ইসলাম ও মুসলমানকে ‘জঙ্গিবাদ’ নামক ভূত সাজিয়ে আতংকের প্রতীক হিসেবে দাঁড় করাতে মরিয়া পুরো বিশ্ব। মানুষ হুজুর দেখলেই আতংকে সরে দাঁড়াবে। আর এ অজুহাতে ইসলাম ও মুসলমানদের জঙ্গি অপবাদ দিয়ে পৃথিবী হতে নিশ্চিহ্ন করা হবে।
দ্বিতীয়ত; জঙ্গি দমনের নামে ইসলাম ও দীনি প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের পাঁয়তারা চলছে। আমরা বিভিন্ন সময় দেখে থাকি যে, জঙ্গি দমনের নামে মাদরাসাগুলোতে তল্লাশি চালানো হয়। অথচ, প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া চলে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসে। শিক্ষার পরিবর্তে চলে দলবাজি, আধিপত্যের লড়াই, নারীর শ্লীলতাহানী, শিক্ষক লাঞ্ছিত ও অস্ত্রবাজি। অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানগুলো। পক্ষান্তরে কোনো মাদরাসা শিক্ষপ্রতিষ্ঠানে কি এরকম কোনো সংবাদ পেয়েছেন আপনি? আশা করি আপনার উত্তর ‘না’ সূচকই হবে।
তৃতীয়ত; দাড়ি-টুপিধারী সন্ত্রাসী আসলে কারা? ইসলাম বোমাবাজি, খুনখারাবি বা বেহায়াপনাকে কখনোই প্রশ্রয় দেয় না। তাহলে যারা ইসলামী পোশাকে সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য কি? এ কথার উত্তরের আগে আমি একটি উদাহরণ পেশ করতে চাই; চোর যে সমাজে চুরি করতে চাইবে, চোরকে সে সমাজের রূপ ধারণ করতে হবে। ভিন্নরূপে চুরি করা একেবারেই মুশকিল। যেমন : চোর নামাজির জুতা চুরি করতে চাইলে, চোরকেও নামাজি সেজে মসজিদে প্রবেশ করতে হবে, চাই সে চোর যদি অন্য ধর্মেরও হয় তবুও চুরির স্বার্থে মাথায় টুপি দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করতে হবে। তাই বলে কি আপনি বক্তব্য ছুড়বেন যে, নামাজি ব্যক্তি জুতা চুরি করেছে? না, বরং বলতে হবে চুরি করতে এসে নামাজি সেজেছে। ঠিক তেমনিভাবে টুপি-জুব্বাধারী সন্ত্রাসীর ক্ষেত্রেও একই কাহিনী। মূলত কোনো ইসলামী পোশাকধারী বা ইসলামের প্রকৃত সৈনিক ত্রাস করছে না বরং সন্ত্রাসীগোষ্ঠী ইসলামকে কলংকিত করার জন্য হুজুর সেজেছে। তবে এর পেছনে বিশাল গ্যাং রয়েছে, যারা এদেরকে কাজে নামিয়ে রিমোট কন্ট্রোল করছে। ঘটনার পেছনের নাটের গুরুদের চিহ্নিত করতে পারলেই আসল রহস্য প্রকাশ পাবে।
চতুর্থত; জঙ্গি একটি ফার্সি শব্দ; অর্থ - যোদ্ধা। জঙ্গ (যুদ্ধ) থেকে জঙ্গি (যোদ্ধা)। আমাদের যুদ্ধ জাহাজকে এখনো কিন্তু জঙ্গিবিমান বলা হয়। তার মানে জঙ্গি একটি পবিত্র শব্দ এবং জঙ্গ মানুষ, সমাজ ও দেশকে রক্ষা করে। জঙ্গি সন্ত্রাসী নয়, সন্ত্রাসীও জঙ্গি নয়। দুুটির মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। জঙ্গ, যুদ্ধ বা জিহাদ মানুষকে নিরাপত্তা দেয় আর সন্ত্রাস মানুষকে ধ্বংস করে।
তাহলে সন্ত্রাসীদের জঙ্গি বলা হবে কেন? তার মানে আমরা কি এটি ধরে নিতে পারি যে, জঙ্গি দমনের নামে নীতির জন্য সংগ্রাম বা জিহাদকে হারাম আর সন্ত্রাসীদের আড়ালে রেখে ত্রাসকে বৈধতার অপচেষ্টা চলছে (?) একটি কথা স্মরণ রাখতে হবে, কারো হাতে ছুরি দেখলেই গ্রেফতার করা যায় না। কেননা, ডাকাতের হাতের ছুড়ি ভয়ংকর কিন্তু ডাক্তারের হাতের ছুরি নিরাপদ। ডাকাতের হাতের ছুড়ি মানুষকে খুন করে আর ডাক্তারের হাতের ছুড়ি মৃতপ্রায় মানুষকে আল্লাহর রহমতে বাঁচিয়ে তোলে। তাই গ্রেফতারের আগে ডাক্তার ও ডাকাতের পরিচয় জানতে হবে। একইভাবে সন্ত্রাস ও জিহাদ দু’টির ভূমিকা সমাজে দু’রকম। সন্ত্রাস ত্রাস সৃষ্টি করে আর জিহাদ ত্রাসমুক্ত সমাজ গড়ে।
আরেকটি বিষয় না বললেই নয়,  দাড়ি-টুপির মুখোশধারী কোনো অপরাধী গ্রেফতার হওয়ার পরপরই আমরা সংবাদপত্রের শিরোনামে ‘অপরাধীর কাছে এতগুলো জিহাদী বই’ পাওয়া গেছে বলে দেখতে পাই। তার মানে তারা কী বোঝাতে চান? জিহাদী বই রাখা অপরাধ? কেন? জিহাদী বই অপরাধ হবে কেন? জিহাদের মাধ্যমে মাজলুম নিপীড়িতর অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়। জিহাদ কখনো অন্যায়ভাবে কারো প্রতি আঘাত করে না। তাহলে জিহাদী বই রাখা দ-নীয় অপরাধ হিসেবে ধরা হচ্ছে কেন? আমার কাছে এর উত্তর একটিই আর তা হলো জিহাদী বই বন্ধের নামে পবিত্র কোরআন-হাদিস ও ইসলামী জ্ঞান-সাহিত্য চর্চা বন্ধের পাঁয়তারা চলছে। কেননা, কোরআনের মতো এত শক্ত ভাষায় জিহাদের কথা আর কোনো পুস্তকে নেই। একটি সময় কোরআনকে জিহাদী বই আখ্যা দিয়ে কোরআন ধারণকারীদেরও গ্রেফতার করা হবে বলে মনে হচ্ছে। গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার মুসলিমবিশ্ব। যুগে যুগে পৃথিবীতে জিহাদের মাধ্যমেই অশান্তি দূর হয়েছে। দুর্নীতি, শোষণ, কুফুরি ও অনাচার দূর হয়েছে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ সফল হয়েছে। দেশ গঠন ও উন্নয়ন হয়েছে। জাহেলী যুগের অন্ধকারাচ্ছন্ন পৈশাচিক সমাজ ধ্বংস হয়ে শান্তির মশাল আনে ইসলামের আদর্শ ও জিহাদ।
অতএব, বিনীত আবেদন থাকবে সরকারে প্রতি; সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাসীই বলা হোক। জঙ্গি বা জিহাদী বলে আল্লাহ তা’আলার পবিত্র বিধান ও কোরআনের বাণী তথা ইসলামের অকাট্য একটি পন্থাকে কলুষিত যেন না করা হয়, সে ব্যবস্থা করুন। আমি মনে করি, সন্ত্রাসীদের জঙ্গি বলে আমাদের পুলিশ, র‌্যাব ও সেনাবাহিনীর মান ক্ষুণœ করা হচ্ছে। কেননা, আমাদের দেশ রক্ষায় যারা কাজ করেন তারা সবাই যোদ্ধা/জঙ্গি। সেখানে সন্ত্রাসীদের জঙ্গি বলে কি জঙ্গি শব্দের অবমাননা হচ্ছে না? আশা করছি সংশ্লিষ্টদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে ইনশাআল্লাহ।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও মহাপরিচালক
মারকাযুত তাকওয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, ঢাকা

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন