বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

কাজীর আদালতে বাংলার সুলতানের বিচার : দায়রা জজ স্ট্যান্ড রিলিজ এবং স্বাধীনতার স্বপ্নভঙ্গ

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১১ মার্চ, ২০২০, ১২:০২ এএম

মার্চ মাস আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবময় ও বেদনা বিধুর ইতিহাসের স্মৃতি বিজড়িত মাস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতা ও মুক্তির উদাত্ত আহবান, ২৫ মার্চের কালোরাতে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার গণহত্যা, ২৬ মার্চ মধ্যরাতে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের বিদ্রোহ ও স্বাধীনতার জন্য আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ঘোষণার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের রক্তাক্ত পটভ’মি রচিত হয়। আর এবারের মার্চমাসের ১৭ তারিখ স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের শততম জন্মবার্ষিকী জাতীয়ভাবে আন্তর্জাতিক আবহে পালনের মধ্য দিয়ে ইতিহাসে সমুজ্জ্বোল হয়ে উঠতে যাচ্ছে। কিন্তু এমন এক সময় এই মাহেন্দ্র ক্ষণের আনুষ্ঠানিকতার আড়ম্বরতা চলছে যখন অর্থনৈতিক ও অবকাঠামো উন্নয়ন ও সামাজিক-রাজনৈতিক অগ্রগতির জাতিয় প্রত্যাশায় এক দুস্তর পার্থক্য ও বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গণতন্ত্র, সাম্য, অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক ন্যায় বিচারের দাবিকে সামনে রেখেই একাত্তুৃরের শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেই মরতে মরতে বেঁচে থাকা মুক্তিযযোদ্ধাদের একটি বড় অংশ তাদের আয়ুষ্কালে মুক্তিযুদ্ধের সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখে যেতে পারেননি। মুক্তিযেদ্ধাদের মধ্যে এখনো যারা বেঁচে আছেন এবং উত্তরাধিকার প্রজন্মের মধ্যে সেই স্বপ্নের প্রত্যাশা সংক্রমিত হয়ে তা আরো বিস্তৃত ও শক্তিশালী হয়েছে। এভাবেই বংশ পরম্পরায় কোনো দেশের বা সমাজের মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্ন ও প্রত্যাশার লক্ষ্য কখনো বিচ্যুত হয়না। একাত্তুরে যারা অস্ত্র হাতে নিয়ে দেশকে শত্রæমুক্ত করেছেন, আজ তাদের উত্তরসুরিরা কলম-কম্পিউটার হাতে, কৃষকের ট্রাক্টর-কাস্তে কোদাল, শ্রমিকের হাতিয়ার নিয়ে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছেন দারিদ্র্য দূর করে ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে। দেশের কোটি কোটি কৃষক- শ্রমিকদের ঘামে-রক্তে সেই স্বপ্ন পুরণের অঙ্গিকারের বাস্তবায়ন কিভাবে একটি লুটেরা শ্রেণীর হাতে বাজেয়াপ্ত ও লুন্ঠিত হয়ে চলেছে সে বাস্তবতা নতুন প্রজন্মকে সহজেই বিক্ষুব্ধ ও বেদনা বিধুর করে তোলে। দেশে বিনিয়োগের প্রত্যাশা পুরণ হয় না। অথচ দেশ থেকে বছরে লক্ষকোটি টাকা পাচার হয়ে যায়। শাসকশ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতায় ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে দেশের ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া করে বিদেশের ব্যাংকে টাকা সরানোর প্রক্রিয়া চলছে দশকের পর দশক ধরে। সাম্প্রতিক সময়ে টাকা পাচারের এই প্রক্রিয়া সারাবিশ্বেই কমবেশি সংক্রমিত হতে দেখা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে বিষয়টি আলোচিত হয়ে একটি এলার্মিং বাস্তবতা দেখা যাওয়ায় আমাদের দেশের শাসকশ্রেণী মানিলন্ডারিং একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসেবে আখ্যায়িত করে এর দায় এড়ানোর চেষ্টা করতে দেখা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক লেনদেনের নামে এবং প্রবাসি শ্রমিকদের টাকা পাঠানোর অবৈধ হুন্ডি ব্যবস্থা এবং দুর্নীতি, কালো বাজারি, কমিশন বাণিজ্য ও ভ’মিদস্যুতা এবং চাঁদাবাজির মাধ্যমে লব্ধ হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ার এই উদ্বেগজনক প্রক্রিয়া সম্পর্কে বছরের পর বছর ধরে আলোচনা হলেও তা বন্ধ করতে বা সহনীয় মাত্রায় কমিয়ে আনতে সরকারি সংস্থাগুলো চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ ও প্রত্যাশিত পরিবেশ সঙ্কুচিত হলেও অবৈধ আয়ের পথ অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে সুগম হওয়া অর্থ পাচার বৃদ্ধির অনুকুল উপযোগ সৃষ্টি করেছে। আইনের শাসনের অনুপস্থিতি, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা তথা গণতন্ত্রহীনতাই পুঁজি পাচার এবং সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য দায়ী।

গণতন্ত্রের বিপরীতে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থায় আইনের শাসনের বাস্তবতা নির্দেশ করতে বিংশ শতকের মার্কিন ঔপন্যাসিক জর্জ অরওয়েল তার এনিমেল ফার্ম’উপন্যাসে একটি উপমান বাক্য ব্যবহার করেছেন, তা হচ্ছে, ‘অল এনিমেলস আর ইকোয়াল, বাট সাম এনিমেলস আর মোর ইকোয়াল দ্যান আদার্স’। এই বাক্যবন্ধে পাওয়ার এলিটদের পক্ষে আইনের শাসনকে পরিচালনার বাস্তবতা নির্দেশ করা হয়েছে। আইন সবার জন্য সমান, আইনের চোখ অন্ধ, অর্থাৎ আইন জাতিÑধর্ম,বর্ণ ধনী-গরিব দেখবে না, এটাই হচ্ছে আইনের শাসনের মূলনীতি। এমন শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় আইনের অধীনে মানুষ নিজেদের নিরাপদ বোধ করবে। ক্ষমতার অপব্যবহারকারি প্রভাবশালী মহলের দ্বারা সাধারণ মানুষ নিগৃহিত হবে না, বিচার বিভাগ পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে এবং মানুষের জন্য ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা থাকবে, এটাই হচ্ছে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূলনীতি। প্রথমত: গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থার ম্যানিপুলেশন এবং আইনের শাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দেশে দেশে ক্ষমতাদর্পি শাসকশ্রেণীর হাতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও আইনের শাসন বাঁধাগ্রস্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে সমাজ ও সভ্যতার জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে আনা হয়েছে। দেশে দেশে রাজনৈতিত অস্থিরতা, জাতিগত সংঘাত-সহিংসতা, সামাজিক অবক্ষয়, বৈষম্য ও অর্থনৈতিক লুন্ঠনের জন্য এই বাস্তবতাই দায়ী। আইনের চোখে সমানাধিকারের দাবিকে অগ্রাহ্য করা মানে সমাজ সভ্যতার জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে আনা। গণতন্ত্র বাঁধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলছে, এই অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সীমিত গণতন্ত্র ও অধিক উন্নয়নের বুলিও শোনা গেছে মাঝখানে। পুলিশি অ্যাকশনে বিরোধি রাজনৈতিক দলকে রাজনীতির মাঠে নামতে না দেয়া এবং হাজার হাজার মামলায় লাখ লাখ মানুষকে হয়রানি ও ফেরারি করার প্রক্রিয়া এখনো সক্রিয় রয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের মালিকানা কার্যত একটি দুর্নীতিগ্রস্ত পাওয়ার এলিট এবং অস্ত্রধারি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্যদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। তারা এখন জনসাধারণের দুর্বল অংশের গায়ে হাত তুলতে তুলতে গর্বের সাথে বলেন, ‘দেশের রাজা পুলিশ’। সে সব পুলিশ অফিসারের অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা। বিনিয়োগ ও সেকেন্ড হোমের নামে দেশ থেকে পাচার হওয়া লাখ লাখ কোটি টাকার একটি বড় অংশই দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তা ও আমলাদের। মধ্যম সারির একজন পুলিশ কর্মকর্তা ও তার স্ত্রীর নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হাজার কোটি টাকার সম্পদের খবর কয়েক বছর আগে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও আজ পর্যন্ত সে বিষয়ে বিশদ কোনো তদন্ত রিপোর্ট জানা যায়নি। গত বছর দুদকের দুর্নীতি বিরোধি অভিযানে দেশের বিভিন্ন জেলখানার কয়েকজন কারা পরিদর্শকের কোটি কোটি টাকার অবৈধ নগদ অর্থ ও সম্পদের তথ্য জানা যায়। আয়ের সাথে সঙ্গতিহীন কোটি কোটি নগদ টাকার বস্তা গণমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে হাতে নাতে ধরা পড়ার পর সমাজে আলোড়ন সৃষ্টির পর তাদের অবৈধ আয়ের অনৎঘাটিত সম্পদ ও উৎসগুলোর খবর আর পাওয়া যায়নি। একটি অঘটনের অড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে আরেকটি প্রকাশিত-অপ্রকাশিত অপকর্মের চিত্র। আট বছরেও সাগর-রুনী হত্যাকান্ডের মোটিফ জানা যায় নি। নারায়ণগঞ্জের সাতখুনের আসামীরা এখনো আদালতে দাত কেলিয়ে হাসে। চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা ও হাজার কোটি টাকা লুন্ঠন মামলার আসামীরাও সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতালের কেবিনে দীর্ঘদিন ধরে আয়েশি জীবন যাপন করার খবর পাওয়া যায়। অন্যদিকে ২ কোটি টাকার কথিত দুর্নীতির মামলায় রাজনৈতিকভাবে দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষের সমর্থনপুষ্ট তিন বারের প্রধানমন্ত্রী, ৭৫ বছরের বৃদ্ধা, গুরুতর বেগম খালেদা জিয়ার জন্য আইন যেন বড়ই কঠোর ও অন্ধ। আইনের চোক সকলের জন্য সমান, এখানেই তার বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কোটি কোটি ডলার হাতিয়ে নেয়া চক্রের সদস্যরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে, পিকে হালদাররা ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা নিয়ে নির্বিবাদে পালিয়ে যায়, সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ক্যাসিনো কান্ডের অন্যতম গডফাদার জিকে শামিমের একাধিক মামলায় নিরবে জামিন হয়ে যায়। প্রায় একমাস আগে হওয়া জামিনের খবর গণমাধ্যমে ফাঁস না হলে উচ্চ আদালতে জামিন বাতিল হতো না, সে ক্ষেত্রে হয়তো তিনিও আইনগত অবশিষ্ট বাঁধা ডিঙিয়ে বিদেশে পালিয়ে যেতে পারতেন।

গত সপ্তাহে পিরোজপুরের দায়রা জজ আদালতের এক বিচারক দুর্নীতি দমন কমিশনের এক মামলায় সাবেক এমপি ও আওয়ামী লীগের পিরোজপুর জেলা সভাপতি ও তার স্ত্রীর জামিন আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। জামিন নিতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা আদালত অঙ্গনে ব্যাপক শো ডাউন তথা পেশিশক্তির সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন বলে জানা যায়। এহেন বাস্তবতায় অবস্থা আঁচ করেই সরকারি দলের এই ডাকসাইটে নেতাকে স্থানীয় বিচারকের জামিন মঞ্জুর করাই ছিল স্বাভাবিক। আইনের ধারার বাইরেও বিচারকের নিজস্ব কিছু ক্ষমতা থাকে। তিনি জামিন গ্রহণ বা খারিজ করতে পারেন। প্রভাব-প্রতিপত্তি ও রাজনৈতিক চাপ অগ্রাহ্য করে একজন দায়রা জজের জামিন অগ্রাহ্য করার এই ঘটনা বিচারক হিসেবে তাঁর দৃঢ়তার পরিচয় বহন করে। আইনের ব্যত্যয় বা ফাক-ফোকড় থাকলে ভিন্ন আদালত বা উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ খোলা থাকে। পিরোজপুরের সেই সাবেক এমপি যথারীতি সে পন্থা নিয়ে সফলও হয়েছেন। জামিন খারিজ হওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ভিন্ন আদালতে তার জামিন মঞ্জুর হয়ে কারাগারে যাওয়ার হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন। ঘটনাটির এখানেই আপাত পরিসমাপ্তি ঘটতে পারত। কিন্তু না, একজন জেলা দায়রা জজ সরকারি দলের একজন সাবেক এমপি ও জেলা সভাপতির জামিন নামঞ্জুর করে যেন মহা অপরাধ করেছেন। মাত্র চারঘন্টার মধ্যে সেই বিচারক, জেলা ও দায়রা জজ আব্দুল মান্নানকে স্ট্যান্ড রিলিজ করার ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশের বিচার ব্যবস্থার হাল হকিকত উলঙ্গভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। জামিনের আদেশ পাল্টে দেয়া এবং বিচারক প্রত্যাহারের তোলপাড় ঘটনায় গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে আইন মন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তার প্রতিত্তোরের সারমর্ম হচ্ছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্যই হয়তো এমনটা হয়েছে। এটা না করা হলে পরিস্থিতি হয়তো নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যেতে পারত। অর্থাৎ আইনের উপর রাজনৈতিক প্রভাবের শক্তি এখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে। বিচারক ও সরকারের মন্ত্রী-আমলারা কারো প্রতি রাগ-বিরাগ, ভয় বা পক্ষপাতের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে কাজ করে যাওয়ার ওয়াদায় আবদ্ধ থাকেন। এ ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে আদালতে শো-ডাউন এবং আইনের চোখে বিশ্বস্ত একজন বিচারক তাৎক্ষনিকভাবে স্ট্যান্ড রিলিজ হওয়ার মধ্য দিয়ে নি¤œ আদালতের বিচার বিভাগের উপর নিচ ও উপর থেকে প্রভাব সৃষ্টির নজির দেখা গেল। দেশের বিচার বিভাগের উপর শাসক শ্রেণীর এই প্রভাব বলয় প্রত্যাশিত আইনের শাসনকে ভ’লুন্ঠিত করছে। পিরোজপুরের ঘটনায় হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত রুল জারি করলেও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আবারো জনসম্মুখে প্রশ্নবিদ্ধ হলো। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সুবিধামত প্রয়োগ, অপপ্রয়োগ আবার কখনো অন্ধ হয়ে আইনের কঠোরতা আরোপের দৃষ্টান্তগুলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকেউ যেন তীক্ষèভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে। বিচারকের স্ট্যান্ড রিলিজের ঘটনায় টিআইবি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, এই ঘটনাকে তারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য অশনি সংকেত হিসেবে দেখছে। বিচারক প্রত্যাহারকে আইনগত কতৃর্ত¡ বহিভর্’ত ও অবৈধ ঘোষণা শো কজ করে হাইকোর্ট যে রুল জারি করেছে সঠিক সময়ে ও যথাযথ প্রক্রিয়ায় তার বিচার সম্পন্ন করেই কেবল এ ধরনের বির্তক ও অপবাদের অবসান হতে পারে।

বাংলার রাজনৈতিক স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও উন্নয়নের ঐতিহাসিক মানদন্ড যদি নিরূপণ করতে হয় তাহলে তা শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র ভারতবর্ষের জন্য অতুলনীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সুলতানি আমলে বাংলার স্বাধীন সুলতানদের সৌর্য-বীর্য, সততা ও সক্ষমতার ইতিহাসই আমাদের জন্য অনুকরণীয় ও গর্বের বিষয়। দিল্লীর আক্রমন প্রতিহত করে মসলিনের বিশ্ববানিজ্য, বাংলার সম্পদ ও স্বাধীন অস্তিত্ব দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি এখানে ন্যায় বিচার ও আইনের শাসন নিশ্চিত করার অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন চতুর্দশ শতকের ইলিয়াস শাহী রাজবংশের স্বাধীন সুলতানরা। সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ্র সময়কাল ১৩৯০ থেকে ১৪১১ খৃষ্টাব্দ। পাশ্চাত্ব ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে যে সময়টাকে মধ্যযুগ বলে আখ্যায়িত করা হয়। মধ্যযুগ মানে অন্ধকার যুগ, বিচারহীনতা ও সামন্তবাদি শোষণের যুগ। সে সময় বাংলার শাসক গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ বাংলায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছিলেন। সে সময়ের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার দৃষ্টান্ত হিসেবে একটি গল্পের উদাহরণ দেখা যায়, যেখানে সুলতান নিজেই হত্যা মামলার আসামী হয়ে কাজীর দরবারের বিচারের সম্মুখীন হয়েছিলেন। কথিত আছে, সুলতান তীর-ধনুক নিয়ে শিকারে গিয়ে তীর ছোঁড়ার সময় অনবধানে এক এক বিধবার ছেলের হাতে লেগে ছেলেটি আহত হয়। বিধবা নারী ছেলেকে তীরবিদ্ধ করার বিচার চাইতে কাজী সিরাজউদ্দিনের কাছে নালিশ জানান। কাজী সিরাজ উদ্দিন সুলতানকে তার আদালতে হাজির করতে একজন পেয়াদা পাঠান। সুলতানের কাছে দ্রæত সহজে পৌছানোর জন্য সেই পেয়াদা কৌশল হিসেবে অসময়ে রাজদরবারের কাছে আজান দিতে শুরু করলে সুলতান তাকে তার কাছে হাজির করার আদেশ দেন। সুলতানের কাছে গিয়ে কাজীর পেয়াদা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরে তাকে কাজির দরবারে হাজির হতে বলেন। সময় ক্ষেপন না করেই তিনি কাজীর দরবারে রওয়ানা হওয়ার আগে লুকিয়ে একটি ছোট তরবারি সঙ্গে নেন। তার আসনে বসা কাজী সুলতানকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ফরিয়াদি বিধবার অভিযোগ তুলে ধরে তাকে শান্তনা দিয়ে খুশি করার আদেশ দেন। সুলতান সেই মহিলার কাছে দু:খ প্রকাশ ও ক্ষমা চেয়ে তাকে বিপুল পরিমান টাকা পয়সা দিয়ে সন্তুষ্ট করেন। এরপর কাজী ফরিয়াদি বিধবাকে প্র্শ্ন করেন, ‘তুমি কি ক্ষতিপুরণ পেয়েছ, খুশি মনে অপরাধিকে ক্ষমা করেছ? বিধবার জবাব, জি হুজুর আমি খুশি মনে সুলতানকে ক্ষমা করে দিয়েছি।’ ্এরপর কাজী তার আসন থেকে নেমে এসে সুলতানকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেন। তখন সুলতান লুকিয়ে রাখা তরবারি বের করে বলেন, আপনি যদি সুলতান হিসেবে আমার প্রতি পক্ষপাত দেখিয়ে ফরিয়াদিকে যথাযথ বিচার থেকে বঞ্চিত করতেন, তাহলে আমি এই তরবারি দিয়ে আপনার মাথা দ্বিখন্ডিত করতাম। সাথে সাথে কাজী সিরাজউদ্দিনও তার আসনের পাশে রাখা বেত সামনে এনে বলেন, আপনি যদি দোষ স্বীকার না করে পার পাওয়ার চেষ্টা করতেন হাহলে আল্লাহর কসম, আপনার প্রতি বেত্রাঘাতের শাস্তি দিতে আমি এক মিনিটও বিলম্ব করতাম না। আমার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও আমি ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতাম, যাই হোক, আল্লাহ আমাকে অনেক বড় বিপদ থেকে বাঁচিয়েছেন। ’ এটি সুলতানি আমলে বাংলার বিচার ব্যবস্থার উদাহরণ। দিল্লীর স¤্রাট জাহাঙ্গিরের স্ত্রী নূরজাহানের ছোঢ়া তীরে এক ধোপা নিহত হওয়ার পর নিহতের স্ত্রী ফরিয়াদি হয়ে স¤্রাটের দরবারে বিচার চাইলে স¤্রাট নূরজাহানকে আটকের আদেশ দিলেন। ধোপার বিধবা স্ত্রী হত্যার বদলে হত্যার শাস্তি দাবি করেন। এক সপ্তাহ পর বিচারের রায়ে মামলার বাদীর হাতে তীর-ধনুক দিয়ে হত্যার বদলে হত্যা এবং বিধবার যন্ত্রনা বুঝানোর জন্য নূরজাহানের স্বামীর বুকে তীর মেরে হত্যার আদেশ দেন। স¤্রাটের এই আদেশ শুনে ধোপার বিধবা স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে বললেন, মহামান্য বাদশা আমি এ বিচার চাইনা। আমি বিধবা হয়েছি, তবে এতিম হতে চাইনা। আমার স্বামী শুধু আমার ভরণ-পোষন যোগাত আর আপনি সারাদেশের সব মানুষের মা-বাপ ও পরম আশ্রয়। আপনি দীর্ঘজীবী হোন। বাদীর এ বক্তব্য শুনে রাজদরবারে দমবন্ধ নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে সবার মধ্যে যেন প্রাণ ফিরে এলো। বাদশা ধোপার স্ত্রীকে ক্ষতিপুরণ হিসেবে প্রচুর টাকা পয়সা দিয়ে বিদায় দিলেন। এটা ছিল বাংলার মধ্যযুগ। পশ্চিমা বিশ্ব যখন ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সামন্তবাদী শোষণের জালে বন্দী, বাংলার সুলতানরা তখন বিচার বিভাগকে শুধু স্বাধীনই করেননি, তারা ন্যাবিচারের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। আজ একবিংশ শতকে এসে লাখো মানুষের রক্তে স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন দলের একজন মধ্য সারির নেতার জামিন নাকচ করায় বিচারককে প্রত্যাহৃত হতে দেখছি। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ রায় ঘোষণার পর দেশের প্রধান বিচারপতিকে দেশান্তরি হতেও দেখেছি। উন্নয়নের মহাসড়কে কতটুকু এগিয়েছি আমরা?
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
jack ali ১২ মার্চ, ২০২০, ১২:২০ পিএম says : 0
Democracy means Hypocrisy: Allah created human being and gave them a book of Guidance. We must follow the guidance books then all the crime will be eliminated from our societies.. We the general public are oppressed by the Government and their political elements - we are hopeless and helpless.. We cannot endure any more oppression and torture.. Again we need to fight these criminal to liberate our country again..
Total Reply(0)
নূরুল্লাহ ১৪ মার্চ, ২০২০, ২:৫০ পিএম says : 0
উপর সারির পুলিশ সম্পর্কে যেমন আমরা বিস্মিত বোধ করি না, আগামিতে মধ্যম সারি সম্পর্কেও কেউ বিস্ময় প্রকাশ করবে না, বাঙালিরা সইতে শিখবে।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন