বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

মানবসম্পদ উন্নয়নে ইসলাম

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ১২ মার্চ, ২০২০, ১২:০২ এএম

মানুষ মহান আল্লাহর সর্বোৎকৃষ্ট সৃষ্টি। এই মানুষকে কেন্দ্র করেই সমগ্র সৃষ্টিজগতের সকল আয়োজন। আধুনিককালে মানুষের জীবন কীভাবে আরো ফলপ্রসূ করা যায় তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হচ্ছে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ এই মানুষের উন্নয়ন সাধন করে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিয়োজিত করতে হলে প্রয়োজন যথার্থ কৌশল প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন। আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য একমাত্র জীবনব্যবস্থা ইসলাম মানবসম্পদ উন্নয়নে কী কী নির্দেশনা দিয়েছে তা এই প্রবন্ধে সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হয়েছে।
মানবসম্পদ উন্নয় আধুনিক উন্নয়ন চিন্তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ ধারণা। বিশ শতকের শেষ দশকে এ ধারণার প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ ঘটে। বর্তমানে উন্নয়ন চিন্তার ক্ষেত্রে মানবসম্পদ উন্নয়ন ধারণাটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে এবং সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। কারণ অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কিংবা অন্য যে উন্নয়নের কথাই বলা হোক, সকল উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মানবসম্পদ। একে ঘিরে এবং এর জন্যই সকল উন্নয়ন প্রচেষ্টা। টেকসই উন্নয়ন, সমন্বিত উন্নয়ন ধারণা, সামগ্রিক উন্নতি বা সর্বাত্মক সুষম উন্নয়ন, সকল ক্ষেত্রে মানুষের সুখ-সুবিধাই মূল বিবেচ্য হয়ে থাকে। মানবসম্পদ উন্নয়ন ছাড়া প্রাকৃতিক, নৈসর্গিক বা পরিবেশগত কোনো সুবিধা গ্রহণ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। বর্তমাান উন্নয়ন ধারায় প্রথমে তাই মানবসম্পদ উন্ননে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণকে আবশ্যিক বলে গণ্য করা হয়। ইসলাম গোড়া থেকেই মানবসম্পদ উন্নয়নকে সামগ্রিক উন্নয়নের প্রথম এবং প্রধান শর্ত হিসেবে গণ্য করেছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলাম মানবকে সত্যিকারার্থে শ্রেষ্ঠতম সম্পদ বলে ঘোষণা করেছে এবং এর উন্নয়নে প্রয়োজনীয় বিধি-ব্যবস্থাসমূহ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বাস্তব উদ্যোগে গ্রহণ করেছে।
ইসলামে মানব উন্নয়ন আর্থসামাজিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক উন্নয়নের মূল বিষয়। কোরআনের মৌলিক বিষয় হলো মুসলিমের আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত সমৃদ্ধি ও কল্যাণের জন্য মানব উন্নয়ন এবং মানবসম্পদ গঠন। এ উন্নয়নের জন্য ইসলাম মানুষের দৈহিক আকৃতিতে মানুষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানবিক ঔদার্য ও মানসিক সৌন্দর্যের অধিকারী হওয়ার ওপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। ইসলাম ঘোষণা করেছে, আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি হিসেবে মানুষ সম্মানিত এবং শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ তায়ালাই মানুষকে এ শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তিনি সেই সত্তা, যিনি তোমাদের দুনিয়ার প্রতিনিধি বানিয়েছেন।’
তিনি অন্যত্র বলেছেন, নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দিয়েছি, তাদের স্থলভাগে ও সাগরে চলাচলের বাহন দিয়েছি, তাদের পবিত্র জীবিকা দিয়েছি এবং আমি যাদের সৃষ্টি করেছি, তাদের অনেকের ওপর তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। তবে মানুষের এ শ্রেষ্ঠত্বকে আল্লাহ তায়ালা স্থায়ী ও অক্ষয় করে দেননি, বরং মানুষের আচরণিক ও আত্মিক উন্নয়ন করা এবং না করার ওপর এর ভিত্তি স্থাপন করেছেন।
কেউ যদি আল্লাহ তায়ালার নির্দেশনা মেনে নিজের আচরণ ও মানসিকতা উন্নত করে, তাহলে সে তার শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবে। আর যদি এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়, তাহলে নিচ থেকে নিচতর স্তরে নেমে যাবে। ‘আল্লাহ তায়ালা এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমি মানুষকে সুন্দরতম করে সৃষ্টি করেছি। এরপর আমি তাকে সর্বনিম্ন স্তরে নামিয়ে দিয়েছি।’ মানুষের মর্যাদা ও সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার পথ হিসেবে আচরণিক ও আত্মিক উন্নয়ন অনিবার্য করে ইসলামে মানবসম্পদ উন্নয়ন চেষ্টা নৈতিকভাবে সবার জন্য বিধিবদ্ধ উপায়ে আবশ্যিক করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে আবশ্যিক হয়েছে জ্ঞান অর্জন, হালাল জীবিকা উপার্জন ও গ্রহণ, স্বনির্ভরতা অর্জন, কর্তব্য পালন, যোগ্যতা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বারোপ, আখেরাতে সফলতা-ব্যর্থতাকে মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ এবং বিশেষভাবে নৈতিক উন্নয়ন।
মোমিন হওয়ার জন্য জ্ঞান অর্জনকে ইসলাম প্রথম শর্ত হিসেবে গণ্য করেছে। আল্লাহ তায়ালা প্রথম মানুষ আদম (আ.) কে সৃষ্টির পর সবার আগে বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞান দান করেছেন এবং এ জ্ঞানের পরীক্ষাতেই আদম (আ.) এর মাধ্যমে ফেরেশতাদের ওপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। কোরআনে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, আল্লাহ আদমকে প্রতিটি বিষয়ের নাম শেখালেন। এরপর তা ফেরেশতাদের সামনে পেশ করলেন এবং বললেন, ‘যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক, তাহলে আমাদের এগুলোর নাম জানাও।’ ফেরেশতারা বললেন, ‘আপনি মহাপবিত্র। আপনি আমাদের যা শেখান, তা ছাড়া আমাদের কোনো জ্ঞান নেই। নিশ্চয়ই আপনি মহাজ্ঞানী, মহাপ্রজ্ঞাময়।’ আল্লাহ বলেন, ‘হে আদম! তুমি তাদের বিষয়গুলোর নাম জানিয়ে দাও।’ এরপর যখন আদম তাদের বিষয়গুলোর নাম জানিয়ে দিলেন, আল্লাহ তায়ালা বললেন, আমি কি তোমাদের বলিনি যে, নিশ্চয়ই আমি আকাশগুলো ও পৃথিবীর অদৃশ্য সম্পর্কে জানি? আর আমি খুব ভালোভাবেই জানি, যা তোমরা প্রকাশ করো এবং যা গোপন রাখ। যখন আমি ফেরেশতাদের বললাম, তোমরা আদমকে সিজদা করো, তখন ইবলিস ছাড়া সবাই সিজদা করল। ইবলিস অবাধ্য হলো ও অহংকার করল এবং সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।
রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন রিসালাত লাভ করলেন, তখন তাঁর ওপর প্রথম যে ওহি নাজিল হলো তা-ও জ্ঞানার্জনবিষয়ক। হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রথম ওহি লাভ করলেন-পড়–ন আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন; যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পড়–ন এবং আপনার প্রতিপালক মহাসম্মানিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন তা, যা সে জানত না। জ্ঞানকে মর্যাদা ও কল্যাণের বাহন বর্ণনা করে কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা তাদের মর্যাদা উচ্চ করে দেবেন।’ আল্লাহ তায়ালা সাধারণভাবে জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি উচ্চতর গবেষণারও নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘অতএব হে চক্ষুষ্মান মানুষ! তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো। জ্ঞানের প্রতি আল্লাহ তায়ালার এমন গুরুত্বারোপের পাশাপাশি রাসুলুল্লাহ (সা.) জ্ঞান অর্জনকে ফরজ ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রতি মুসলিমের ওপর ফরজ। জ্ঞানীকে তিনি নবী-রাসুলদের উত্তরসূরি আখ্যায়িত করে বলেছেন, আলেমরা নবীদের উত্তরাধিকারী। আর নবীরা উত্তরাধিকার হিসেবে দিনার বা দিরহাম রেখে যাননি। তারা উত্তরাধিকার রেখে গেছেন শুধু জ্ঞান। তাই যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জন করেছে সে অর্জন করেছে উত্তরাধিকারের পুরো অংশ। জ্ঞানার্জনের কাজকে তিনি আল্লাহর পথে জিহাদের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণে বের হয়েছে, সে আল্লাহর পথে রয়েছে, যতক্ষণ না সে প্রত্যাবর্তন করে।’ এভাবে ইসলাম জ্ঞানার্জন ও গবেষণার কাজকে বাধ্যতামূলক রেখে মানবসম্পদ উন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এতে এমন বিধান রাখা হয় যে, একজন মানুষ মুসলিম হলে তাকে অবশ্যই শিক্ষিত হতে হয়। শিক্ষিত হওয়া ছাড়া মুসলিম হওয়ার বিষয়টি বিধিগতভাবে অসম্ভব বলে গণ্য হয়।
আল্লাহ তায়ালার ইবাদত যেমন ফরজ, ইসলামে জীবিকা উপার্জনকে তেমন ফরজ করা হয়েছে। কোরআনে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘এরপর যখন সালাত আদায় শেষ হবে, তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে, আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করবে এবং আল্লাহর বেশি বেশি জিকর করবে, এতে তোমরা সফল হবে।’ আবার জীবিকা উপার্জনের ক্ষেত্রেও হালাল-হারামের সীমারেখা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে এমন প্রবলভাবে যে, ইবাদত কবুল হবে কিনা, ব্যক্তি জান্নাতে যাবে কিনা, তা একান্তভাবে জীবিকা উপার্জনের পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল রাখা হয়েছে। ফলে ইসলামে একজন ব্যক্তি শুধু জীবিকাই উপার্জন করে না, বরং হালাল উপায় অবলম্বন করে বৈধভাবে জীবিকা উপার্জন করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হালাল উপার্জন অন্বেষণ করা ফরজের পরে ফরজ।’
ইসলাম সাধারণভাবে মানুষকে কর্তব্যপরায়ণ হিসেবে ঘোষণা করেছে। সবার জন্য অর্পিত কর্তব্য পালন আবশ্যিক করেছে এবং এক্ষেত্রে যে কোনো অবহেলাকে আল্লাহ তায়ালার কাছে জবাবদিহিতার বিষয় বলে সতর্ক করেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব ইমাম বা নেতা, যিনি জনগণের ওপর দায়িত্ববান, তিনি তার অধীনদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবেন। ার ব্যক্তি, যে তার পরিবারের সদস্যদের দায়িত্বশীল, সে তার পরিবারের সদস্যদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী দায়িত্বশীল তার স্বামীর পরিবারের সদস্যদের ও সন্তানসন্ততির, সে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। আর দাস ব্যক্তি তার মনিবের সম্পদের দায়িত্বশীল এবং সে এ সম্পদের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।
বস্তুত মানুষের প্রকৃত উন্নয়ন, মানবিক ও নৈতিক গুণে বিভূষিত হওয়া, মানুষকে আত্মিক ও বাহ্যিক দিক থেকে সত্যিকার গুণ ও আচরণে সমৃদ্ধ সম্পদে পরিণত করার ক্ষেত্রে আধুনিক বিশ্বে প্রচলিত সকল চেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। সে কারণে তথাকথিত সভ্য সমাজে, অফিসে, দেশে, পরিবারে মানুষের কাছে মানুষের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। মানুষই মানুষের সম্পদ, সম্মান ও জীবনের হুমকিতে পরিণত হচ্ছে। মানুষের আচরণ স্বার্থপরতা, হীনতা ও পাশবিকতায় ভরে ওঠেছে। এ অবস্থা নির্মূল করে মানুষকে সত্যিকারার্থে সম্পদে পরিণত করার জন্য ইসলামী আদর্শ ও শিক্ষার অনুশীলন অনিবার্য-আলোচ্য নিবন্ধে উপস্থাপিত তথ্য, প্রমাণ ও বিশ্লেষণ এ বিষয়টির অবিসংবাদিত প্রমাণ। এ কারণে মানবসম্পদের চিরস্থায়ী উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য সর্বক্ষেত্রে ইসলামের অনুশীলন অনিবার্য।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন