শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

আল্লাহর নাফরমানির করুণ পরিণতি

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ১৩ মার্চ, ২০২০, ১২:০৩ এএম

কেবল বারো হাজার সৈন্য নিয়ে বাদশাহ বাবর ভারত আক্রমণ করলেন। জয় করে নিলেন বিশ কোটি মানুষের বিশাল জনপদ। এরপর মুত্তাকি-পরহেজগার, খোদাভীরু শাসক একের পর এক ভারত শাসন করে আসছিলো। এভাবেই ক্রমাগত ভারতবর্ষে ইসলাম ও মুসলমানদের উত্থান হচ্ছিলো। বছরের পর বছর ধরে মুসলমানরাই এসব অঞ্চল শাসন করেছিলো। এরপর যখন মুসলিম শাসকদের অবস্থায় পরিবর্তন এলো, ধর্মীয় অধঃপতন শুরু হলো, নিজেদের দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা আরম্ভ হলো, তখন তাদেরকে তাদের কর্তব্যের ডাক দিয়ে জাগানো হলো। কিন্তু তাদের সে গভীর ঘুম ভাঙলো না। এরই মাঝে বাদশাহ আকবর তার মনগড়া দীন-ই-এলাহি প্রতিষ্ঠা করলো। তখনও পর্যন্ত আল্লাহর কোনো শাস্তি তাদের ওপর আসেনি। এভাবে দিনদিন যখন তাদের অবস্থায় অবনতি ঘটলো, আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগিতে উদাসীন হলো, আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতায় মত্ত হলো, মদপানসহ নানাধরনের গর্হিত কাজ শাহিমহলে সদর্পে হতে লাগলো, সৃষ্টির সেবার পরিবর্তে খাহেশাতে নাফসানি (মনচাহিদা পূরণ) মনোভাব তাদের মাঝে জন্মালো, দীন হেফাজতের দায়িত্বশীল হয়ে নিজেরাই দীন বরবাদ করলো, তাদের কারণে জনসাধারণের মাঝেও দীনি অধঃপতন পরিলক্ষিত হলো, তখন হজরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি (রহ.) ঘরে ঘরে গিয়ে সবাইকে ডেকে বললেন-‘হে আল্লাহর বান্দারা! এখনও সময় আছে, আল্লাহর নাফরমানি থেকে ফিরে এসো। আমি দিল্লির অলিগলিতে শুধু মানুষের রক্ত দেখছি।’ কিন্তু কোথায়! মানুষ তাঁর কথায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করলো না। উপরন্তু এ বলে তাচ্ছিল্য করলো-‘আরে মোল্লাদের খেয়েদেয়ে কাজ নেই, শুধু এ কাজই করে বেড়ায়, তাদের মাথা ঠিক নেই।’ পরিশেষে যা হওয়ার তা-ই হলো। আল্লাহ তাদেরকে লাঞ্ছিত করে শতো শতো বছর ইংরেজ বেনিয়াদের গোলাম বানিয়ে রাখলেন। দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে তাদেরকে ভয়ানক জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে শায়েস্তা করলেন। আহমদ শাহ আবদাল এলো, নাদের শাহ এলো। বাদশাহকে বলা হলো- জাহাপনা! শত্রু আক্রমণ করতে আসছে। প্রায় দ্বারপ্রান্তে। নেশার ঘোরে উন্মাদ বাদশাহ উত্তরে বললো-‘আরে রাখো, এক পেয়ালা আওর দো।’ এরপর হাতের কাগজখন্ডটি শরাবের পেয়ালায় ডুবিয়ে রেখে বললো-‘আরেক গ্লাস দাও।’ পরিশেষে মন্ত্রীবর্গ নিজেরাই এগিয়ে গিয়ে নাদের শাহকে অভ্যর্থনা জানালেন। অনেক আদর-আপ্যায়নে তাকে রাজকীয় মেহমানের মর্যাদা দিলেন। যেহেতু শত্রুপক্ষের সঙ্গে মোকাবেলার শক্তি ও সাহস কোনোটাই ছিলো না তাদের, তাই নিরূপায় হয়ে তারা এ পথটিই বেছে নিলেন। নাদের শাহ বুঝতে পারলো, এ এক ষড়যন্ত্র। সঙ্গে সঙ্গে খাপ থেকে তরবারি বের করে দিল্লির স্বর্ণমসজিদের ফটকের ওপর বসে পড়লো। যাকে যেখানে পেতো, হত্যা করতে আরম্ভ করলো। শুরু হলো এক ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ। নির্বিচারে হত্যার ফলে যমুনা সেতুর ওপর লাশের স্তুপ দেখা গেলো। মৃতদেহের সংখ্যা বাড়ায় পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলো প্রায়। নদীর পানি লাশে লাশে একাকার হয়ে গেলো। দিল্লির অনেক জায়গায়ই মৃতদেহে ভরপুর। তখন বাকায়ি বংশের কিছু লোক গোপনে বাদশাহর দরবারে উপস্থিত হয়ে আরজ করলো-‘জাহাপনা! বাদশাহর সঙ্গে বাদশাহর লড়াই, নিরীহ প্রজাদের অপরাধ কোথায়? কেনো তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে?’ এ কথা শুনে বাদশাহ এবার তাঁর তরবারি কোষবদ্ধ করলেন। অবসান ঘটালেন হত্যাযজ্ঞের এক ভয়ানক ট্রাজেডির। এরপর বাদশাহ তাঁর রাজসিংহাসনে আসন নিলেন। তখন থেকে পুরোনো শাসনব্যবস্থায় এলো আমূল পরিবর্তন। শেষ হয়ে গেলো আগের সব রাজব্যবস্থা ও শাসননীতি। মহান রাব্বুল আলামিন দেখালেন, ইজ্জতঅলা কিভাবে বেইজ্জত হয়; হীন-দুর্বল ব্যক্তিরা কিভাবে শক্তিশালী ও সসম্মানী হয়। তাই তো মানুষ বহু যুবরাজ-শাহজাদাকে মানুষের কাছে হাত পাততে এবং দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষে চাইতে দেখেছে। আহকামুল হাকিমিনের এ এক রহস্যময় করুণ লীলা। মানুষের জন্য এতে রয়েছে অনেক বড় শিক্ষা। হায় আফসোস, মানুষ যদি আজ তা অনুধাবন করতো। মহান রাব্বুল আলামিন ভারতের মুসলমানদেরকে তাদের অন্যায়-অসত্যের বিভোর নিদ্রা থেকে বহুবার জাগ্রত করেছেন। তাদের অশুভ পরিণতির সতর্ক-সঙ্কেত দিয়েছেন। এতোসবের পরও তারা তাদের নাফরমানি ও অপকীর্তির ঘুম থেকে এতোটুকুও সজাগ হয়নি। তবুও মহান রাব্বুল আলামিন তাদেরকে আবার সুযোগ দিয়েছেন। তাদের সে জমিদারি ও নবাবি বহাল রেখেছেন। কিন্তু পরিশেষে যখন তারা ক্ষমতা ও রাজত্বের নেশায় উন্মাদ হলো, আল্লাহর নেয়ামতের শোকর আদায়ের পরিবর্তে না-শোকর করলো, পরজগতের জন্য পাথেয় সংগ্রহের পরিবর্তে দুনিয়া উপার্জনে আত্মহারা হলো, সৃষ্টিসেবার পরিবর্তে নিজের অন্যায় স্বার্থচরিতার্থ করতে ব্যাকুল হলো, আল্লাহর হুকুম পালনের পরিবর্তে তাঁর মর্জিবিরুদ্ধ এমন সব কার্যকলাপে মত্ত হলো, যা দেখে কাফের-মুশরিক এমনকি শয়তানও লজ্জায় হার মানতো- তখন আল্লাহতায়ালা তাদের থেকে তাঁর দেওয়া নেয়ামত ছিনিয়ে নিলেন, তাদের জমিদারি শেষ করলেন, নবাবি খতম করলেন। শেষপর্যন্ত মানুষ বহু নবাব-জমিদারকে দেখেছে জীবিকার তাগিদে পথে পথে ঘুরতে, মানুষের কাছে ভিক্ষে চাইতে। আর অভিজ্ঞতায়ও প্রমাণ, এককালের বড় বড় জমিদার, বিরাট বিরাট নবাব রাস্তার ফকির হয়ে কোনোদিন হয়তো একমুঠো ভাত কিংবা এক টুকরো পরনের কাপড়ও জোটাতে পারেনি। আফসোস, এতোকিছুর পরও আজ মুসলিম জাতি সামান্যতম শিক্ষা গ্রহণ করে না। তারা কখনও চিন্তা করে না, আজকের শতো বিপর্যয়, বালা-মসিবত, বিপদাপদ কেনো হচ্ছে? কী কর্তব্য আমাদের? কী করা উচিৎ আমাদের? জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যই বা কি? কেনো আল্লাহতায়ালা নেয়ামত দিয়েও ছিনিয়ে নিচ্ছেন। এ সবকিছু অনুধাবন করে আমাদের জীবনের গতিধারার কোনোই পরিবর্তন নেই। আমাদের রাজত্ব ও নবাবি শেষ হয়েছে ঠিক, কিন্তু মন-মানসিকতা, চিন্তাধারা ও কাজেকর্মে এখনও তার প্রভাব-প্রতিফলন রয়ে গেছে। ফলে সেই উদাসীনতা, আরামপ্রিয়তা, প্রতারণা-প্রবঞ্চনা, দম্ভ-অহঙ্কার, অন্যায়-নাফরমানি, জুলুম-অবিচার, কাজেকর্মে অজ্ঞতা ও অক্ষমতা, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি অনীহা, বাণিজ্যনীতিতে অনভিজ্ঞতা, পরস্পরে হিংসা-বিদ্বেষ, মামলা-মোকাদ্দমা, সুদ-ঘুষ, যশ-খ্যাতির লালসা, অন্যায় স্বার্থ চরিতার্থ করা, কামপ্রবৃত্তি, আমানতের খেয়ানত, অন্যের মাল আত্মসাৎ, বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই, শক্তির প্রতিযোগিতা, শিরক-বেদাত, শরিয়তগর্হিত রুসুম-রেওয়াজ, ইত্যাদি হাজারো প্রকারের আত্মিক ব্যাধিতে আজ আমরা আক্রান্ত। অবাক লাগে, এসব অপকর্ম সাধনে কারও যদি প্রচুর অর্থসম্পদ না থাকে, তাহলে সে সুদ দিয়ে হলেও ঋণ নেয়; নতুবা ঘরবাড়ি, জায়গা-জমি কিংবা স্ত্রীর অলঙ্কার বন্ধক রাখে; তবুও সে তার এ অন্যায় কাজের মিশন চালু রাখে। পরিশেষে সব খুইয়ে যখন একেবারে নিঃস্ব হয়ে যায়, তখন নিরূপায় হয়ে জীবিকার সন্ধানে বেরোয়। কিন্তু আয়-রোজগার করার মতো তেমন কোনো কাজও জানা থাকে না। কর্মপন্থায় অনভিজ্ঞ। ফলে আয়-রোজগারের কোনো সম্মানজনক কর্মব্যবস্থা তার ভাগ্যে জোটে না। শেষ পর্যন্ত জীবন বাঁচানোর তাগিদে নেহাৎ তুচ্ছ এক অপমানজনক খাটুনি খেটে কিংবা ভিক্ষেবৃত্তি করে জীবন নির্বাহ করে। এ হলো আল্লাহর নাফরমানির করুণ পরিণতি। এককালের নেহাৎ তুচ্ছ, অসহায়-দরিদ্র মানুষের দ্বারে আজ ভিক্ষে চাইছে তৎকালের সম্ভ্রান্ত ও ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ। খুব আক্ষেপের বিষয়, এতোকিছুর পরও মুসলিমজাতির চোখ খোলেনি আজও পর্যন্ত। জানি না- এ চোখ কবে খুলবে? তবে কি মুসলিমজাতি এরচেয়েও বড় কোনো মহাপ্রলয়ের অপেক্ষায় রয়েছে?

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (9)
মেহেদী ১৩ মার্চ, ২০২০, ১:৩৬ এএম says : 0
আল্লাহ তায়ালা আমাদের ক্ষমা করুন। নাফরমানি থেকে বেঁচে থাকার তৌফিক দিন।
Total Reply(0)
কে এম শাকীর ১৩ মার্চ, ২০২০, ১:৩৬ এএম says : 0
সৃষ্টিকর্তার সাথে গাদ্দারি েকরে কখনও কেউ ভালো লাগতে পারে না।
Total Reply(0)
মেহেদী ১৩ মার্চ, ২০২০, ১:৩৭ এএম says : 0
যতই পরিণত ভোগ করুক খারাপ লোকগুলো কোনো শিক্ষা নেই না।
Total Reply(0)
Md Monzoor Hossain ১৪ মার্চ, ২০২০, ১:১৭ পিএম says : 0
"এরপর মুত্তাকি-পরহেজগার, খোদাভীরু শাসক একের পর এক ভারত শাসন করে আসছিলো।" stop telling lie, they were never "মুত্তাকি-পরহেজগার, খোদাভীরু শাসক" if you know the history you wont tell this lie. Your guys are destroying the commuinity with this kind of tells of rubbish
Total Reply(0)
Monjur Rashed ১৪ মার্চ, ২০২০, ৩:০৯ পিএম says : 0
After conclusion of the regime of " Kholafa E Rasheda " , no Muslim monarchy was truly ethical.
Total Reply(0)
জামসেদ ১৭ মার্চ, ২০২০, ১:০৮ পিএম says : 0
বাদশাহ আকবর তার মনগড়া দীন-ই-এলাহি প্রতিষ্ঠা করে ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি করে।
Total Reply(0)
abc ১৮ মার্চ, ২০২০, ৪:১১ এএম says : 0
Kuub Valo lekha.
Total Reply(0)
মোঃ আরিফুল ইসলাম ৩১ মার্চ, ২০২০, ১:৫৯ এএম says : 0
নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার নারায়ে রিসালাত ইয়া রাসূলুল্লাহ(সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আহলে সুন্নাত ওয়াল জাময়াত জিন্দাবাদ।
Total Reply(0)
Rasadul Islam Emon ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৯:৫২ পিএম says : 0
ভাই দিল্লী তে যমুনা সেতু কোথায় থেকে আসলো?
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন