২৮ বছরের অচলায়তন ভেঙ্গে প্রত্যাশার জাহাজ নিয়ে গত বছরের ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় ডাকসু নির্বাচন। ওইদিন ভোট গ্রহণ শেষে সন্ধ্যায় বিভিন্ন হল থেকে ভোটের হিসেব আসতে থাকলেও কেন্দ্রীয় সংসদের ফলাফল ঘোষণা করা হয় রাত দু’টোয়। এ নিয়ে গোড়াতেই বিতর্ক শুরু হয়। ফলাফলে কেন্দ্রীয় সংসদের ২৫ পদের মধ্যে সহ-সভাপতি পদে নুরুল হক নুর ও সমাজসেবা সম্পাদক পদে আকতার হোসেন ছাড়া বাকি ২৩টিতে ছাত্রলীগ প্যানেলের প্রার্থীদের বিজয়ী দেখানো হয়।
একই বছরের ২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্রতিনিধিরা। গত বুধবার নির্বাচনের এক বছর পূর্ণ হওয়ায় শিক্ষার্থীরা হিসেব মেলাচ্ছেন প্রত্যাশার কতটুকু পূরণ করেছে ডাকসু। অন্যদিকে মেয়াদ শেষ হতে চললেও নতুন নির্বাচনের আলোচনা শুরু না হওয়ায় আবারও অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ডাকসু বন্ধ হতে চললো কিনা সে শঙ্কা মুখে মুখে।
দ্বিমতেই শুরু ও শেষ : দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বিভক্তি, বিরোধ ও বিতর্কে বছর পার করে কেন্দ্রীয় সংসদ। প্রথম বৈঠকেই ডাকসুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আজীবন সদস্যপদ দেওয়া নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েন নেতারা। ছাত্রলীগ প্রস্তাব তুললেও নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীকে আজীবন সদস্যপদ দেওয়ার বিষয়ে আপত্তি জানান ভিপি। দ্বিধা বিভক্তির কারণে পূর্ব ঘোষিত অভিষেক অনুষ্ঠানও হয়নি। বিশেষ করে ভিপি, জিএস ও এজিএস সাদ্দাম হোসেনের বৈরী সম্পর্কের কারণে বিতর্ক সমালোচনা এক বছরেও শেষ করা সম্ভব হয়নি।
ভিপির ওপর হামলা লাঞ্ছনা : নির্বাচিত হওয়ার পরেই ভিপি নুরুল হক নুরকে শিবির আখ্যা দিয়ে নাটকের জন্ম দেয় ছাত্রলীগ। এপ্রিল মাসে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে নুরসহ নারী শিক্ষার্থীদের লাঞ্ছিত করে তারা। ২২ ডিসেম্বর ডাকসু ভবনে ভিপিসহ তার সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। এসব ঘটনার তদন্ত শেষ করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ভিপিকে হত্যার হুমকি দেয়ার অভিযোগ করেছেন তিনি। সর্বশেষ ছাত্রলীগের কনিষ্ঠ এক কর্মীর হত্যার হুমকি আলোচনার জন্ম দেয়।
ছাত্রলীগ স্টাইলে হল সংসদ : বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলের ১২টিতে ভিপি আর ১৪টির জিএস পদে জয়ী হয় ছাত্রলীগ। হল সংসদে নির্বাচিত হওয়া অধিকাংশ নেতা ছাত্রলীগে পদ প্রত্যাশী। ফলে বিশ^বিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্রলীগের কমিটি না থাকায় ছাত্রলীগ স্টাইলে পরিচালিত হয়েছে ছাত্র হলের হল সংসদগুলো। হলগুলোতে চলা ‘গণরুম’ ও ‘গেস্টরুম’ সংস্কৃতি বন্ধ করার পরিবর্তে হল সংসদ বিষয়টিকে বৈধতা দিয়েছে। ছাত্রলীগের শোভন-রাব্বানী কমিটির সময়ে হল সংসদের প্রোগ্রামগুলোতে ছাত্রলীগের নিজস্ব প্রোগ্রামের মত করে অতিথি আনা হয়েছে। হল সংসদের অধিকাংশ কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি, বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতিসহ ডাকসু নেতা নয় এমন ছাত্রলীগ নেতাদের আধিপত্য দেখা গেছে।
গত ২১ জানুয়ারি রাতে শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত সন্দেহে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের চার ছাত্রকে পেটায় ছাত্রলীগ। এরপর হল প্রশাসনের মাধ্যমে আহতদের পুলিশে সোপর্দ করে হল শাখা ছাত্রলীগ। হল সংসদের নির্বাচিত নেতারা এসব শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। যদিও শিবির করার প্রমাণ না মেলায় পরে তাদের থানা থেকে ছেড়ে দেয়া হয়। এদিকে প্রায় মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও ১৮টি হল সংসদের কোনোটিরই এখন পর্যন্ত বাজেট হয়নি। ছাত্রী হলগুলোতে কিছু পরিবর্তন এনেছে।
বন্ধ হয়নি গেস্ট-গণরুম : ডাকসু জিএস গোলাম রাব্বানী বিভিন্ন সময় বক্তব্যে গেস্টরুম গণরুমের পক্ষে কথা বলেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি গণমাধ্যমে বলেন, গেস্টরুমে সিনিয়র ও জুনিয়র শিক্ষার্থীদের ‘গেট-টুগেদার’ হয়। নবীন শিক্ষার্থীরা বলছেন, হলে ‘ম্যানার’ শেখানোর নাম করে গেস্টরুমে কর্মসূচির মুখোমুখি হতে হয়। গেস্টরুমে রড, লাঠি দিয়ে মারধর, ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে অংশ না নিলে হল থেকে বের করে দেয়ার নজির রয়েছে।
আবাসন সমস্যা সমাধান না হওয়ার ব্যাপারে ডাকসু সদস্য তানভীর হাসান সৈকত গণমাধ্যমকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রচেষ্টার অভাব ও ডাকসু নেতাদের লেজুরবৃত্তির কারণেই এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। গণরুম গেস্টরুমের বিষয়ে ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, এক্ষেত্রে ডাকসু পুরোপুরি ব্যর্থ। ডাকসুর ২৫ জনের মধ্যে ২৩ জনই ছাত্রলীগের। হল সংসদগুলোতেও একই অবস্থা। তারা নিজেরাই এগুলো বাঁচিয়ে রাখার হর্তাকর্তা।
ডাকসু নেতাদের নিয়ে প্রেসিডেন্টের সমালোচনা : গত ৯ ডিসেম্বর ঢাবির ৫২তম সমাবর্তনে সভাপতির বক্তব্যে ডাকসু নেতাদের কাজে অসন্তোষ প্রকাশ করে সমালোচনা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ও প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ। তাদের (নেতাদের) ব্যাপারে এমন সব কথা শুনি যা আমার ভালো লাগে না উল্লেখ করে তিনি ডাকসু নেতাদের ছাত্রদের কল্যাণে কাজ করায় গুরুত্বারোপ করেন।
ইতিবাচক কাজ : ডাকসু সচল হওয়ায় শিক্ষার্থীদের কথা বলার প্লাটফর্ম তৈরী হয়েছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের বাইরে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, ছাত্রদলসহ বাম সংগঠনগুলো শিক্ষার্থীদের অধিকারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সরব ছিলো। ডাকসুর অবস্থানের কারণে সান্ধ্য কোর্সের ভর্তি কার্যক্রম স্থগিত করে এগুলো পরিচালনার নীতিমালা তৈরি করতে উদ্যোগী হয়েছে প্রশাসন।
ছাত্রলীগ প্যানেল থেকে নির্বাচিত স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক সাদ বিন কাদের চৌধুরী, সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক আসিফ তালুকদার, ক্রীড়া সম্পাদক শাকিল আহমেদ তানভীর শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কাজ করেছেন। সমাজসেবা সম্পাদক আকতার হোসেন ‘ছাত্রলীগের বাঁধায়’ ছাত্রী হলে সাইবার সেফটি বিষয়ক প্রোগ্রাম করতে না পারলেও পরবর্তীতে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রোগ্রাম, প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সহায়তা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, ফার্স্ট এইড প্রোগ্রাম করেছেন।
ডাকসুর কাজের মধ্যে আছে, জো-বাইক; স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিন; আবাসিক ও অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য বাস ট্রিপ ও রুটের সংখ্যা বাড়ানো; ছাত্রীদের হলে প্রবেশের সময়সীমা বাড়ানো; গ্রন্থাগারের সময়সীমা বাড়ানো; বিভিন্ন বিষয়ের ওপর সভা-সেমিনার, সাংস্কৃতিক ও ক্রিড়া প্রতিযোগিতা।
ডাকসু বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে শঙ্কা : ডাকসুর গঠনতন্ত্রের (সংশোধিত) ৬ এর ‘গ’ ধারা অনুযায়ী, নির্বাচিত কার্যনির্বাহী পদাধিকারগণের দায়িত্বকাল ৩৬৫ দিন বা একবছর। সে হিসেবে চলতি মাসেই ডাকসুর কার্যকাল শেষ হচ্ছে। তবে পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দৃশ্যমান কোনো তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে ডাকসু আবার বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেছেন ভিপি নুরুল হক নুর।
গণমাধ্যমে তিনি বলেন, হয়তো আবারো ২৮ বছরের মতো ঝুলে যেতে পারে ডাকসু নির্বাচন। এদিকে ডাকসুর সর্বশেষ বৈঠকে সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন নতুন নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুললেও সেটা আলোচিত হয়নি। ডাকসুর প্রেসিডেন্ট ও বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি নতুন নির্বাচন নিয়ে মুখ খুলছেন না। শিক্ষার্থীরা বলছেন, ঢাবি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও প্রশাসন সরকারের চাওয়া না চাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হতে বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন