শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

ইকোনমিস্টের রিপোর্ট : করোনা ভাইরাস ও মহামারির রাজনীতি

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৪ মার্চ, ২০২০, ১০:১৭ এএম

সামনের দিনগুলোতে কী আসতে চলেছে তা বুঝতে হলে তাকাতে হবে ইউরোপে করোনা সংক্রমণের কেন্দ্র ইতালির সমৃদ্ধশালী শহর লোমবার্ডির দিকে। শহরটির হাসপাতালগুলো বিশ্বমানের চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে সক্ষম। গত সপ্তাহ পর্যন্ত তারা এই ভাইরাসের সঙ্গে পেরে ওঠার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিল। কিন্তু এরপরই এখানে নিউমোনিয়ার প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। হাসপাতালগুলোতে দ্রুত শেষ হয়ে যায় ভেন্টিলেটরস ও অক্সিজেন। কয়েকটি হাসপাতালে কর্মীরা রোগীর চাপে অনেককে বিনা চিকিৎসায় মরতে দিতে বাধ্য হয়।
এ সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে করোনা ভাইরাসকে বিশ্ব মহামারি ঘোষণা করেছে। চীনের বাইরে এরইমধ্যে এতে আক্রান্ত হয়েছে ৪৫০০০ মানুষ এবং এরমধ্যে মারা গেছে প্রায় ১৫০০।
চীন ছাড়া আক্রান্ত হয়েছে অন্তত ১১২টি দেশ। মহামারি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, স্পেন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের মতো রাষ্ট্রগুলো ইতালি থেকে শুধুমাত্র দু-এক সপ্তাহ পেছনে রয়েছে। মিশর ও ভারতের মতো কিছুটা বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রগুলো আরো পেছনে তবে খুব বেশি নয়।
বর্তমান সময়ে বিশ্বে যত নেতা রয়েছেন তাদের মধ্যে খুব অল্পই কখনো মহামারি ও এর অর্থনৈতিক ধাক্কা মোকাবেলা করেছেন। তবে অনেকেই ২০০৭-০৯ সালের অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে বলার মতন আছেন। এখন রাজনৈতিক নেতারা দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছেন যে, তাদেরকে এখন অবশ্যই এই সংকটাবস্থার মুখোমুখি হতে হবে। তারা কতখানি সফলভাবে এই সংকট মোকাবেলা করতে পারবে তা নির্ভর করছে তিনটি বিষয়ের ওপর। এগুলো হলো, ভবিষ্যতের অনিশ্চিত অবস্থা নিয়ে তাদের মনোভাব, দেশটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কাঠামো ও দক্ষতা এবং নেতাদের প্রতি জনগণের আস্থা।

অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ অনেকভাবেই ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে, এখনো যে ভাইরাসের (সার্স-কভ-২) কারণে কভিড-১৯ হয়ে থাকে সেটিকে বুঝে ওঠা যাচ্ছে না। আরেকটি কারণ হচ্ছে মহামারি ছড়িয়ে পড়ার ধরন নিয়ে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বিভিন্ন অঞ্চল বা দেশ করোনা ভাইরাস চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। ইরান, ইতালি কিংবা দক্ষিণ কোরিয়ায় দেখা গেছে আক্রান্তদের চিহ্নিত করতে করতেই এটি দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। এসব দেশে সরকার যখন স্কুল বন্ধ ও জন সমাবেশ নিষিদ্ধ করলো ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
এদিকে, চীন যে সমাধান বের করেছে তার ফলে মানুষকে কঠিনভাবে কোয়ারেন্টিন করে রাখা হয়েছে। এজন্য ব্যাপক শ্রম ও অর্থনৈতিক ব্যয় নিশ্চিত করতে হয়েছে। কিন্তু এতে সেখানে সংক্রমণ কমে এসেছে। করোনার বিরুদ্ধে জয় প্রচারে দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং উহান সফর করেছেন। তবে অনিশ্চয়তা আছে সেখানেও কারণ কেউ এখনো নিশ্চিত হতে পারছেন না যে, আরো এক দফা করোনার প্রাদুর্ভাব সেখানে দেখা দেবে না।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে নেতাদের বুঝে নিতে হবে যে, দেশের মানুষ চীনের মতো কঠিন নজরদারি ও আইসোলেশন মেনে নেবে কিনা। ইতালির কোয়ারেন্টিন অনেকটাই নিজস্ব উদ্যোগে এবং সেখানে মানুষের অধিকার হরণের খুব বেশি ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু অবস্থা যদি চীনের থেকেও ভয়াবহ হয়ে ওঠে তাহলে দেশটির জন্য তা নিয়ন্ত্রণ হবে আরো বেশি ব্যবহুল ও কম কার্যকর। কার্যকারিতা আরো নির্ভর করে দেশটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কাঠামো ও এর কর্মদক্ষতার ওপরে। হাসপাতাল থেকে করোনা পরীক্ষা ও বাড়িতে আইসোলেশনে থাকার বিষয়ে দেয়া তথ্যের ক্ষেত্রে অসঙ্গত ও ভুল বার্তা প্রচারের ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি, প্রতিটি দেশের হাসপাতালগুলোর ওপর ব্যাপক চাপ এসে পড়বে। বস্তি ও শরণার্থী শিবিরগুলোসহ যেসব অঞ্চলে স্বাস্থ্য সেবার কোনো নিশ্চয়তা নেই সেসব অঞ্চল সবথেকে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। এমনকি উন্নত রাষ্ট্রের সবথেকে আধুনিক হাসপাতালগুলোও তাদের সর্বোচ্চ সেবা প্রদানে ব্যর্থ হবে।

তবে এক্ষেত্রে বৃটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবার মতো সার্বজনিন ব্যবস্থায় করোনার কিটস সরবরাহ ব্যবস্থা কিছুটা সহজ হবে। অপরদিকে সম্পদশালী দেশ হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক উন্নতির পরেও করোনা মোকাবেলায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। দেশটির চিকিৎসা ব্যবস্থা বেসরকারি খাতের অধীনে থাকায় সেখানে বিনামূল্যে সেবা পাওয়া সম্ভব নয়। দেশটির জনসংখ্যার মধ্যে ২৮ মিলিয়ন মানুষের কোনো ইন্স্যুরেন্স নেই। আরো আছেন ১১ মিলিয়ন অভিবাসী। এছাড়া, অনির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষ আছেন যারা ব্যয়ের কথা ভেবে করোনা পরীক্ষা ও আইসোলেশনে থাকার থেকে বিরত থাকবে।
তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে নেতাদের ওপর জনগণের বিশ্বাস, সেখানেও অনিশ্চয়তার প্রভাব রয়েছে। জনগণের আস্থাই কোরান্টিন বা আইসোলেশনে থাকার ব্যাপারে নেতাদের কঠিন সিদ্ধান্তগুলোর বৈধতা প্রদান করবে। ইরানের সরকার দীর্ঘদিন ধরে দেশটির মধ্যে অজনপ্রিয়। ধারণা করা হচ্ছে, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা লুকাচ্ছে দেশটি। এসব কারণে, অনেক ধর্মীয় নেতা তাদের দরবার বন্ধে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। কিন্তু ভাইরাস ছড়িয়ে যাচ্ছেই।
গুজব ও ভয় ছড়ানোর পেছনে সবথেকে বড় কারণ হলো, মানুষ মনে করে রাজনীতিবিদরা সত্যি গোপন করছে। যখন রাজনীতিবিদরা জনগণের মধ্য থেকে ভয় দূর করতে ভুল ধারণা দিয়ে বেড়ায় তারা আসলে এর মধ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে তোলে। এখনো রাজনীতিবিদরা জানে না কীভাবে মহামারি সামলাতে হয় ও এ বিষয়ে কথা বলতে হয়। নির্দিষ্ট করে বললে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প এ সপ্তাহে ইউরোপের ওপর ৩০ দিনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। কিন্তু এর ফলে তেমন কোনো লাভ হবে না কারণ এরইমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। যখন মানুষ তার বন্ধু ও আত্মীয়ের মৃত্যু দেখতে শুরু করবে ট্রাম্প তখন বুঝতে পারবেন যে, মহামারিকে বিদেশি, ডেমোক্রেট বা সিএনএনের ষড়যন্ত্র বলে আটকানো যায় না।

রাজনীতিবিদদের তাহলে কী করা উচিত? প্রতিটা রাষ্ট্রের উচিত একটি ভারসাম্য নিশ্চিত করা। চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া যেভাবে গণহারে পরীক্ষা চালিয়েছে এটি থাকা প্রয়োজন, পাশাপাশি তাদের মতো নাগরিকের প্রাইভেসি ঝুঁকিতে না ফেলে কাজ করে যাওয়া প্রয়োজন। সরকারগুলোর উচিত মহামারির বিষয়ে অগ্রিম সতর্ক হওয়া। কারণ, প্রাথমিক অবস্থায় এর বিস্তার থামাতে জনসমাবেশ নিষিদ্ধের মতো সিদ্ধান্তগুলো বেশ কার্যকরী।
এজন্য আদর্শ উদাহরণ হচ্ছে সিঙ্গাপুর। দেশটিতে আশঙ্কার থেকে সংক্রমণ অনেক কম। এজন্য সেখানকার কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ দেয়া উচিত। সেখানে আছে বিশ্বমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা। একইসঙ্গে তারা পূর্ববর্তী সার্স থেকে শিখেছে। জনগণের মধ্যে দেশটি যেসব নির্দেশনা দিয়েছে তা ছিল বিজ্ঞান ভিত্তিক ও জনগণও তা বিশ্বাস করেছে। কিন্তু পশ্চিমের দেশগুলোতে যেসব নেতা ২০০৮ সালের মন্দার পর ক্ষমতায় এসেছেন তাদের জন্য করোনা ভাইরাস একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তাদের মধ্যে অনেকেই বিশ্বায়ন ও বিশেষজ্ঞদের সমালোচনা করছেন। তারা বিভাজন ও সংঘাত সৃষ্টি করছে। কিছু ক্ষেত্রে মহামারি তাদের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে সাহায্য করছে। অনেক রাষ্ট্রই হয়তো এখন যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করে তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দেবে। সংকট বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হয়তো শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বায়ন থেকে সরে আসবে।
পাশাপাশি, মহামারির কারণে চিকিৎসক, বিজ্ঞানি ও নীতি নির্ধারকরা আবারো সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। মহামারি নিশ্চিতভাবে বৈশ্বিক সংকট। দেশগুলোর উচিত করোনার চিকিৎসা, বিজ্ঞান ও ভ্যাক্সিন আবিষ্কারে একসঙ্গে কাজ করা। নাগরিকরা এবার হয়তো তাদের সরকারকে বিভক্ত রাজনৈতিক তর্ক বাদে সত্যিকারের কোনো সমস্যা মোকাবেলা করতে দেখবে। প্রথম থেকেই এটি হওয়া উচিত ছিল রাজনীতির প্রধান উদ্দেশ্য।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন