আজ ১৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। ১৯২০ সালের এদিনে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়া জন্মগ্রহণ করেন জাতির পিতা। তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ পরিচালিত হচ্ছে। ইতোমধ্যেই ১৭ মার্চ ২০২০ সাল থেকে ২৬ মার্চ ২০২১ সাল পর্যন্ত ঘোষণা করা হয়েছে মুজিববর্ষ। নানা উন্নয়ন ও গঠনমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যন্ত মুজিববর্ষ পালিত হবে। শুধু বাংলাদেশে নয়, ইউনেস্কোর সদস্যভুক্ত ১৯৫টি দেশে একযোগে পালিত হবে মুজিববর্ষ। জাতির পিতা জন্ম না হলে হয়তোবা এদেশ স্বাধীন হতো না। আমরা সার্বভৌম বাংলাদেশ পেতাম না। বাঙালি জাতির নির্দিষ্ট মানচিত্রও তৈরি হতো না। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে তার আত্মার শান্তি ও মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে তাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের উচ্চ মর্যাদায় আসীন করার প্রার্থনা করছি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সপরিবারে ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে হত্যার শিকার সব আত্মীয়স্বজনের প্রতি গভীরভাবে সান্ত্বনা ও সমবেদনা প্রকাশ করছি।
আমরা জানি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য। মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। তার স্বপ্নের সোনার বাংলায় তিনি দেখতে চেয়েছিলেন দেশের কৃষি ও কৃষকের সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন এবং স্বনির্ভরতা। বঙ্গবন্ধুর সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের পুরো দায়িত্ব এখন আমাদের। তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ড হয়েছে এবং হচ্ছে। এমনকি দেশ আজ খাদ্যে শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, বরং খাদ্য উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত হয়েছে। বর্তমান সরকারের সুপরিকল্পিত কৃষিনীতি এবং মানসম্পন্ন উপকরণ সরবরাহের ফলে চাল উপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ স্থানে, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, মাছ চাষে তৃতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম এবং আলু উৎপাদনে অষ্টম স্থানে রয়েছে। এত অর্জনে পরও আমরা প্রায়ই দেখি কৃষক তার ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
গত বছর আমরা দেখেছি, কৃষক নিরূপায় হয়ে দুঃখে-কষ্টে পাকা সোনালি ধানক্ষেতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। একজন কৃষক তার স্বপ্নের জাল বুনা ধানের ক্ষেতে কখন আগুন দেয় তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। কৃষকের এমন ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আমরা দেখেছি- স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী এমনকি এক ডিসিকেও ধান কেটে দিতে। এটা ভালো উদ্যোগ কিন্তু যা প্রকৃত সমস্যা সমাধানের তুলনায় খুব অপ্রতুল। একটা বিষয় জাতি হিসেবে আমাদের বারবার পিছিয়ে দিচ্ছে। কোনো সমস্যা প্রকট আকার ধারণ না করলে আমাদের টনক নড়ে না। অথচ বঙ্গবন্ধু কৃষিকে কত গুরুত্ব দিতেন তা ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত তার ভাষণে ফুটে উঠেছে। তিনি বিশাল জনসভায় বলেছিলেন, ‘আমার দেশের এক একর জমিতে যে ফসল হয় জাপানের এক একর জমিতে তার তিনগুণ ফসল হয়। কিন্তু আমার জমি দুনিয়ার সেরা জমি। আমি কেন সেই জমিতে দ্বিগুণ ফসল ফলাতে পারব না, তিনগুণ করতে পারব না? আমি যদি দ্বিগুণও করতে পারি তাহলে আমাকে খাদ্য কিনতে হবে না। আমি চাই, বাংলাদেশের প্রত্যেক কৃষক ভাইয়ের কাছে, যারা সত্যিকার কাজ করে, যারা প্যান্টপরা, কাপড়পরা ভদ্রলোক তাদের কাছেও চাই জমিতে যেতে হবে, ডবল ফসল করুন। প্রতিজ্ঞা করুন, আজ থেকে ওই শহীদদের কথা স্মরণ করে ডবল ফসল করতে হবে। যদি ডবল ফসল করতে পারি আমাদের অভাব ইনশাআল্লাহ হবে না।’
বঙ্গবন্ধুর সে ভাষণটি আজ যথাযথভাবে প্রমাণিত। কৃষক, কৃষিবিদদের অক্লান্ত পরিশ্রমে ফলে দেশের খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে সাড়ে তিন গুণ। একই জমিতে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে অনুসরণীয়। তবুও প্রতিবছর হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ফসল ফলানোর পরেও সরকারের ধান-চালের ক্রয়নীতি ও মূল্য নির্ধারণ সত্তে¡ও ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না কৃষকেরা। মাঝখান থেকে লাভবান হয় মধ্যস্বত্বভোগী, ফড়িয়া, চাতাল মালিক, পরিবহন ব্যবসায়ীসহ পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা। অনুরূপ অবস্থা প্রায় প্রতিটি কৃষি পণ্য, ফলফুল, শাক-সবজি, মাছ, মাংসে প্রতিফলিত হয়ে থাকে। ক্রুটিপূর্ণ মাকেটিং, সঠিক পরিকল্পনার অভাব এবং মধ্যস্বত্ব¡ভোগীদের দৌরাত্ম্যই এর জন্য দায়ী। ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হলে সুনির্দিষ্ট ও কঠোর নীতিমালা প্রণয়নসহ তা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরে তথ্য মতে, এ বছর আমন ধানের উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ টন। এ মধ্যে সরকার প্রান্তিক কৃষকের কাছ থেকে ২৬ টাকা কেজি দরে ৬ লাখ টন আমন ধান ক্রয় করা হয়েছে। ৩৬ টাকা দরে সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন সেদ্ধ আমন ধানের চাল ও ৩৫ টাকা কেজি দরে ৫০ হাজার টন আমন ধানের আতপ চালও ক্রয় করা হয়েছে। এ হিসাব থেকে দেখা যায়, সরকারিভাবে মোট উৎপাদনের মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশ ধান ও চাল সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রতিবেশী ভারতে সরকারিভাবে মোট উৎপাদনের ২০ শতাংশ ধান ও চাল সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। উন্নত বিশ্বের কিছু দেশ যেমন জাপান, কোরিয়া কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের সবটাই কিনে নেয়। পরে আবার তা কম দামে বিক্রি করে। জাপানের জিডিপিতে কৃষির অবদান দুই ভাগ কিন্তু ভর্তুকি আরো বেশি। আমাদের দেশেও কৃষি উপকরণে সহায়তা আরো বাড়ানো প্রয়োজন। এটা করা গেলে সব ধরনের কৃষকের কাছে সরকারের সুবিধা পৌঁছানো সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে উৎপাদন খরচ কমানো যাবে। ফলে কম মূল্যে বিক্রির পরও কৃষকের মুনাফা কমবে না।
পেঁয়াজের ঝাঁজ কি রকম ২০১৯ সালের শেষ দিকে এবং চলতি বছর এদেশের জনগণ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। প্রতি কেজি ২ শত থেকে আড়াই শত টাকা দিয়েও কিনতে হয়েছিল। অথচ প্রতিবছর আমাদের দেশে যখন পেঁয়াজ ওঠে তখনই ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে তৎপর হয়ে উঠে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। ফলে কৃষকরা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রতি বছর। মার্চের শুরুতে ছিল ১ শত থেকে ১শত ২০ টাকা কেজি। আর এখন রাজধানীতে পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা। এক সপ্তাহ আগে ভালো মানের দেশি পেঁয়াজের কেজি ছিল ৭০ থেকে ৮০ টাকা। সামনে পেঁয়াজের দাম আরো কমতে পারে। অথচ প্রতি মণ পেঁয়াজের উৎপাদন খরচ ১ হাজার থেকে ১২শ টাকা। অপরিকল্পিত আমদানির কারণে মার খাচ্ছে দেশের চাষিরা। রমজান সামনে রেখে সরকার পেঁয়াজ আমদানি করলে ক্ষতির মাত্রা আরো বাড়বে। এছাড়া সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় একসাথে কৃষককে উৎপাদিত পেঁয়াজ কমদামে বিক্রি করে দিতে হয়। সরকার আলু, ধানসহ বিভিন্ন ফসল সংরক্ষণে ব্যবস্থা নিয়েছে। এমন ব্যবস্থা পেঁয়াজের জন্য করা হলে, কৃষক ন্যায্য মূল্য পাবে। পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও বাজারে কারসাজি করতে পারবে না। বড় পরিসরে পেঁয়াজ সংরক্ষণ, সরকারি সংরক্ষণাগার গড়ে তোলা এখন সময়ে দাবি।
ধান তো বিক্রি করতে না পারলে রেখে দেওয়া যায়। কিন্তু যেসব কৃষিপণ্য পচনশীল; যেমন-শাকসবজি, ফল-মূল। যশোর, ঝিনাইদহ, রংপুর অঞ্চলে রবি বা শীত মৌসুমে মূলা-কপি বা অন্যান্য অনেক শাকসবজির দাম ১০ টাকা মণ হয়ে যায়। এমনও হয় বিক্রি না হওয়ায় কৃষকরা নিরূপায় হয়ে গরু-ছাগলকে খাওয়ান। অথচ সেই শাকসবজি ঢাকা বা মহানগরগুলোতে ৪০ টাকার অধিক কেজি দরে বিক্রি হয়। ফড়িয়া, মধ্যস্বত্বভোগী ও বাজারজাতকরণের দুর্বল কাঠামোর কারণে কৃষকরা এর ফল ভোগ করতে পারেন না। তাদের জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য থেকে যায় অধরা। ভাবতে অবাক লাগে, এদেশে এক কেজি ধান বিক্রি করে কৃষক পাচ্ছেন ২৬ টাকা। সেখানে পানির প্রাচুর্যের দেশে হাফ লিটার পানি বিক্রি করে বড় বড় শিল্পপতিরা পাচ্ছে ১৫ টাকা!
কৃষির উপরই এ দেশের অর্থনীতি নির্ভর করে। কৃষিতে ধস নামলে দেশের অর্থনীতি নড়বড় হয়ে যাবে। কৃষকরা মানুষের মুখে অন্ন যোগায় এবং তাদের চেষ্টায় দেশ খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়েছে। এখন আর আমাদের বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করতে হয় না। তারা দেশের উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখছে। তাই কৃষকদের সঠিক মূল্যায়ন করতে হবে এবং ধান সহ সকল কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। কাজেই দ্রব্যমূল্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ধানের মূল্য বৃদ্ধি করতে হবে। ধানের মূল্য বৃদ্ধি না করলে কৃষকরা ধান উৎপাদন করতে উৎসাহী হবে না। এতে দেশে আবার খাদ্য ঘাটতি দেখা দেবে। তাই সরকারের উচিত ধানের দাম বৃদ্ধি করে কৃষকদেরকে রক্ষা করা এবং ধান উৎপাদন করতে তাদেরকে উৎসাহিত করা। নতুবা কৃষিতে বিপর্যয় দেখা দেবে, যা আমাদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
আমাদের কৃষি ও কৃষককে বাঁচাতে হবে। এর জন্য কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন দেশে বীজ-বপণ থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণের প্রতি স্তরে কৃষকরা পর্যাপ্ত রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা পেয়ে থাকে। এমনকি বীমার ব্যবস্থাও রয়েছে। বর্তমান সরকার কৃষি উন্নয়ন ও কৃষকের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৃষক তার উৎপাদিত ধান ও অন্যান্য কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবে এবং তাদের মুখে ফুটবে হাসির ঝিলিক- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন