শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

ভারতে মুসলিম-বিদ্বেষী কর্মসূচি থামলেও কোণঠাসা বন্ধ হবে না

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৯ মার্চ, ২০২০, ১২:০৩ এএম

দিল্লীর মুসলিম-বিদ্বেষী দাঙ্গা নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় যে নেতিবাচক সংবাদ প্রচারিত হয়েছে এবং জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস হাই কমিশনার মিশেল ব্যাচলেট মুসলিমবিরোধী সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টের (সিএএ) বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপের জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করার যে নজিরবিহীন পদক্ষেপ নিয়েছেন, এ সবের পর ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সরকার খুব সম্ভবত মুসলিমদের বিরুদ্ধে কিছু সময়ের জন্য আর কোন সহিংসতা ছড়াবে না। কিন্তু মুসলিমদেরকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত করার এবং প্রান্তিকীকরণের যে নীতি তাদের কাছে সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে, সেই নীতি থেকে তারা কোনভাবেই বেরিয়ে আসবে না। তারা মুসলিমদেরকে ‘দেশ বিরোধী’ স¤প্রদায় হিসেবে আখ্যা দেয়া অব্যাহত রাখবে। বলা হবে, এদের সাথে ভারত-বিরোধী ইসলামি দেশগুলোর সম্পর্ক রয়েছে এবং পাকিস্তান-ভিত্তিক ইসলামিক সন্ত্রাসী গ্রæপগুলোর যোগাযোগ রয়েছে। দিল্লীতে হত্যাকাÐের আগ দিয়ে শাহিন বাগের বিক্ষোভকারীদেরকে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উত্তরস‚রি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, অথবা তাদেরকে পাকিস্তানের গোয়েন্দা এজেন্ট বলা হয়েছে। আর উত্তর প্রদেশের যোগি আদিত্যনাথ সরকার যেটা করেছে, বিক্ষোভকারীদেরকে চক্রান্তকারী বা সহিংসতার উসকানীদাতা হিসেবে প্রকাশ্যে উল্লেখ করেছে এবং বিষয়টি আইনের দৃষ্টিতে সমাধান হওয়ার আগেই তাদেরকে প্রকাশ্যে অপমান করেছে। তাদের ম‚লমন্ত্রটা এ রকম: “কুকুরটাকে একটা বাজে নাম দিয়ে তাকে মেরে ফেলো”। বিভক্তি নীতির সমর্থনে বিজেপি এবং তাদের সহযোগী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো বলতে পারে, যে সব দেশ মুসলিমদের ইস্যু নিয়ে কথা বলেছে, সিএএ’র নিন্দা করেছে এবং দিল্লীর সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছে, সেই দেশগুলো ইসলামিক, ভারত-বিরোধী এবং পাকিস্তানপন্থী, যেমনÑ তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও সউদী নেতৃত্বাধীন সংস্থা অর্গানাইজেশান অব ইসলামিক কনফারেন্স (ওআইসি)। এই যুক্তিটাকে ব্যবহার করে নরেন্দ্র মোদি সরকার এমন একটা ধারণা ছড়াচ্ছে যে, একটা পাকিস্তানপন্থী ও ইসলামিক গ্রæপ গড়ে উঠেছে যারা ভারতের বিরোধী, এবং ভারতের প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিকের উচিত তাদের প্রতিরোধ করা। ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি কাশ্মীরি দম্পতি জাহানজাইব সামি আর তার স্ত্রীকে গ্রেফতার করেছে, যেটা খুব একটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো তারা শাহিন বাগের বিক্ষোভকারীদেরকে কট্টরপন্থার দিকে নেয়ার ষড়যন্ত্র করছিল এবং এ জন্য তাদেরকে অনুরোধ করেছিল ইসলামিক স্টেট খোরাসানের পাকিস্তানি কমাÐার হুজাইফা আল বাকিস্তানি। মুসলিমদের শত্রæ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রক্রিয়াটা যেন এর মাধ্যমে সম্প‚র্ণ হলো।
দ্য টেলিগ্রাফে গুজরাটের মুসলিমদের নিয়ে স¤প্রতি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন সাজেদা মোমিন। এই রিপোর্টটিতে একটা ধারণা পাওয়া যায় যে, কিভাবে অপপ্রচারের মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে মুসলিমদেরকে। ২০০২ সালের গুজরাটের দাঙ্গায় প্রায় ২০০০ মানুষ নিহত হয়েছিল, যাদের অধিকাংশই মুসলিম। ওই দাঙ্গার পর রাষ্ট্র এবং অমুসলিম গুজরাটিরা মুসলিমদেরকে বস্তি এলাকায় বিচ্ছিন্ন করে রাখে। মোমিন বলেছেন যে, আড়াই দশকের বিজেপি শাসনে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়েছে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে আবাসস্থল, চাকরি, ব্যবসায়, নিরাপত্তার অনুভ‚তি, সুন্দর ভবিষ্যতের প্রত্যাশাÑ সবকিছু থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ২০০২ সালের সহিংসতা আলাদা করার একটা তারিখ মাত্র। দাঙ্গার পর এখন শুধু হিন্দু আর মুসলিম এলাকা রয়েছে, মিশ্র কোন এলাকা নেই। এটা একটা অনানুষ্ঠানিক নিয়মের মতো হয়ে গেছে। মুসলিমরা হিন্দু এলাকায় বাস করতে পারবে না। আরেকটি অলিখিত নিয়ম হলোÑ নতুন গজিয়ে ওঠা নতুন স্টিল বা কাঁচের মলগুলোতে মুসলিমরা দোকান কিনতে বা ভাড়া নিতে পারবে না। মোমিন লিখেছেন, বস্তি এলাকাগুলোতে পুরনো স্টাইলের মার্কেট রয়েছে, সেখানে মুসলিমরা ব্যবসায় করবে এবং সেখানকার ক্রেতারাও নিজেদের স¤প্রদায়ের লোকজন। পুরনো আহমেদাবাদ শহরের কালুপুর এলাকায় ছোট বাসনকোসনের দোকান রয়েছে ওয়ারিস আমিনের। তিনি বললেন, “আমরা কর দিই, কিন্তু কোন নাগরিক সুবিধা আমরা পাই না। কর্পোরেশান আমাদের এখানে বেশ কয়েকদিন ময়লা নিতে আসে না এবং বলে যে মুসলিমরা নোংরা। পানি আর বিদ্যুতের সরবরাহও এখানে কম এবং প্রায়ই সেটাও বন্ধ করে দেয়া হয়”। বিজেপি দেখিয়েছে যে, মুসলিমদের ভোট ছাড়াই তারা জিততে পারে এবং সে কারণে রাজনীতিবিদরা এই স¤প্রদায়কে আরও অবহেলা করছে। মোমিন উল্লেখ করেন যে, গুজরাটের জনসংখ্যার ৯.৬৭ শতাংশ হলো মুসলিম। কিন্তু বিজেপি কখনও সেখানে অ্যাসেম্বলি নির্বাচনে একজনও মুসলিম প্রার্থীও দাঁড় করায়নি। ২০০৫ সালে কংগ্রেস সরকার যে বিচারপতি রাজিন্দার সাচার কমিশন গঠন করেছিল, সেই কমিশনের অনুসন্ধান অনুযায়ী ভারতের মুসলিমরা সার্বিকভাবে এরই মধ্যে প্রান্তিক পর্যায়ে চলে গেছে। ২০০৬ সালে কমিশন যে রিপোর্ট পেশ করে, সেখানে ছয় দশকের প্রাতিষ্ঠানিক অবহেলা এবং পক্ষপাতিত্বের চিত্র উঠে এসেছে, যেগুলোর কারণে শিক্ষা, কর্মসংস্থান, ঋণ সুবিধা, সামাজিক ও বাহ্যিক অবকাঠামো ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে অন্যান্য সামাজিক-ধর্মীয় স¤প্রদায়ের (এসআরসি) চেয়ে বহু পিছিয়ে আছে মুসলিমরা। এভাবেই এই রিপোর্টটি সঙ্ঘ পরিবারের ভিত্তিহীন অপপ্রচারকে ফাঁস করে দিয়েছে, যেখানে তারা দাবি করেছে যে ভারতে ‘মুসলিমদের তুষ্ট’ করার প্রচেষ্টা চলেছে। ২০০১ সালে মুসলিমদের শিক্ষিতের হার ছিল ৫৯.১%, যেটা জাতীয় হারের (৬৫.১%) চেয়ে অনেক কম। সকল এসআরসি’র তুলনায় প্রাইমারি, মধ্যম এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে মুসলিমদের ঝরে পড়ার হার সবচেয়ে বেশি। ১৭ বছরের বেশি মাত্র ১৭% মুসলিম তাদের মেট্রিকুলেশান শেষ করেছে, যেখানে সকল এসআরসি’র মধ্যে এর হার হলো ২৬%। ভারতের প্রিমিয়ার কলেজগুলোতে ২৫ জন আন্ডার-গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থীর মধ্যে একজন (৪%) এবং স্নাতোকত্তর ৫০ জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন (২%) হলো মুসলিম। অভিজাত ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউটস অব ম্যানেজমেন্ট (আইআইএম) এবং ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউটস অব টেকনোলজিতে (আইআইটি) মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব অনেক কম। ২০০৪-০৫ ও ২০০৫-০৬ বছরের তথ্য দেখা যায় সকল আইআইএম কোর্সে মুসলিমদের অংশগ্রহণ ছিল মাত্র ১.৩%। আইআইটির ক্ষেত্রে, যে ২৭,১৬১ জন শিক্ষার্থী সকল কোর্সে যোগ দিযেছে, তাদের মধ্যে মাত্র ৮৯৪ জন (৩.৩%) হলো মুসলিম। শহর এলাকায় নিয়মিত কাজে মুসলিমদের অংশগ্রহণ অনেকটাই সীমিত। অনানুষ্ঠানিক খাতে তাদের আয় কম, খারাপ পরিবেশে তাদের কাজ করতে হয় এবং প্রায় কোন ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা না থাকায় তারা দরিদ্র অবস্থায় বাস করছে। স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ ডেভলপমেন্ট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (এসআইডিবিআই) এবং ন্যাশনাল ব্যাংক ফর এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড রুরাল ডেভলপমেন্ট (এনএবিএআরডি) এর রেকর্ড শিডিউলড কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়েও খারাপ। ২০০০-০১ থেকে ২০০৫-০৬ – এই ছয় বছরে এসআইডিবিআই যে ২৬,৫৯৩ কোটি রুপি বিতরণ করেছে, এর মধ্যে মুসলিমরা পেয়েছে মাত্র ১২৪ কোটি রুপি (০.৫% এরও কম)। এনএবিএআরডি এর অবস্থাও এর চেয়ে ভালো নয়। ২০০৪-০৫, ২০০৫-০৬ – এই দুই বছরে মুসলিমরা মোটা উৎপাদন ঋণের ৩.২% এবং বিনিয়োগ ঋণের মাত্র ৩.৯% পেয়েছে। বিভিন্ন এসআরসি’র মধ্যে সামাজিক (প্রাইমারি ও এলিমেন্টারি স্কুল, ডিসপেনসারি ইত্যাদি) ও বাহ্যিক অবকাঠামো (বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, সড়ক ও বাস সেবা ইত্যাদি) ফ্যাসিলিটিগুলোর অস্তিত্ব, সেগুলোতে প্রবেশাধিকার এবং সেগুলো কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন স¤প্রদায়ের মধ্যে পরিস্কার পার্থক্য রয়েছে। মুসলিমরা যে সব এলাকায় বেশি, সেখানে সড়ক বা স্থানীয় বাস স্টপেজ, মেডিকেল, পোস্ট অফিস, টেলিগ্রাফ সুবিধার মতো বিষয়গুলো অনেক কম। পশ্চিম বঙ্গ ও বিহারের এ ধরনের মুসলিম প্রধান ১০০০ গ্রাম এবং উত্তর প্রদেশের এ ধরনের ১৯৪৩টি গ্রামে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই নেই। সাউথ এয়িান মনিটর।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন