বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

মিরাজুন্নবী (দ.) এক মহাবিস্ময়কর মুজিযা

মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম | প্রকাশের সময় : ২২ মার্চ, ২০২০, ১২:০২ এএম

মহান রাব্বুলইজ্জত তার প্রিয় হাবীব (দ.) কে যে সকল মুজিযা দান করেছেন, তার মধ্যে মিরাজে গমন সবচেয়ে মহাবিস্ময়কর মুজিযা, যা সংঘটিত হয়েছিল রাসুলে আকরাম (দ.) এর নবুয়ত প্রকাশের ১১ বছর ৫ মাস ১৫ দিনের মাথায়। ২৭ রজব রাতের অতি অল্প সময়ে সৌরজগত, বায়তুল মামুর, ছিদরাতুল মুনতাহা, আরশ-কুরসী প্রভৃতি পরিভ্রমণ করে লা-মকানে প্রভূর সান্নিধ্যে কথোপকথন শেষে পুনরায় মক্কা নগরীতে ফিরে আসেন তিনি। এই রজনীতে বিশ্বনবী (দ.) তাঁর ফুফাত বোন উম্মে হানীর (রা.) ঘরে আরাম করছিলেন। নিস্তব্ধ নির্জন রজনীর দ্বিপ্রহরে হযরত জিব্রাঈল (আ.) তার সহচর ফেরেস্তাদের সাথে নিয়ে নবীজির খেদমতে আগমন করলেন। তিনি অনুভব করলেন কে যেন তাঁকে ডাকছেন, চোখ খুলতেই দেখলেন তাঁর শিয়রে হযরত জিব্রাঈল (আ.) দন্ডায়মান। সালাম আরজের পর তিনি নবীজিকে যমযম কূপের পাশে নিয়ে গেলেন। তথায় হুযুরের বক্ষ মুবারক বিদীর্ণ করে যমযমের পানি দিয়ে ভিতরের অঙ্গগুলো ধুয়ে সেগুলো পুনঃস্থাপন করলেন। অতঃপর জান্নাতী বিশেষ বাহন বোরাকে আরোহন পূর্বক বায়তুল মুকাদ্দস অভিমুখে যাত্রা করলেন। পথিমধ্যে মদিনা, তুর পর্বত ও বায়তে লাহামে (হযরত ঈসা (আ.) এর জন্মস্থান) দুু দু রাকাত নামাজ আদায় করলেন। ফিলিস্তিনে অবস্থিত বায়তুল মুকাদ্দাসে পৌঁছার পর ইমামুল আম্বীয়ার ইমামতিতে অপেক্ষামান নবী-রাসুলগণ দু’রাকাত নামাজ আদায় করেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘পবিত্রতা তাঁরই জন্য, যিনি আপন (মাহবুব) বান্দাকে রাতের কিছু অংশে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদে আকসায় ভ্রমণ করিয়েছেন, যার আশেপাশে আমি বরকত রেখেছি। যেন আমি তাঁকে আপন মহান নির্দশনসমূহ দেখাই। নিশ্চয় তিনি শুনেন এবং দেখেন।’ সুরা বনী ইসরাইল।
অতঃপর আবার ঊর্ধ্বাকাশে যাত্রা করেন। একে একে প্রথম ,দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম আসমানে এসে যথাক্রমে নবী করিম (দ.) এর সাথে সাক্ষাৎ ও সালাম বিনিময় হয়- হযরত আদম (আ.), হযরত ঈসা (আ.), হযরত ইউসুফ (আ.), হযরত ইদ্রিস (আ.), হযরত হারুন (আ.), হযরত মুসা (আ.), হযরত ইব্র্রাহিম (আ.) প্রমুখের। এরপর নবীজি সিদরাতুল মুনতাহায় উপনীত হন। তথায় এসে হযরত জিব্রাঈল (আ.) তার অক্ষমতা প্রকাশ করলে নবীজি রফরফ নামক সবুজ রংয়ের বাহনে তারও পরে ৩৬ হাজার বছরের পথ অতিক্রম করে আরশ মুয়াল্লায় গমন করেন। সেখান থেকে ৭০ হাজার নূরের পর্দা অতিক্রম করে (এক পর্দা হতে অপর পর্দার দূরুত্ব ৫শত বছরের রাস্তা) নবী করিম (দ.) এক অপূর্ব জ্যোতির্ময় জগতে দিদারে ইলাহী লাভে ধন্য হন। মহান প্রভূর সাথে একান্ত আলাপ শেষে উম্মতের জন্য হাদিয়া স্বরূপ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বিধান নিয়ে বিশ্বনবী (দ.) মুর্হূতের মধ্যে পুুনরায় মক্কা নগরীতে উপস্থিত হন। এ দিকে ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহতায়ালা ইরশদ করেন, ‘অতঃপর তিনি নিকটবর্তী হলেন, অতঃপর ধনুকের দু’মাথা যেরূপভাবে মিলিত হয় তদ্রæপ বরং তার চেয়েও অধিক নিকটবর্তী হলেন। অতঃপর মহান আল্লাহ তাঁর হাবীব (দ.) কে যা ওহী করার তা করেন।’ সুরা নাজম: ৮-১০।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে এ বিষয়ে এক সুদীর্ঘ হাদীস বর্ণিত রয়েছে, মহান আল্লাহতায়ালা নবীজির সাথে কথোপকথনকালে ইরশাদ করেন, ‘আমি আপনাকে আমার হাবীব ও খলীল হিসাবে গ্রহণ করেছি। সমগ্র মানবজাতির জন্য জান্নাতের সুসংবাদ দানকারী এবং জাহান্নামের ব্যাপারে ভীতি প্রদর্শনকারী হিসাবে প্রেরণ করেছি। আপনার বক্ষ মুবারক স¤প্রসারিত করেছি। আপনার দায়িত্বের বোঝা সহজ করে দিয়েছি। আপনার আলোচনাকে সমুন্নত করেছি। আমার অদ্বিতীয়তা ও তাওহীদের বাণীর সাথে আপনার প্রশংসাকে সংযোজন করেছি। আপনার উম্মতকে শ্রেষ্ঠ উম্মত ও মধ্যপন্থা অবলম্বী উম্মত বানিয়েছি। মানবের কল্যাণার্থে তাদের অভ্যুদয়। মর্যাদা ও সম্মানের দিক দিয়ে প্রথম শ্রেণির উম্মত আর আবির্ভাবের দিক দিয়ে সর্বশেষ উম্মত বানিয়েছি। আপনার উম্মতের মধ্যে এমন কিছু লোক জন্মগ্রহণ করবে, যাদের অন্তরে আমার কালাম লিপিবদ্ধ থাকবে। অস্তিত্বের দিক দিয়ে আপনি সর্বপ্রথম নবী আর ভূপৃষ্ঠে আগমনের দিক দিয়ে সর্বশেষ নবী। আপনাকে সুরা ফাতেহা হাদিয়া দিয়েছি। আপনার পূর্বে অন্য কোন নবী এমন সুরা লাভ করেনি। আপনাকে আরশের নিচে রক্ষিত খনি থেকে সুরা বাকারার শেষাংশের আয়াতসমূহ হাদিয়া দিয়েছি। আপনার পূর্বে কোন নবী (আ.) কে তা দেই নি। আপনাকে হাওজে কাউছার দান করেছি। বিশেষ করে আটটি নিয়ামত (বিষয়) আপনার উম্মতকে দান করা হয়েছে। মুসলমান হওয়ার উপাধী, হিজরত, জিহাদ, নামায, সদকা, রমজান মাসের রোযা, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ।’ খাছায়েছুল কুবরা।
বিজ্ঞ আলেমগণ তাদের পরিভাষায় মিরাজুন্নবীকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন: ক. মক্কা শরীফ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস, এ অংশকে বলা হয় ইসরা। খ. বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে সিদরাতুল মুনতাহা, এ অংশকে বলা হয় মিরাজ। গ. সিদরাতুল মুনতাহা থেকে লা-মকান, এ অংশকে বলা হয় ইরাজ। সাধারণভাবে পূর্ণ ভ্রমণকে বলা হয়, মিরাজুন্নবী (দ.)। শেখ মুহাক্বেক আবদুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী (র.) আশআতুল লুমআত গ্রন্থে বলেন, ইসরা পবিত্র কুরআনুল করিম দ্বারা প্রমাণিত। তা অস্বীকার করলে কাফের হয়ে যাবে আর হাদীসে মাশহুর দ্বারা প্রমাণিত মিরাজ অস্বীকার করলে গোমরাহ হবে।’
অল্প সময়ে এ বিশাল জগত পরিভ্রমণ করে ফিরে আসা সত্যিই বিস্ময়কর। মহান আল্লাহর কুদরতে এটা খুবই স্বাভাবিক। এ মিরাজ ছিল শারীরিক, বাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত। যার সাক্ষী স্বয়ং আল্লাহ, মহাগ্রন্থ আল কুরআন, হাদীসে রাসুল, বিশিষ্ট ৩০ জন সাহাবী থেকে মুতওয়াতির বর্ণনা এবং সকল ফেরেস্তা। তাফসীরে জালালাইন,পৃ: ২২৯।
মিরাজ হতে ফিরে এসে নবীজি অনুভব করলেন বিছানা এখনো গরম রয়েছে। ভোরে নবীজি কাবা শরীফের আঙ্গিনায় উপস্থিত হয়ে যখন এ বিস্ময়কর ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তখন কোরাইশ দলপতিরা এ কথা শুনে পরীক্ষার ছলে বায়তুল মুকাদ্দাসের দরজা- জানালা প্রভৃতির বিবরণ দিতে বলল! তারা এ কথাও জানতো যে, রাসুলুল্লাহ (দ.) ইতিপূর্বে কোন দিন জেরুজালেমে যাননি। মহান রাব্বুল ইজ্জত সাথে সাথে জিব্রাঈল (আ.) এর মারফতে বায়তুল মুকাদ্দাসের পূর্ণ চিত্র হুজুর (দ.) এর সামনে তুলে ধরলেন আর তিনি দেখে দেখে দরজা- জানালা প্রভৃতির বর্ণনা বিশদভাবে উপস্থাপন করলেন। হযরত জাবের (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (দ.) কে বলতে শুনেছি, ‘যখন কোরাইশরা মিরাজের ঘটনার ব্যাপারে আমাকে অস্বীকার করছে, তখন আমি মকামে হিজরে দাঁড়ালাম আর মহান আল্লাহ বায়তুল মুকাদ্দাসকে আমার সামনে উপস্থাপন করলেন। আমি সেই বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে দেখে দেখে তাদের সকল প্রশ্নের জবাব দিলাম।’ বোখারী, মুসলিম, মিশকাত।
মহাগ্রন্থ আল কোরআন যেমন পৃথিবীর যে কোনো গ্রন্থের মোকাবেলায় অপ্রতিদ্ব›দ্বী, ঠিক তেমনি নুরুন্নবী (দ.) এর মিরাজ গমন বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে বিজ্ঞানীদের এক অনন্য গবেষণার বিষয়। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যতই উৎকর্ষ সাধিত হচ্ছে ইসলামের বিধি-বিধান বুঝাও ততই সহজতর হচ্ছে। এক সময় বিজ্ঞানীরা বলত, কোন প্রাণীর পক্ষে আকাশ ভ্রমণ সম্ভব নয়। তাই তারা মিরাজকে অস্বীকার করত। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষে তারাই প্রমাণ করল, মানুষ শুধু আকাশ নয়, বরং গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে, শূন্য থেকে মহাশূন্যে বিচরণ করতে পারে। আমেরিকার নভোচারী পৃথিবী থেকে দু’লক্ষ চল্লিশ হাজার মাইল দূরের চাঁদের সাথে মিতালী করে বিশ্বকে অবাক করে দিল। তারপর বিচরণ করল মঙ্গল গ্রহে। এখন প্রতিযোগিতা চলছে কে বুধ, কে শুক্র, ইউরেনাস ও নেপচুনে গিয়ে পৌঁছবে। বিজ্ঞানীদের ভাষ্য মতে, আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। সূর্য পৃথিবী হতে নয় কোটি ত্রিশ লক্ষ মাইল দূরে। তাই সূর্যের আলো পৃথিবীতে আসতে সময় লাগে আট মিনিট। আর এই চন্দ্র-সূর্য নক্ষত্ররাজী সবই নূরুন্নবীর নূর (নূরে মুহাম্মদী) থেকে সৃষ্ট ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম শাখা। অতি ক্ষুদ্রতর শাখার গতি যদি এত বেশি হয়, তবে নূরে মুহাম্মদীর গতি কত হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
লেখক: আরবী প্রভাষক, রাণীরহাট আল আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদ্রাসা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Monjur Rashed ২৫ মার্চ, ২০২০, ৭:৩৮ পিএম says : 0
Subhan Allah!!! A heart-touching description from a true Ashique-E-Rasul (SM)
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন