শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

স্বাধীনতা দিবসের অঙ্গীকার হোক দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২৬ মার্চ, ২০২০, ১২:০২ এএম

আজ স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। স্বাধীনতা মানুষের সর্বাপেক্ষা কাম্য বস্তু। বিজয় বা স্বাধীনতা লাভের জন্য বাংলাদেশের জনগণ বহুদিন ধরে আকুল ছিল। বহুদিন ধরে সংগ্রাম করে অবশেষে ১৯৭১ বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে। সে থেকে প্রতিবছর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস পালিত হয়ে আসছে।

দিনটি উদযাপনের বিশেষ তাৎপর্য হলো, স্বদেশপ্রেমে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করা। স্বদেশ মানচিত্রের একটি চিহ্নিত অংশ মাত্র। ক্ষুদ্র ভূমন্ডলের এ বিশেষ অংশটি আমাদের জন্মভূমি-পিতৃপিতামহের বাসস্থান। এ দেশের আবহাওয়া, ভাবধারা, সমাজ, সংস্কৃতি আমাদের দেহ-মন পরিপুষ্ট করে। সে জন্য স্বদেশ সকলের প্রিয়। এটি যত অনগ্রসর দেশ হোক, এর জলবায়ু যত খারাপ হোক, এটি যত দুর্জন মানুষে পরিপূর্ণ হোক, তবু স্বদেশ সকলের নিকট প্রিয়।

বাল্যকাল থেকে স্বদেশের সঙ্গে আমাদের পরিচয়। প্রথম চলতে শিখি এ দেশের মাটির ওপর। এ দেশের ধুলায় আমাদের অঙ্গ ধূসরিত হয়। এ দেশের বাতাসে আমরা নিঃশ্বাস গ্রহণ করে বেঁচে থাকি। এ দেশের আলো ও আবহাওয়ার মধ্যে আমাদের দেহ গঠিত হয়। এ দেশের সমাজের মধ্যে থেকে আমরা বড় হই। এ দেশের ভাবধারা আমাদের মন গঠন করে, এ দেশের ঐতিহ্য ও সভ্যতা আমাদের মনের সংস্কাররূপে মনে বাসা বাঁধে। এ দেশের গৌরবে আমাদের বক্ষস্ফিত হয়। এ দেশের কলঙ্কে আমরা অধোবদন হই। এ দেশের দুঃখে আমাদের হৃদয়বীণায় করুণ রাগিণী জাগে। এ দেশের জনসাধারণকে আমরা ভাইয়ের মতো আপন মনে করি। এ দেশের শক্রদের আমরা আপন শক্র মনে করে উচ্ছেদ করার বাসনা মনে পোষণ করি। এত বেশি করে এ দেশের সঙ্গে আমরা জড়িত যে, আমাদের ব্যক্তিগত চরিত্র এ দেশের অধিবাসীর সাধারণ চরিত্র থেকে পৃথক হয় না। বস্তুত এক রকম হয়ে পড়ে। আমরা স্বদেশকে ভালবাসি। এ ভালবাসার জোরে অগণিত মানুষ একদিন মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধ করে এবং দেশকে স্বাধীন করেছিলেন। তবে স্বাধীনতার এত বছর পার করে দিয়েও দেশের সিংহভাগ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। দারিদ্র্য স্বকৃত দোষে হতে পারে আবার স্বাধীন বাংলাদেশের সামাজিক ব্যবস্থার কারণে হতে পারে। দেশে পরিশ্রমী লোক আছে কিন্তু তারা কাজ পায় না। কাজ করলেও যথেষ্ট মজুরি পায় না। শরীরের রক্ত পানি করে এরা পরের সম্পদ গড়ে। দারিদ্র্যের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের বর্তমান সমাজই দায়ী।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিছু রাজনীতিবিদ ও তাদের সাগরেদ আমলা এবং ঠিকাদারেরা উন্নয়নের টাকা একেবারে ঢেঁকিসুদ্ধ গিলে ফেলার কাজে ব্রতী হওয়ায় আজকের সমাজে এ বিরাট দরিদ্রের দল সৃষ্টি হয়েছে। আজ কোনো অঞ্চলের উন্নয়নখাতে এক টাকা বরাদ্দ হলে মাঝপথে প্রায় বার আনা লোপাট হয়ে যায়, লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে মাত্র চার আনা। এ লোপাট করা চৌদ্দ আনার ভাগিদাররা বিজয়ের সুখ উপভোগ করছেন এদের সিংগভাগ হলেন বর্তমান যুগের এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ ও বড়কর্তা, জনগণকে শুষে নেয়া হলো তাদের কাজ। মূলত এদের রং-বেরঙের অট্টালিকাগুলো জনগণের খুনে রাঙা হয়ে উঠেছে।

স্বাধীনতার ৪৯ বছর পেরিয়ে দুর্নীতি আজ একেবারে সমাজের পরতে পরতে ছেঁয়ে গেছে। এর জন্য মূলত আমাদের জন প্রতিনিধিরাই দায়ী। কথায় বলে, ‘আপনি আচারি ধর্ম পরকে শিখাও।’ এদের বড় একটা অংশ দুর্নীতিবাজ তাই দুর্নীতিতে দেশ আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়েছে এবং উত্তরোত্তর এটি শুধু বৃদ্ধি পাচ্ছে। যতই গলাবাজি করে বলা হোক দুর্নীতি কমছে কিন্তু আসলে কমছে কি? দুর্নীতি দমন কমিশনে নাকি দুর্নীতি হচ্ছে বেশি। কোনো শাসক দল এর লাগাম ধরায় সচেষ্ট নয়। স্বাধীনতার শর্ত কিন্তু এটি ছিল না। জনপ্রতিনিধিদের চারিত্রিক ধর্ম এটি হবার কথা ছিল না। কথা ছিল না, দেশ বা সমাজ পরিচালনা করার অজুহাতে জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে নেতা থেকে পাতি নেতার ব্যক্তিগতভাবে কোটি কোটি টাকার স্তূপ গড়ে তোলার! কেননা, আমাদের দেশে পীর, ফকিরেরা স্বেচ্ছায় দারিদ্র্য বরণ করে অকিঞ্চন হয়ে আল্লাহর রাস্তায় জীবন উৎসর্গ করেন। যে জগতে অর্থ মূলত পরমার্থ লাভের পথের বাধা সেটা উপলব্ধি করেই তারা চির দারিদ্র্য বরণ করেন। সালাম সেসব লোকোত্তর পুরুষদের, যারা অনন্ত ঐশ্বর্য পায়ে ঠেলে মানুষের দুঃখ-দারিদ্র্য দূর করার জন্য দরিদ্র বেশ ধারণ করেন, পরের জন্য নিজের সুখ-ঐশ্বর্য অকাতরে বিলিয়ে দেন, মানুষের দুঃখে যারা আহার, নিদ্রা, সুখবিলাস ত্যাগ করেন। বিজয়-পূর্ব বাংলাদেশের প্রায় নেতারা ছিলেন এ পদের উপযুক্ত বিজয়-উত্তর আমাদের দেশের জননেতা বা কর্ণধাররা প্রায় সকলে ঠিক এর উল্টো হয়ে পড়েছেন। এরা লোভী, এদের লোভের শেষ নেই। এদের কাছে আজ চিত্ত থেকে বিত্ত বড়। জনগণকে বঞ্চিত করে চারদিকে শুধু ব্যক্তিগত বিত্ত-বৈভব গড়ে তুলতে তারা ব্যস্ত। পত্র-পত্রিকায় এদের বিরূপ সমালোচনা করা হলে তারা এটি গায়ে মাখেন না। যেন ‘বকো আর ঝকো কানে দিয়েছি তুলো।’ অসংকোচে এর প্রতিবাদ করার সাহস এদের নেই, কেননা এরা যে দোষী।

বাস্তবিক যে অর্থে একদিন হাজার হাজার মানুষ স্বাধীনতার জন্য আত্মবলিদান করেছিলেন, প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন তার সিকিভাগ চরিতার্থ আজো হয়ে ওঠেনি। এর মূলে ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত দায়ী। তখন অন্তত বিচারবোধ বলে কিছু ছিল। আজ বিচারের নামে দেশজুড়ে চলছে প্রহসনের পর প্রহসন। এসবের ফাঁকে নামী-দামি মুখোশধারী রাঘববোয়াল অপরাধীরা অনায়াসে পার পেয়ে যাচ্ছেন। শুনেছি, ব্রিটিশ আমলে নাকি কুকুর মারলেও বিচার হতো শাস্তি হতো, আজ মানুষ মারলেও বিচার হয় না। টাকা আর রাজনৈতিক প্রভাবে শেষ ফয়সালা হয়ে যায়। আজ মানুষে মানুষে দিনরাত হানাহানি। একদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণস্তূপের মতো জমা হয়ে আছে, আরো জমা হচ্ছে-এ অসাম্য, এ ভেদজ্ঞান দূর করতে রাষ্ট্রনায়করা কেউ এগিয়ে আসছেন না। তাঁরা এসকর্ট নিয়ে কোটি টাকার বুলেটপ্রæফ গাড়িতে চলাফেরা করছেন। অন্যদিকে দেশের আমজনতা প্রকাশ্য দিবালোকে সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হচ্ছে! তাঁরা স্বাধীনভাবে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে ভয় পাচ্ছে। এর নাম স্বাধীনতা!

দেশের গ্রামাঞ্চলের প্রায় পঞ্চাশভাগ মানুষ আজো আমাদের জাতীয় পতাকার মাহাত্ম্য জানে না। অনেকে এটি এখনো চোখে দেখেননি! কেননা, স্বাধীনতা দিবসের দিনে গ্রামাঞ্চলে আজো জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার প্রচলন চালু হয়নি। প্রত্যেকটি গ্রামেই আজ অন্তত একটি করে প্রাইমারি স্কুল রয়েছে। শিক্ষকদের এসব মহান দিনে এ মহান দায়িত্বটি পালন করার কথা, কিন্তু তারা এটি পালন করছেন না। কেন করছেন না, এ প্রশ্ন করার কোন প্রশাসক আজ আমাদের দেশে নেই। কেননা, প্রশ্ন যাঁরা করবেন, তাঁরা যে ‘সবাই রাজা আমাদের এ রাজার রাজত্বে।’

পরিসর অল্প। অধিক বলার উপায় নেই। তবু রাজতন্ত্রের কথাটি যখন উঠে আসে তখন প্রাসঙ্গিক একটি ঘটনার কথা না বললে নয়। সে প্রায় ছত্রিশ বছর আগের কথা। স্বাধীনতার চার মাস পরে আমার শহুরে মামা ছুটি উপলক্ষে এসেছেন আমাদের গ্রামের বাড়িতে। তিনি বাড়িতে এলে বরাবরের মতো গ্রামবাসীরা তাঁর কাছে ছুটে এলেন শহর এবং দেশ-বিদেশের নানা গল্প শুনতে। তিনি সবাইকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘দেশ স্বাধীন হলো।’ তার এ কথায় গ্রামবাসীরা চমকে ওঠে বলেন, ‘অ্যা! কবে? তাহলে রাজা কে হলেন? শেখ মুজিব বুঝি?’ গ্রামবাসীদের এহেন কথায় তাঁর মনে ভাবান্তর হলেও তা তিনি গোপন রেখে জবাব দেন, ‘হ্যাঁ। তাই বটে।’ আমরা তখন ছোট ছিলাম। বুদ্ধি হবার পর মামার মুখে এটি শুনে অবাক হয়ে ভেবেছি-এক সাগর রক্তের বিনিময়ে যে দেশ স্বাধীন হলো সে বাংলাদেশের শহর থেকে অনতিদূরে একটি গ্রামে সে খবর পৌঁছল স্বাধীনতা লাভের চার মাস পরে। তার চেয়ে বড় কথা হলো, গণতন্ত্রে যে রাজার স্থান নেই সে কথাটি গ্রামবাসীরা আদৌ জানেন না!

আমরা জানি, স্বাধীনতার অন্যতম শর্ত ছিল, সকলের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা, খাদ্য, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের সুবন্দোবস্ত করে দেয়া কিন্তু এর কোনটি আজো বাস্তবে রূপায়িত হয়নি। সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মামুলি সূই-সুতাও টাকা দিয়ে ক্রয় করতে হয়। সরকারি স্কুলগুলো আজ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এক অংশে অবসর বিনোদনের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। পড়াশোনা বড় একটা হয় না। সরকারি কর্তাব্যক্তি ও ধণীরা এখন প্রাইভেট স্কুলের হাতে নিজেদের সন্তানদের তুলে দিচ্ছেন। বিভাগীয় কর্তাব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিরা সরকারি শিক্ষার ব্যাপারে উদাসীন। ফলে আমজনতার ছেলে-মেয়েরা শিক্ষায় এতটুকু অগ্রসর হতে পারছে না। মোট কথা, আমজনতার সর্বগ্রাসী দারিদ্র্য, অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনযাত্রার পরিশেষ-পরিস্থিতির এতটুকু উন্নতি ঘটেনি বরং আরো অবনতি হয়েছে। দেশে আজ যোগ্য ব্যক্তির অভাব নেই কিন্তু আমরা এমন স্বাধীনতা ভোগ করছি যে, যোগ্য ব্যক্তিরা আজ যোগ্যপদে নিযুক্তি পাচ্ছেন না। অযোগ্যরাই এখন যোগ্যদের স্থান দখল করে নিচ্ছে। রাজনীতিতে এখন ভালো এবং সৎ মানুষের কোনো স্থান প্রায় নেই। তাই ঘটা করে প্রতি বছর এ স্বাধীনতা উদযাপন করাটা তাৎপর্যহীন হয়ে পড়ছে। এর নামে মাঝপথে জনগণের ঘামঝরা টাকার অপচয় হচ্ছে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন