বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

অপরাধ বনাম করোনাভাইরাস : প্রেক্ষিত শর‘ঈ নির্দেশনা

মুফতি মোঃ আবদুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ২৬ মার্চ, ২০২০, ১২:০১ এএম

সুচনা: দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়া মহামারী ‘করোনা ভাইরাস’ নামীয় মহা বিপদটিকে ইসলামী শরীয়ত এর আলোকে কিভাবে সার্বিক বিবেচনা ও ব্যাখ্যা করা যায় এবং তাতে আমাদের করনীয় কি? এতদসংক্রান্ত বিষয়গুলো অত্র প্রবন্ধে আলোচনা’র প্রয়াস নেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, এক্ষেত্রে মৌলিকভাবে দু’টি বিষয় অর্থাৎ ‘পাপ-অপরাধ’ ও ‘মহামারী বা ব্যাপকভাবে থাবা বিস্তারকারী রোগ-ব্যাধি’ সামনে রাখলে, বাস্তব উপলব্ধি ও সমন্বয় সহজ হতে পারে ইনশাআল্লাহ। যে-কারণে আমরা পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ্র নিরীখে ‘অপরাধ’ ও এর ব্যাখ্য দিয়ে শুরু করছি।
‘অপরাধ’: দোষ-ত্রুটি, পাপ, বে-আইনী কাজ (সংস্কৃত); ‘পাপ’ কলুষ, দোষ, বিপদ, সীমালঙ্ঘন, অন্যায়, অধর্ম বা অশাস্ত্রীয় কার্য (সংস্কৃতি); ‘গুনাহ’- দোষ, অপরাধ, পাপ (ফারসী)। এ শব্দত্রয় মৌল বিবেচনায় যে কোন ভাষারই অন্তর্ভুক্ত হোক না কেন বাংলা ভাষায় তিনটিই সমার্থক। তবে ‘পাপ’ বা ‘গুনাহ’ শব্দ ব্যবহারে যদিও কারও বুঝতে তেমন একটা অসুবিধা না হয় কিন্তু তারপরও ‘অপরাধ’ শব্দটি মুসলিম-অমুসলিম, সৎ-অসৎ, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে তুলনামূলক বেশী সহজবোধ্য ও ব্যাপকভাবে পরিচিত। তাই অত্র প্রবন্ধে তুলনামূলকভাবে ‘অপরাধ’ শব্দই বেশী ব্যবহার করা হয়েছে।
ব্যাপক বিপর্যয়ের কারণ:
মহান আল্লাহ্ ইরশাদ করেন-
“স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের (অপরাধের) দরুন বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ্ তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে।” আল-কুরআন ঃ ৩০:৪১ অর্থাৎ স্থলে, জলে তথা সারা বিশ্বে মানুষের অপরাধ তথা কু-কর্মের কারণে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। তাফসীরে রূহুল মা‘আনীতে বলা হয়েছে ঃ “বিপর্যয় বলে দুর্ভিক্ষ, দুর্মূল্য, মহামারী, অগ্নিকান্ড, পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার ঘটনাবলীর প্রাচুর্য, সবকিছু থেকে বরকত উঠে যাওয়া, উপকারী বস্তুর উপকার কম এবং ক্ষতি বেশী হয়ে যাওয়া ইত্যাদি বিপদ-আপদ বোঝান হয়েছে”।
অন্য এক আয়াতে আলোচ্য বিষয়বস্তু এভাবে বর্ণিত হয়েছে-
“তোমাদের যেসব বিপদ-আপদ স্পর্শ্ব করে, সেগুলো তোমাদেরই কৃতকর্মের (অপরাধের) কারণে। আর অনেক অপরাধ তো আল্লাহ্ ক্ষমাই করে দেন”। আল-কুরআন ঃ ৪২:৩০
উদ্দেশ্য এই যে, এই দুনিয়ায় বিপদাপদের সত্যিকার কারণ তোমাদের অপরাধ; যদিও দুনিয়াতে এসব অপরাধের পুরোপুরি প্রতিফল দেয়া হয় না এবং প্রত্যেক অপরাধের কারণেই বিপদ আসে না। বরং অনেক অপরাধ তো ক্ষমা করে দেয়া হয়। কোন কোন অপরাধের কারণে বিপদ আসে। দুনিয়াতে প্রত্যেক অপরাধের কারণে বিপদ এলে একটি মানুষও পৃথিবীতে বেঁচে থাকত না। যে-কারণে অনেক অপরাধ তো আল্লাহ মাফই করে দেন। যেগুলো মাফ করেন না সেগুলোর পুরোপুরি শাস্তিও দুনিয়াতে দেন না; বরং সামান্য স্বাদ আস্বাদন করানো হয় মাত্র। যেমন প্রথমোক্ত আয়াতের শেষে রয়েছে- “যাতে আল্লাহ্ তোমাদের কোন কোন কর্মের (অপরাধের) শাস্তি আস্বাদন করান”। এরপর বলা হযেছে, কুকর্মের কারণে দুনিয়াতে বিপদাপদ প্রেরণ করাও আল্লাহ্ তালার কৃপা ও অনুগ্রহের নামান্তর। কেননা, পার্থিব বিপদের উদ্দেশ্য হচ্ছে গাফিল মানুষকে সাবধান করা, যাতে সে অপরাধ থেকে বিরত থাকে। আর এটিও পরিণামে, তার জন্যে উপকারপ্রদ ও একটি বড় নেয়ামত। তাই আয়াতের শেষে বলা হয়েছে- “যেন তারা ফিরে আসে, বিরত হয়”। মা’আরিফুল কুরআন, এক খন্ডে ছাপা, সৌদী আরব, পৃ. নং ১০৪৬।
আলোচ্য বিষয় সংশ্লিষ্ট আরেকটি আয়াত রয়েছে, সূরা আস্ সিজদা-এর মধ্যে। যেমন-
“গুরু শাস্তির পূর্বে আমি অবশ্যই তাদেরকে লঘু শাস্তি আস্বাদন করাবো, যাতে তারা প্রত্যাবর্তন করে”। আয়াত নং ঃ ৩২:২১। ‘নিকটতম’ মানে ‘নিকটতম শাস্তি’ বলে ইহলৌকিক বিপদাপদ, রোগ-ব্যাধি ও মহামারীকে বোঝানো হয়েছে এবং “বড় শাস্তি”-বলে, অপরাধের পারলৌকিক শাস্তি বোঝানো হয়েছে। যারা আল্লাহ্র দিকে ফিরে আসে তাদের পক্ষে ইহকালীন শাস্তি তথা বিপদাপদ হমতস্বরূপ হয়ে যায়। আর যারা তেমন দুর্যোগ-দুর্বিপাক ও মহামারী সত্তে¡ও আল্লাহ্র প্রতি ধাবিত হয় না তাদের পক্ষে এই জাগতিক শাস্তি প্রাথমিক ও আংশিক এবং পরকালীন কঠিন শাস্তি হবে চূড়ান্ত ও আসল।” প্রাগুক্ত: পৃ. নং ১০৬৬।
সূরা ‘আশ্শুরা’র উপরিউক্ত ৩০নং আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে- “হযরত হাসান (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে; আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পর নবীজী (স) ইরশাদ করলেন ঃ সেই সত্তার শপথ যার নিয়ন্ত্রণে আমার প্রাণ, যে ব্যক্তির গায়ে কোন কাঠের আঁচড় লাগে, অথবা কোন শিরা ধড়ফড় করে, অথবা পা পিছলে যায় তা সবই তার অপরাধের কারণে হয়ে থাকে। আল্লাহ্ তা‘লা প্রত্যেক অপরাধের শাস্তি দেন না, বরং শাস্তি দেন না প্রকৃতির অপরাধই বেশী । তারপরও জাগতিক জীবনে সংঘটিত অন্যতম হচ্ছে দৈহিক পীড়া, করোনা-সদৃশ মহামারী, রোগ-ব্যাধি ও কষ্ট যেমন পাপ-অপরাধের কারণে হয়ে থাকে তেমনি আত্মিক ও আধ্যাত্মিক ব্যাধিও হয়ে থাকে কোন কোন অপরাধের কারণে। এক অপরাধে লিপ্ত হলে তা আরেকটি অপরাধে জড়িয়ে পড়ার কারণ হয়ে যায়।
হাফিয ইবনুল কাইয়্যিম (র) ‘দাওয়ায়ে শাফী’ গ্রন্থে লিখেন: “গুনাহ-অপরাধের এক নগদ শাস্তি হচ্ছে একটি অপরাধের পরেই আরেকটি অপরাধে/পাপে জড়িয়ে পড়ার পরিবেশ সৃষ্টি হওয়া। একইভাবে সৎকর্মের নগদ প্রতিদান হচ্ছে আরেকটি সৎ কর্মের তাওফীক হয়ে যাওয়া”। প্রাগুক্ত: পৃ. নং ১২১৮।
মহামারী, অনাবৃষ্টি ও দুর্ভিক্ষ বা দুর্মূল্যের কারণ
মহামারী, অনাবৃষ্টি ও দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি ব্যাপক ও জাতীয় দুর্যোগ-দুর্বিপাকের মূল কারণ হচ্ছে, মহান আল্লাহর আদেশ-নিষেধের বিরুদ্ধাচারণ এবং নিজেদের ব্যাপকভাবে অপরাধ কর্মে জড়িয়ে ফেলা। বিশেষত ব্যাপকভাবে যিনা-ব্যভিচারে জড়িয়ে পড়া, অন্যদের হক-অধিকার বিনষ্ট করা, গরীব-মিসকীন-অসহায় মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা না করা, ওজন-মাপে কম দেয়া; এসব হচ্ছে জাতীয় পর্যায়ে অভাব-অনটনের বা দুর্ভিক্ষ-দুর্মূল্যের মূল কারণ।
হাদীস শরীফে এসেছে, “যারা ওজন-পরিমাপে কম দেয় তারা দুর্ভিক্ষে, কঠোর মৃত্যু যন্ত্রণায় এবং শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক মারাত্মক অন্যায়-অবিচারের শাস্তির মুখোমুখী হয়।” অপর একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, “যে জাতির মধ্যে যিনা ব্যাপকতা লাভ করে তাদেরকে অভাব-দুর্ভিক্ষ-দুর্মূল্যের শাস্তিও মহামারী আকারে গ্রাস করে”। ফাতাওয়া রহীমিয়্যা ঃ খ-২, পৃ. ৪০৯, এদারা দাওয়াতে ইসলাম, কারচী, পাকিস্তান।
মাও: রূমী (রহঃ) মসনবী শরীফে বলেছেন-
যার অর্থ ঃ “নিয়মিত যাকাত প্রদান না করাও অনাবৃষ্টির অন্যতম কারণ; আর ব্যাভিচারের ব্যাপকতা দিকে দিকে মহামারী ছড়ায়”।
হযরত আবু সুফিয়ান হতে বর্ণিত,
তিনি বলেন: আমি বনী ইসরাঈল সংক্রান্ত একটি ঘটনা অবহিত হয়েছি, এক সময় বনী ইসরাঈল জাতির ওপর প্রচন্ড অভাব ও দুর্ভিক্ষ ঝেঁকে বসল যা একাধারে সাত বছর চলতে থাকল। এক পর্যায়ে অভাবের তাড়নায় তারা মৃত জীব-জন্তু ভক্ষণ শুরু করল। এমনকি নিজ নিজ বাচ্চা-শিশুদেরও ভক্ষণ করে তারা প্রচন্ড ক্ষুধার জ্বালা থেকে বাঁচার চেষ্টা করছিল। এক পর্যায়ে তারা-
পাহাড়-জঙ্গলের দিকে বেরিয়ে পড়ল এবং মহান আল্লাহ্র দরবারে খুব কাকুতি-মিনতি সহকারে কান্নাকাটি জুড়ে দিল। তখন মহান আল্লাহ তাদের নবীর প্রতি প্রত্যাদেশ পাঠালেন ঃ “আমি তোমাদের কারও প্রার্থনা কবুল করবো না এবং তোমাদের কারও কান্নাকাটির প্রতি করূণা প্রদর্শন করবো না যে পর্যন্ত না তোমরা অন্যায়ভাবে আহরিত অন্যান্যদের প্রাপ্য হক-অধিকার ফেরত বুঝিয়ে না দিবে”। তারা তা-ই করল। তারপর তাদের রহমতের বৃষ্টি দেয়া হল। মাজালিসে আবরার ঃ মজলিস নং ৪৫, পৃ. নং ২৭২।
পীরানে পীর হযরত সৈয়দ আব্দুল কাদির জীলানী (রহঃ) বলেন-
“বনী ইসরাঈলের একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যে, এক সময়ে তাদের ব্যাপক হারে বা জাতীয়ভাবে প্রচন্ড অভাব-অনটনে গ্রাস করল। তারা তাদের সমকালীন একজন নবীর দরবারে উপস্থিত হয়ে আরজ করল ঃ আপনি মেহেরবানী করে আমাদের বলে দিন মহান আল্লাহ্ কি আমল করলে আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন! তা আমরা পালন করে চলবো। যেন তিনি আমাদের প্রতি রাজি হয়ে যান এবং আমাদের প্রতি আপতিত এই মহাসঙ্কট যেন তাতে দুরীভূত হয়ে যায়”। সংশ্লিষ্ট নবী মহান আল্লাহর দরবারে তা জানতে প্রার্থনা জানালেন। মহান আল্লাহ্ ওহী নাযিল করে নবীর মাধ্যমে তাদের জানিয়ে দিলেন, আপনি তাদের বলুন! “তোমরা যদি আমাকে সন্তুষ্ট করতে চাও তাহলে তার পূর্বে মিসকীন-অসহায় লোকদের সন্তুষ্ট কর। যদি তাদেরকে সন্তুষ্ট করতে পার তাহলে আমিও সন্তুষ্ট হয়ে যাবো। আর যদি তারা তোমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট থাকে তাহলে আমিও তোমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট থাকবো। হে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান লোকেরা! খুব ভাল করে শুনে রাখো, যতদিন পর্যন্ত তোমরা মিসকীন-সহায়-সম্বলহীন জনগণকে নারাজ করে রাখবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করবে ততদিন পর্যন্ত তোমরা কোনক্রমেই মহান আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবে না; বরং তেমন পরিস্থিতিতে তোমরা অবিরামভাবে আল্লাহপাকের ক্রোধের প্রতি ধাবিত হতে থাকবে”। ফয়ুজে ইয়াযদানী তরজমা ফাত্হি রাব্বাবানী, মজলিস নং-৩৮, পৃষ্ঠা নং ২৫৭।
ভূমিকম্প ও শরীয়তের দৃষ্টিকোণ
মহান আল্লাহ মানবদেহের অনুরূপ পৃথিবীর স্থলভাগ বা ভুমন্ডলেরও অদৃশ্য রগ-রেশা, নাড়ি সৃষ্টি করেছেন। সে সব, রগ-রেশা-নাড়ি ফিরিশতাদের দায়িত্বে রয়েছে। কোন অঞ্চলে যখন অপরাধ প্রবণতা, পাপাচারিতা ও সীমালঙ্ঘন চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায় এবং মহান আল্লাহর সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে আযাব পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয় তখন তিনি ওই ফিরিশতাদের নির্দেশ পাঠান, ফিরিশতারা সংশ্লিষ্ট ভুভাগের রগ-নাড়ি বা লাগাম ধরে নির্দেশমত ঝাঁকি দিয়ে থাকেন। এ থেকে ভুমিকম্প রূপ নিয়ে থাকে”। ফাতাওয়া রহীমিয়্যাঃ খ-৩, পৃ. ২০৭, প্রাগুক্ত।
মহানবী (স)-এর সময়ে একবার সামান্য ভু-কম্পন হল। নবীজী (স) সাহাবাদের সম্বোধন করে বললেন: “তোমাদের প্রভু তোমাদের কাছ থেকে তাওবা কামনা করছেন। তাই তোমরা তাওবা কর”। মোটকথা অপরাধ প্রবণতা ও পাপাচারিতার আধিক্য ভুকম্পনের কারণ যেমন হয়ে থাকে; একইভাবে তা মহামারী ইত্যাদিরও কারণ হয়ে থাকে; এমনটিই হাদীস থেকে বুঝা যায়। আর তা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে মনে-প্রাণে তাওবাকরা ।
হযরত ওমর ফারূক (রা)-এর বরকতপূর্ণ যুগেও একবার (ছোট) ভূমিকম্প হয়েছিল। তখন তিনি জনগণকে সম্বোধন করে জানিয়ে দিলেন: “বিশেষ কোন অপরাধ-পাপ ব্যাপক হারে সংঘটিত হচ্ছে: তাই ----! তোমরা সকলে তাওবা কর। আমি শপথ করে বলছি, আবার যদি ভূমিকম্প সংঘটিত (বড়ভাবে) হয় তাহলে আমিও আর এখানে বিদ্যমান থাকবো না”।
হযরত আয়েশা (রা)-কে ভূমিকম্প সম্পর্কে জানতে প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাব দেন: “ব্যভিচার, মদ-পান ও গান-বাজনার অপরাধ যখন মানুষের মজ্জাগত হয়ে যায় তখন মহান আল্লাহ্র ক্রোধ উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। যদি সামান্য ইঙ্গিতবাহী (অল্প নাড়া-চাড়ায়) সতর্কতার পরই সংশ্লিষ্ট জনপদবাসী তাওবা করে নেয় তাহলে রক্ষা পাওয়া যায়; নতুবা ব্যাপক হারে ধ্বংসযজ্ঞ, সুউচ্চ বাড়ীঘর-বিল্ডিং-নির্মাণাদি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়”।
পুনরায় প্রশ্ন করা হল: ভূমিকম্প কি শাস্তি?
তিনি জবাবে বললেন: “মুমিনদের ক্ষেত্রে (পরিণামে) রহমত হয়ে থাকে এবং অবিশ্বাসী ও পাপাচারীদের ক্ষেত্রে জাগতিক শাস্তিরূপেই পরিগণিত হয়ে থাকে”।
হযরত ওমর ইবনি আব্দুল আযিয (রহ্) মুসলিম জাহানের খলীফা ও আমিরুল-মুমিনীনরূপে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে একটি ফরমান লিখে পাঠালেন যে, “এই ভূমিকম্পের স্বরূপ হচ্ছে, মহান আল্লাহ নিজ বান্দাদের প্রতি অসন্তোষের ইঙ্গিত পাঠিয়ে তাদেরকে তাওবা করার প্রতি পথ-নির্দেশ করছেন। তখন সকলকে মনে-প্রাণে তাওবা করা চাই; পাপাচারিতা পরিহার করা চাই; বেশী বেশী দান-খয়রাত করা চাই এবং মাকরূহ ওয়াক্ত না হলে সঙ্গে সঙ্গে নফল নামাযে মনোনিবেশ করা কর্তব্য। এছাড়া, হযরত আদম (আঃ) এর দু’আÑ
‘রাব্বানা যলামনা আন্ফুসানা, ওয়া ইল্লাম-তাগফির লানা ওয়া তারহামনা, লানাকূনান্না মিনাল-খ-ছিরীন’।
হযরত নূহ (আঃ)-এর দু’আ-‘ওয়া ইল্লাম তাগফিরলী ওয়া-তারহামনী, আকুম-মিনাল খছিরীন’।
এবং হযরত ইউনুস (আঃ)-এর দু’আ- ‘লা-ইলাহা ইল্লা আনতা, ছুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনায-যলিমীন’
Ñইত্যাদি পড়ায় নিমগ্ন হওয়া কর্তব্য”। প্রাগুক্ত : খ-৩, পৃ. ২০৮।
একই গ্রন্থের ৬ষ্ঠ খন্ড; ৪৫০, ৪৫১, ৪৫২, ৪৫৩, ৪৫৪ ও ৪৫৫ পৃষ্ঠায় বিশেষভাবে ব্যভিচার অপরাধ সম্পর্কে আলোচিত আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য নিম্নে উদ্ধৃত করা হল-
ইসলামী শরীয়তে যিনা-ব্যভিচারকে সম্পূর্ণরূপে হারাম করা হয়েছে। র্শিক ও হত্যার পর সবচেয়ে বড় অপরাধ হচ্ছে যিনা। পবিত্র কুরআনে এ যিনা সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
“তোমরা যিনা-ব্যভিচারের কাছেও যাবে না। নিশ্চিত! তা হচ্ছে মারাত্মক নির্লজ্জতা এবং সাংঘাতিক রকমের মন্দ পথ”। আল-কুরআন: ১৭ : ৩২।
উক্ত আয়াতে যিনা হারাম হবার দু’টি কারণ বর্ণনা করা হয়েছে-
(এক) নির্লজ্জতা: মানুষের মাঝে যদি লজ্জা-শরমের গুণ না থাকে তাহলে তার মানবতা বা মনুষ্যত্বই হাওয়া হয়ে যায়। তারপর আর তার কাছে কোন ভাল-মন্দ কর্মের তফাৎই থাকে না। তাই হাদীস শরীফে বলা হয়েছে-
অর্থাৎ “তোমার লজ্জা-শরমই যখন নেই, তুমি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পার”।
(দুই) সামাজিক বিশৃঙ্খলা: যা কিনা যিনার দরুন এতো বেশী বিস্তৃতি লাভ করে -যার কোন সীমা থাকে না। তার বিষাক্ত ফলাফল অনেক সময় পুরো গোষ্ঠী-খান্দান ও জাতিকে রসাতলে পৌছিয়ে দেয়। বর্তমান বিশ্বে হত্যা ধ্বংসযজ্ঞ ও ঝগড়া-বিবাদের যত অঘটন ঘটছে তার বেশীর ভাগের ক্ষেত্রেই উক্ত যিনা বা ব্যভিচার পটভুমিকা স্বরূপ কাজ করছে যেমন- অবৈধ প্রেম, উত্যক্তকরণ, এসিড নিক্ষেপ, আত্মহত্যা ইত্যাদি; যার অন্যতম জাগতিক পরিণতি ‘এইড্স’ এবং সেটাও একটা মহামারী বলা চলে। এ কারণেই ইসালামী শরীয়ত যিনা-ব্যভিচারকে সকল বড় বড় অপরাধের অন্যতম বড় অপরাধরূপে গণ্য করেছে এবং এর শাস্তিও অপরাপর অপরাধের শাস্তির তুলনায় কঠোর নির্ধারণ করেছে। মহান আল্লাহর বাণী-
“যিনাকারী নারী ও যিনাকারী পুরুষ এদের প্রত্যেককে একশ’টি করে বেত্রাঘাত করো”। আল-কুরআন: ২৪ : ০২। আর যদি বিবাহিত নারী বা বিবাহিত পুরুষ যিনা করে তাহলে তাদের পাথর নিক্ষেপের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
হাদীস শরীফেও যিনা-ব্যভিচার অপরাধ সম্পর্কে কঠোর বাণীসমূহ উচ্চারিত হয়েছে। একটি হাদীসে এসেছে- “মহানবী (স) ইরশাদ করেছেন- বিবাহিত ব্যভিচারীকে সপ্ত আকাশ সাত তবক জমিনও অভিশাপ দিতে থাকে। জাহান্নামে তেমন ব্যভিচারীদের লজ্জাস্থান হতে এতো প্রচন্ডরকম দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকবে যে, তাতে অপরাপর জাহান্নামীরাও অতিরিক্ত পেরেশানীতে ‘মরার ওপর খাড়ার ঘা’ পরিস্থিতির শিকার হবে। জাহান্নামের কঠোর নরকাগ্নির পাশাপাশি যিনাকারীদের উক্ত আযাবের মাধ্যমে আরো অধিক অপমানিত করা হবে”। মুসনাদে বাযয়ার/হযরত বারীদা (রা) সূত্রে (তাফ্সীরে মাযহারী): মা’আরিফুল কুরআন-উরদু: মুফতী শফী (রহঃ), খ. ৫, পৃ. নং ৪৬৩, ৪৬৪, আত্তারগীর ওয়াত তারহীব : ৪র্থ খন্ড, ৩১৪ পৃ.।
অপর একটি হাদীসে রয়েছে : হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত; প্রিয়নবী (স) ইরশাদ করেছেন-
“যিনাকারীর যিনায় লিপ্তাবস্থায় ঈমান থেকে না; চুরি করা কালীন চোর ব্যক্তির ঈমান থাকে না এবং মদপান করা অবস্থায় মদ্যপ ব্যক্তির ঈমান থাকে না”। শায়খ ওলীউদ্দীনঃ মিশকাত: পৃ. ১৭, রেজা একাডেমী, মুম্বাই-৩।
সুনানে আবু দাউদ শরীফের হাদীসে শব্দগুলো এভাবে উদ্ধৃত হয়েছে-
“অর্থাৎ বান্দা যখন ব্যভিচারের মত অপরাধে লিপ্ত হয় তখন তার ঈমান তার থেকে বেরিয়ে যায় এবং তার মাথার ওপর ছায়ারূপে অবস্থান করতে থাকে। যখন সে উক্ত অপকর্ম শেষ করে তখন তার ঈমান পুনঃ যথাস্থানে অবস্থান নেয়”। প্রাগুক্তঃ কাবাইর অধ্যায়, পৃ. ১৮। (চলবে)

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
khairul alom ১৬ এপ্রিল, ২০২০, ১:২৩ পিএম says : 0
খুব সুন্দর হয়েছে ভবিষ্যতে আরো এরকম প্রবন্ধ থাকা প্রয়োজন মনে করছি তাহলে জাতির নাজাত প্রাপ্ত হতে পারে
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন