বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

থমকে গেছে জনজীবন

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২৮ মার্চ, ২০২০, ১২:০১ এএম

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে সারাদেশের জীবনযাত্রা। থমকে গেছে জনজীবন। কোথাও লোকজনের ভিড় নেই, চলাচলও নেই। বাস, নৌযান, কল-কারখানাসহ বন্ধ দোকানপাট। শহরে গ্রামে সমানতালে স্থবির হয়ে পড়েছে অর্থনীতি। আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো তথ্যে এ প্রতিবেদনÑ
আমাদের যশোর ব্যুরো প্রধান মিজানুর রহমান তোতা জানান, যশোর শহর ও উপজেলাগুলোর চিরচেনা রাস্তা যেন অচেনা হয়ে গেছে। গতকাল ৩টায় যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্র দড়াটানার দৃশ্য ধারণ করার সময় দেখা যায় রাস্তা একেবারেই ফাঁকা। শহরের নতুন খয়েরতলার আবু সেলিম বলেন, আমার ৪৫ বছর বয়সে দড়াটানার এমন দৃশ্য কখনো দেখিনি। জরুরি যেসব দোকানপাট বাজার খোলা রাখার কথা তারও অধিকাংশ বন্ধ। মানুষ আসলে ঘরবন্দি হয়ে পড়েছেন।
বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের বক্তব্য, করোনাভাইরাসের প্রভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। বিশেষ জরুরি প্রয়োজন ছাড়া টাকার লেনদেন নেই বললেই চলে। যেসব দোকানপাটে বেচাকেনা হচ্ছে সেখানে যে যার মতো মূল্য হাঁকছে। প্রশাসনের লোক গেলে মুহূর্তে ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। হয় বন্ধ নতুবা পণ্য নেই। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের দুর্গতি চরমে।
মণিরামপুর উপজেলার রঘুনাথপুর গ্রামের প্রকাশ মল্লিক সকাল আটটার দিকে বাজার করতে খেদাপাড়ায় যান। এসময় তার কাছে কাঁচা মরিচের পোয়া (২৫০ গ্রাম) ৪৫ টাকা ও আলু ২৫ টাকা কেজি চেয়েছেন বিক্রেতারা। তিনি বলেন, ‘বাজারে দোকান বসেছে কম। সব দোকানে ভিড়। এই সুযোগে ইচ্ছেমতো জিনিসের দাম হাঁকাচ্ছে দোকানদার। দাম বেশি হওয়ায় আমি বাজার না করেই চলে এসেছি।’ স্থানীয়রা বলেন, খেদাপাড়া বাজারে মরিচের দাম বেশি নেয়ার খবর পেয়ে পুলিশ এসে হারুন নামে এক দোকানদারকে পিটুনি দেয়। পরে ৬০ টাকা করে দাম নির্ধারণ করে দেয় পুলিশ।
রাজশাহী ব্যুরো প্রধান রেজাউল করিম রাজু জানান, রাজশাহী এখন ফাঁকা নগরী। সেনা, পুলিশের টহল সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মীদের তৎপরতা আর হাতে গোনা কয়েকটি অটোরিকশা আর রিকশা ছাড়া সব ফাঁকা। নেহায়েত প্রয়োজন ব্যতীত ঘরের বাইরে আসেননি মানুষ। বাজার, বিপণি বিতান, খাবার হোটেল সব বন্ধ। চারিদিকে যেন প্রান্তরের নীরবতা।
গতকাল জুমার নামাজের জন্য মুসল্লিরা ক্ষণিক সময়ের জন্য এসেছিলেন মসজিদে। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে সাহেব বাজার বড় মসজিদসহ বিভিন্ন মসজিদে নামাজের পূর্বে জীবানুনাশক ছিটানো হয়। মহল্লায় অনেক মসজিদে নামাজের পূর্বে এমন সতর্কতা ব্যবস্থা নেয়া হয়। নামাজে করোনাভাইরাসের গজব থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর দরবারে আকুতি জানানো হয়।
সরকারি ছুটি হওয়ায় মানুষ স্বেচ্ছা গৃহবন্দি হয়ে পড়েছে। অনেকদিন ধরে বাড়িতে জমে থাকা কাজগুলোয় হাত লাগাচ্ছে। কেউ টিভির সামনে বসে সময় পার করছে। করোনাভাইরাসের সর্বশেষ খবর জানার চেষ্টা করছে। স্থানীয় পত্রিকাগুলোর প্রকাশনা বন্ধ রয়েছে। আসছে না জাতীয় দৈনিকগুলো। ফলে সংবাদপত্র বিহীন সময় কাটাচ্ছে বিপুল সংখ্যক পাঠক। অনেকে পত্রিকা অফিসে ফোন করে জানতে চান কেন পত্রিকা পাওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে চৈত্র মাসের দাপট মধ্যভাগে এসে শুরু হয়েছে। গতকাল তাপমাত্রা উঠেছিল ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। সাথে ছিল গরম বাতাসের ঝাপটা। এই বিরুপ আবহাওয়া মানুষকে আরো ঘরবন্দি করেছে। সবার কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করোনাভাইরাসের ছোবল থেকে মুক্তি।
খুলনা ব্যুরো প্রধান আবু হেনা মুক্তি জানান, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে থমকে গেছে গোটা উপক‚লীয়াঞ্চল। প্রাণচঞ্চল বৃহত্তর খুলনাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো এখন ফাঁকা। করোনাভাইরাস মানুষের স্বস্তি কেড়ে নিয়েছে। বিষণœ মন নিয়ে গৃহবন্দি হয়ে পড়েছেন বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের মানুষ।
এদিকে দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর এ অঞ্চলের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মংলা থেকে ভারতগামী নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে। গত মঙ্গলবার বিকাল থেকে বাংলাদেশ-ভারত আন্তর্জাতিক নৌ-প্রটোকলভুক্ত মোংলা-ঘাষিয়াখালী অভ্যন্তরীণ চ্যানেল দিয়ে ভারতের কলকাতা, বজবজ ও হলদিয়া বন্দরগামী রুটে প্রায় ৩শ’ কার্গো ও কোস্টার জাহাজ চলাচল বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন। আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত এ নৌরুটে নৌযান চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে স্বাভাবিক রয়েছে মোংলা বন্দরে অবস্থানরত বিদেশি জাহাজের পণ্য বোঝাই-খালাস ও পরিবহন কাজে নিয়োজিত সকল নৌযানগুলো।
অপরদিকে, করোনা আতঙ্কে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে বিভাগীয় নগরী খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট। এখন পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত রোগীর সন্ধান না মিললেও বাড়তি সতর্কতায় থমকে গেছে জনজীবন। তবে দুর্ভোগে পড়েছে খেটে খাওয়া মানুষ। মার্কেট, বিপণি বিতান, শপিংমল বন্ধ। তবে কিছু দোকানপাট খোলা থাকলেও ক্রেতাশূন্য। কিছু রিকশা, মাহেন্দ্র ও ইজিবাইক চলছে। সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড থেকে ছাড়ছে না কোনো গাড়ি। ফাঁকা রেলস্টেশন ও লঞ্চঘাট।
মোংলা ইপিজেডের জেনারেল ম্যানেজার মাহবুবু আহম্মেদ সিদ্দিক জানান, ইপিজেডের অভ্যন্তরে ৮ থেকে ১০টি চীনা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এখানে কাজ করছেন অন্তত ৪০ থকে ৪৫ জন চীনা নাগরিক। আর তাদের এ সকল প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছে প্রায় সহস্রাধিক দেশিয় শ্রমিক।
তিনি জানান, এখানে অবস্থানকারী চীনা নাগরিকরা নিজেরাই নিয়মিত তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন। তবে নতুন করে তাদের নিজ দেশে যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া চীনা প্রতিষ্ঠানসমূহে কর্মরত শ্রমিকরা সচেতনতার সঙ্গে কাজ করছেন বলেও জানান তিনি।
এদিকে, ভারত সরকার সমগ্র ভারতজুড়ে লক ডাউন ঘোষণা করায় সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে গত বুধবার সকাল থেকে সকল প্রকার আমদানি-রফতানি কার্যক্রম কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। তবে আগে থেকে আটকে থাকা বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী যাত্রীরা যারা ভারত রয়েছেন তারা দেশে ফিরতে পারছেন।
ভোমরা শুল্ক স্টেশনের সহকারী কমিশনার রেজাউল করিম জানান, ভারত জুড়ে লক ডাউনের কারণে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম কার্যত বন্ধ থাকলেও ভোমরা শুল্ক স্টেশন সীমিত আকারে খোলা রয়েছে এবং অফিসিয়াল কার্যক্রমও চলছে।
সিলেট ব্যুরো প্রধান ফয়সাল আমীন জানান, অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে পূণ্যভ‚মি সিলেট। প্রবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল সিলেট শুরু থেকেই ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। সরকারি তথ্যমতে গত দেড় মাসে বিভিন্ন দেশ থেকে সিলেটে এসেছেন প্রায় ৩০ হাজার প্রবাসী।
সিলেটের বিশ্বনাথ, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের জন্নাথপুর উপজেলার বেশিরভাগ মানুষই প্রবাসী। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বিশ্বনাথ ও জগন্নাথপুর। এ দুটি উপজেলার প্রতিটি ঘরেই রয়েছেন প্রবাসী। এদের বেশিরভাগ যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। ইতোমধ্যে জগন্নাথপুর উপজেলা লকডাউন করা হলেও বিশ্বনাথ রয়েছে সরকারি নির্দেশের অনুক‚লে।
করোনাভাইরাসের আক্রমণ শুরুর পরও সিলেটে প্রবাসীদের আগমন ঠেকানো যাচ্ছে না। গত বৃহস্পতিবারও ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেষ্টার থেকে সিলেটে এসেছেন ৩৬ প্রবাসী। তাদের মধ্যে দুজনের শরীরে তাপমাত্রা বেশি থাকায় তাদেরকে শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের আইসোলেশন সেন্টারে রাখা হয়েছে। বাকিদের প্রশাসনের তত্ত¡াবধানে পাঠানো হয়েছে হোম কোয়ারাইন্টেনে। পূর্বে আসা প্রবাসীরা হোম কোয়ারেন্টাইন না মানলেও গত ১৫ দিন থেকে যারাই আসছেন তারা চলে যাচ্ছেন হোম কোয়ারেন্টাইনে। বাইরে থাকা প্রবাসীদের হোম কোয়ারেন্টাইনে যেতে এখনো অভিযান চালাচ্ছে প্রশাসন।
এদিকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে সারাদেশের ন্যায় সিলেটেও গণপরিবহন ও দোকানপাঠ বন্ধ রয়েছে। ফলে সুনসান নীরবতা সর্বত্র। হরতাল অবরোধেও এমন চিত্র দেখেনি সিলেটবাসী। মাজার এলাকা সবসময় থাকে লোকে লোকারণ্য। অথচ গতকাল বেলা ৩টায় মাজার এলাকায় গিয়ে একজন মানুষেরও দেখা মেলেনি। একই অবস্থা নগরীর ব্যস্ততম এলাকা জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার, চৌহাট্টা ও আম্বরখানার। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউই বাইরে বের হচ্ছেন না। রাস্তায় কেবল পুলিশের গাড়ি আর মাঝেমধ্যে কিছু রিকশার দেখা মিলছে।
বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরে দেখা যায়, পুরো নগরী নিরব-নিস্তব্ধ। সিলেট স্টেশন থেকে ছেড়ে যাচ্ছে না কোনো ট্রেন, বাস টার্মিনালে ঠায় দাঁড়ানো বাসের সারি। বন্ধ সব ধরণের গণপরিবহন। সংক্রমণ রোধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে গণপরিবহন বন্ধ রয়েছে। সিলেট-ঢাকা মহাসড়কে প্রাইভেটকার, অটোরিকশা, মোটরসাইকেল ছাড়া রাস্তায় কোনো গণপরিবহন দেখা যাচ্ছে না। তবে জরুরি সেবার কিছু যান চলাচল করছে। নগরীর বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবস্থান নিয়েছে। একসঙ্গে একাধিকজন দেখলে সচেতন করে দেয়া হচ্ছে। সেই সাথে মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকার দেখলেই থামাচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা, জিজ্ঞাসাবাদ করছেন তাদের, পরামর্শ দিচ্ছেন ঘরে থাকার।
এদিকে, করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক নিয়ে সিলেটসহ পুরো দেশে নতুন এক গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। ‘লং, সাদা এলাচ আর আদা পানিতে সিদ্ধ করে খেলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবে না’ এমন গুজবটি গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ছড়িয়ে পড়ে দেশের প্রায় প্রতি জেলায়। এছাড়াও বৃহস্পতিবার দিবাগত মধ্যরাতে সিলেট বিভাগের কয়েকটি এলাকায় ‘করোনাভাইরাসের কারণে ভ‚মিকম্প হচ্ছে’ এমন গুজব রটানো হয়। এমন গুজবে বিভ্রান্ত হয়ে সিলেটের বিভিন্ন স্থানে রাত ১০টার পর থেকে রাত ১টা পর্যন্ত আজান দিতে থাকেন স্থানীয়রা। তারপরই শুরু হয় আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মিছিল। এসব প্রতিরোধে সিলেটে মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনী। কোথাও এমন কর্মকাÐ হতে দেখলে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে তারা এমনটা জানিয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম বলেন, কোন ধরনের গুজব সহ্য করা হবে না। যারাই এসব করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি (মিডিয়া) জেদান আল মুসা বলেন, মানুষকে সচেতন করতে পুলিশ মাঠে কাজ করছে। মাইকিং করে দিক নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। নানা রকম প্রচারণা চালানো হচ্ছে। আমরা যেকোন মূল্যে সরকারি নির্দেশনার আলোকে নগরবাসীকে বাসায় রাখতে চাই। এ জন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
*হতদরিদ্র দীনমজুর কহে* ২৮ মার্চ, ২০২০, ১১:২৩ এএম says : 0
থমকে গেছে জীবন জীবিকা।গত ১৮ই মার্চ খবর এলো বিবাহ অনুষ্ঠান বন্ধ।তাই ডেকোরেটরের সব অনুষ্ঠান বন্ধ থাকার দরুন একেবারেই কর্মহীন হয়ে পড়েছি।জানিনা কবে আবার কর্ম খূজেঁ পাবো।এভাবে চলতে থাকলে সাংসারে দেখা দেবে খূধার মাতম।হে আল্লাহ তুমি রহমাত দান করো।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন