বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সঙ্কট মোকাবেলায় প্রণোদনা বাড়াতে হবে

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ২৯ মার্চ, ২০২০, ১২:০৪ এএম

প্রাণঘাতী করোনার সংক্রমণ এখনই যদি বন্ধ হয়, তবুও এ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তা কাটাতে সময় লাগবে কয়েক বছর। কিন্তু এই মরণ ব্যাধি এখনই বন্ধ হচ্ছে না। কারণ, কোথাও কোথাও দ্বিতীয়বার শুরু হয়েছে। এ ব্যাপারে হু’র নির্বাহী পরিচালকের অভিমত: যেসব এলাকা লকডাউন করে দেয়া হচ্ছে, সেগুলোতে চিরদিন লকডাউন থাকবে না। যখন লকডাউন তুলে দেয়া হবে, তখন সেই কমিউনিটিতে সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। ভ্যাকসিন বাজারে আসতে অন্তত এক বছর সময় লাগতে পারে। তাই এই অদৃশ্য ভয়ানক শক্তির ছোবল কখন বন্ধ হবে তা নিশ্চিত নয়। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব পদার্থবিদ ও নোবেলজয়ী মাইকেল লেভিট ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, ‘নতুন করোনাভাইরাস শিগগিরই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।’ কিন্তু তার কথায় কেউই আশ্বস্ত হতে পারছে না। ফলে মানুষের মনে স্প্যানিশ ফ্লুর কথা মনে পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের তথ্য মতে, ‘স্প্যানিশ ফ্লুতে ১৯১৮-১৯১৯ সময়ে বিশ্বে প্রায় ৫০ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল। আর মারা গিয়েছিল ৫ কোটি মানুষ।’ যা’হোক, করোনার কারণে বিশ্বে ভয়াবহ মন্দা সৃষ্টি হচ্ছে বলে বিশ্বনেতা ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদগণ মন্তব্য করেছেন। গত ১৯ মার্চ জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, ‘আমরা আজ এমন এক নজিরবিহীন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি, যখন সাধারণ কৌশল কোনো কাজে আসবে না। আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে এক বিশ্বমন্দা, যার মাত্রা হয়তো অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে।’ মরগান স্ট্যানলির অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন, ‘বিশ্বব্যাপী মন্দা এখন বেজ কেস হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলতি বছর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি কমে ০.৯% হতে পারে।’ গোল্ডম্যান স্যাকসের অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, চলতি বছর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি হার ১.২৫% হতে পারে এবং এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ০.৪% থেকে ১.২% ও চাকরি হারাতে পারে এক কোটি লোক। এসঅ্যান্ডপি গ্লােবাল বলেছে, ‘চলতি বছর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ১% থেকে ১.৫% হতে পারে।’ ওইসিডি বলেছে, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে অর্থনৈতিক যে ক্ষতি হবে, সেখান থেকে পুনরুদ্ধার পেতে বিশ্বের কয়েক বছর সময় লেগে যাবে। উপরন্তু সংস্থাটির মহাসচিব অ্যাঙ্গেল গরিয়া এক খোলা চিঠিতে করোনা সংকটকে বর্তমান শতকের ‘সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামাজিক আঘাত’ বলে উল্লেখ করে বলেছেন, এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। আইএমএফ প্রধান জর্জিয়েভা গত ২৩ মার্চ বলেছেন, ‘করোনা মহামারীতে বৈশ্বিক অর্থনীতি চরম ক্ষতির সম্মুখীন। এ ক্ষতির পরিমাণ ২০০৯ সালের চেয়ে বেশি হতে পারে। এটি সামাল দিতে প্রয়োজন নজিরবিহীন পদক্ষেপ।’ গত ১৯ মার্চ প্রকাশিত আইএলওর প্রাথমিক মূল্যায়নে বলা হয়েছে, ‘বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯-এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। বেকারত্ব, কর্মসংস্থান ও কাজের দারিদ্র্যের সংকট মোকাবেলায় প্রয়োজন জরুরি ভিত্তিতে সমন্বিত তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী বেকার জনগোষ্ঠির সংখ্যা ছিল ১৮.৮০ কোটি। করোনার প্রভাব বৈশ্বিক জিডিপিতে পড়তে শুরু করেছে। সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক ও শ্রম সংকটে নতুন করে যুক্ত হতে পারে আরও আড়াই কোটি মানুষের বেকারত্ব।’
এই অবস্থায় বিশ্ববাসীর মনে ব্যাপক ‘মন্দাভীতি’ সৃষ্টি হয়েছে। তাই এই সংকট মোকাবেলার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা ও দেশ বিপুল অংকের আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। যেমন: এডিবির প্রেসিডেন্ট গত ১৮ মার্চ বলেছেন, ‘এ মহামারী বড় ধরনের বৈশ্বিক সংকটে পরিণত হয়েছে। এজন্য জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে জোরালো পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। আমাদের সদস্য ও সহযোগী সংস্থার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সদস্য দেশগুলোর তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটাতে আমরা ৬৫০ কোটি ডলারের উদ্ধার তহবিল ঘোষণা করছি। তবে এ প্যাকেজের বাইরে পরিস্থিতি যখনই চাইবে তখনই আর্থিক ও নীতি সহায়তা দিতে এডিবি প্রস্তুত থাকবে।’ আইএমএফ প্রায় ৫ হাজার কোটি ডলারের তহবিল ঘোষণা করেছে। পরবর্তীতে সংস্থাটির প্রধান গত ২৩ মার্চ বলেছেন, ‘আইএমএফ তাদের ১ লাখ কোটি ডলারের সবটুকুই ঋণ দিতে প্রস্তুত।’ বিশ্বব্যাংক গ্রুপ ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত ১৮ মার্চ সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, ‘আমি নিজেকে যুদ্ধকালীন প্রেসিডেন্ট মনে করছি। কারণ আমরা সবাই অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে এই লড়াই করছি। করোনার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে আর্থিক মন্দা ঠেকাতে ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ দেওয়ার পরিকল্পনাও ঘোষণা করছি।’ পরবর্তীতে গত ২৫ মার্চ প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার বৃদ্ধির প্রস্তাব পাশ হয়েছে কংগ্রেস ও সিনেটে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো গত ১৮ মার্চ দেশটির নাগরিক ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ৮ হাজার ২০০ কোটি ডলারের প্যাকেজ পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন, যা গত ২৫ মার্চ পার্লামেন্টে পাশ হয়েছে। যুক্তরাজ্য ৩ হাজার কোটি পাউন্ডের করোনাভাইরাস বেইলআউট কার্যক্রমের প্রধান সুবিধাভোগী হিসেবে চিহ্নিত করেছে শ্রমিকদের। দেশটির সরকার এরই মধ্যে শ্রমিকদের মাসিক বেতনের ৮০% বহনের ভার নিয়েছে। এতে করে উৎপাদন বন্ধ হয়ে পড়লেও শ্রমিকরা যাতে চাকরিচ্যুত না হন, সে বিষয়টি নিশ্চিত করার পাশাপাশি শিল্প মালিকদেরও দেউলিয়াত্বের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে। এছাড়া সমাজের সবচেয়ে নাজুক অংশটির সুরক্ষার জন্যও ৭০০ কোটি পাউন্ডের তহবিল রাখা হয়েছে।সাড়ে ৪ হাজার কোটি ইউরোর সহায়তা প্যাকেজের ঘোষণা দিয়েছে ফ্রান্স। ইউরোপীয় জোনে ৭.৫ বিলিয়ন ইউরোর প্যাকেজ ঘোষণা করেছে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া, জার্মান সরকার ১১০ কোটি ডলার, স্পেন ২১,৯০০ কোটি ডলার, অস্ট্রেলিয়া ১১০০ কোটি ডলার, পর্তুগাল ১ হাজার কোটি ডলার সহায়তার ঘোষণা করেছে। কাতার ঋণের কিস্তি পরিশোধ ৬ মাসের জন্য স্থগিত এবং ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় খাতগুলোর জন্য ২ হাজার ৩৩৫ কোটি ডলার বরাদ্দ করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদীর উদ্যোগে গত ১৫ মার্চ সার্কভুক্ত দেশগুলোর নেতা এবং তাদের প্রতিনিধিদের এক ভিডিও কনফারেন্সে সার্ক কভিড-১৯ ফান্ড গঠন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তাতে বাংলাদেশ ১৫ লাখ ডলার, নেপাল ১০ কোটি নেপালি রুপি, আফগানিস্তান ১০ লাখ ডলার, মালদ্বীপ ২ লাখ ডলার, ভুটান ১ লাখ ডলার এবং ভারত এক কোটি মার্কিন ডলার সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়া, বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার অনেক হ্রাস করেছে। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে: যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইত্যাদি। এভাবে প্রণোদনার ঘোষণা আরও বাড়বে। কারণ, চলতি বিশ্বমন্দা কাটিয়ে উঠার আর কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশও করোনা সৃষ্ট সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ও হচ্ছে। আইএলও বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর পৌতিয়াইনেন বলেছেন, ‘বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের ক্রয়াদেশ এরই মধ্যে কমতে শুরু করেছে। স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তো রয়েছেই। এ ভাইরাস একই সঙ্গে প্রায় ৪৫ লাখ শ্রমিকের অর্থনৈতিক অবস্থা ও জীবনযাত্রায়ও প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বিশাল অনানুষ্ঠানিক খাতকে ভুলে গেলে চলবে না। স্থবির হয়ে গেছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের কর্মকান্ড। বয়স্ক কর্মীদের স্বাস্থ্যের পাশাপাশি রয়েছে ছাঁটাই হওয়ার ভয়। অন্যদের জন্যও কর্মক্ষেত্র হয়ে উঠছে সংকুচিত।’ সিপিডি গত ২১ মার্চ বলেছে, ‘আমদানি, রপ্তানি, রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব এবং পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে মন্দার কবলে পড়বে অর্থনীতি। এতে মানুষের আয় কমবে। বেকার হবে অনেকেই। সামগ্রিকভাবে রাজস্ব আদায়ে চলমান নেতিবাচক অবস্থাকে আরও প্রভাবিত করবে। এতে বছর শেষে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।’ ইতোমধ্যেই গত ২৫ মার্চ পর্যন্ত ৯৩৬টি গার্মেন্ট কারখানার ২৫৮ কোটি ডলারের বেশি মূল্যের অর্ডার বাতিল ও স্থগিত হয়েছে। ১৯.২০ লাখ শ্রমিক এসব কারখানায় কাজ করে।এভাবে অর্ডার বাতিল চলতেই থাকবে, যতদিন করোনা সংকট দূর না হয়। ফলে সব গার্মেন্ট বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এখনই নিট খাতের সব কারখানা ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপিল পর্যন্ত বন্ধ রাখার অনুরোধ করেছেন বিকেএমইএ সভাপতি। এই অবস্থায় সমগ্র গার্মেন্ট সেক্টরের লোকজনের মধ্যে চাকুরিচ্যূতির আতংক সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য বিজিএমইএ’র সভাপতি ড. রুবানা হক বলেছেন, ‘শ্রমিকরা সময় মতো বেতন পাবেন।’ করোনা পরিস্থিতির কারণে কেউ সাময়িকভাবে গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ কিংবা শ্রমিক-কর্মচারীদের ছুটি দিতে চাইলে সংশ্লিষ্ট আইনের বিধিবিধান মেনে করতে হবে। অপরদিকে, সব যোগাযোগ খাত ও বাজার বন্ধ হয়ে শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে পড়েছে। আইসিসি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের কারণে প্রান্তিক এবং উদীয়মান অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে। বিশেষত বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং রেমিট্যান্স আয় কমে যেতে পারে।’ এডিবি বলেছে, করোনার কারণে বাংলাদেশে জিডিপির ১.১% এর সমান ক্ষতি হতে পারে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, পুরো বিশ্ব স¤প্রদায় এখন একটি ক্রান্তিকাল পার করছে। বাংলাদেশও এর প্রভাব অনুভব করতে শুরু করেছে। সংকটটি আমাদের অর্থনীতিকে বহুমাত্রিক দিক থেকে আঘাত করতে পারে। গত ২৫ মার্চ বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সঙ্গে করোনা পরিস্থিতি এবং সহযোগিতা নিয়ে ভিডিও কনফারেন্সে এসব কথা বলেন তিনি। অপরদিকে অনেক বিশেষজ্ঞের অভিমত: করোনার কারণে দেশ-বিদেশের বড় ব্যবসায়ীরা লুজার হয়েছে। তাই তারা বাংলাদেশে কয়েক বছর তেমন বিনিয়োগ করতে পারবে না।
দেশের আর্থিক সংকট যতই হোক, তা মোকাবেলা করতে হবে। নতুবা উন্নয়নের ধারা নস্যাৎ হয়ে যাবে, যা দেশবাসীর কাম্য নয়। তাই চলতি আর্থিক সংকট মোকাবেলার জন্য দরকার সব ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় প্রণোদনা। সরকারও বিষয়টি অনুধাবন করেছে। তাই অনেক ক্ষেত্রে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। গত ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘করোনার কারণে অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন, তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। নিম্নআয়ের ব্যক্তিদের ঘরে-ফেরা কর্মসূচির আওতায় নিজ নিজ গ্রামে সহায়তা, গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য বিনামূল্যে ঘর, ছয় মাসের খাদ্য এবং নগদ অর্থ দেওয়া হবে। ভাসানচরে এক লাখ মানুষের থাকা ও কর্মসংস্থান উপযোগী আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে কেউ যেতে চাইলে সরকার ব্যবস্থা নেবে। বিনামূল্যে ভিজিডি, ভিজিএফ ও ১০ টাকা কেজি দরে চাল সরবরাহ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। একইভাবে বিনামূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসা সেবাও দেওয়া হচ্ছে।রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য আমি ৫ হাজার কোটি টাকার একটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করছি। এ তহবিলের অর্থ দ্বারা কেবল শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা যাবে। এছাড়া, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সার্ক্যুলারের মাধ্যমে ঘোষণা করেছে, আগামী জুন পর্যন্ত কোনও ঋণগ্রহীতা ঋণ শোধ না করলেও ঋণের শ্রেণিমানে কোনও পরিবর্তন আনা যাবে না। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ও ওষুধ ক্রয়ের ক্ষেত্রে ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবার ক্ষেত্রে কোনও মাশুল দিতে হবে না। জরুরি কেনাকাটায় লেনদেন সীমাও বাড়ানো হয়েছে। রেপো রেট ৬ থেকে ৫.৭৫ শতাংশে ও সিআরআর ০.৫% কমিয়েছে। অন্যদিকে, দেশের যেসব এনজিও থেকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ঋণ নিয়ে ব্যবসা করছেন, আগামী জুন পর্যন্ত ঋণের কিস্তি দিতে না পারলে তাদের খেলাপি করা যাবে না বলে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি সার্কুলার জারি করেছে। আগামী মে মাস পর্যন্ত গ্যাসের বিল এবং এপ্রিল পর্যন্ত বিদ্যুতের বিল দেরিতে পরিশোধ করা হলেও বিলম্ব জরিমানা দিতে হবে না গ্রাহকদের বলে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং বিদ্যুৎ বিভাগ পৃথক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে। এর আগে ব্যাংকের সুদ ৯-৬ কার্যকর করা হয়েছে। কিন্তু এসব করে ক্ষান্ত হলেই চলবে না। নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের আয় বৃদ্ধির জন্য প্রণোদনা হিসাবে সামাজিক বেষ্টনীগুলোর আওতা বাড়াতে হবে এবং এর সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। সব সঞ্চয় পত্রের মুনাফা এক ও অভিন্ন করতে হবে।অর্থাৎ ডাকঘর সঞ্চয় ও সঞ্চয় অধিদপ্তরের আওতার সঞ্চয়ের মুনাফা সমান করতে হবে। এছাড়া, বিলাসী পণ্য আমদানি বন্ধ, নিত্যপণ্যের আমদানি শুল্ক স্থগিত, সব রকমের অউৎপাদনশীল খাতে ব্যয়,দুর্নীতি-অপচয় ও অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে। পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে হবে।আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করতে হবে সংকট মোকাবেলাকে লক্ষ্য করে। পণ্যমূল্য বৃদ্ধি কঠোরভাবে দমন,টিসিবির মাধ্যমে সারাদেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে নিত্যপণ্য স্বল্প মূল্যে সরবরাহ, ব্যাপক হারে ওএমএস চালু করতে হবে। এছাড়া, কাবিখা ইত্যাদি এবং রাস্তাসমূহের সংস্কার কাজ শুরু করতে হবে। তাহলে অনেক দরিদ্র মানুষের কর্ম সৃষ্টি হবে। তেমনি গৃহ নির্মাণ ঋণ ব্যাপক হারে প্রদান করা হলে বহু নির্মাণ শ্রমিকের কাজ সৃষ্টি হবে। অর্থাৎ ব্যাপক হারে কাজ সৃষ্টি করতে হবে দেশে। কারণ, এই সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে শ্রমিক ও দরিদ্ররা। তাদের কর্ম প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তাই তাদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে দেশে প্রায় তিন কোটি মানুষ দরিদ্র ও চরম দরিদদ্র রয়েছে। যারা দিন আনে দিন খায়। এদেরকে রক্ষা করতে হবে প্রয়োজনীয় সহায়তার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের উদ্যোগ স্মরণীয়। পশ্চিমবঙ্গে আগামী ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রেশনে দুই রুপি দরে চাল বিক্রি করা হবে বলে জানিয়েছেন রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী। একই সঙ্গে রেশনে বিনা মূল্যে আটাও দেওয়া হবে বলে গত ২০ মার্চ ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। করোনাভাইরাসের কারণে পশ্চিমবঙ্গের কোনও মানুষ যেন অভুক্ত না থাকে তার জন্য এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন তিনি। আমাদের দেশেও ন্যায্যমূল্যের খাদ্য দ্রব্যের মূল্য আপাতত অর্ধেক এবং ভিজিডি ও ভিজিএফ’র পরিধি বৃদ্ধি করা যেতে পারে। তাহলে মানুষের অনেক কল্যাণ হবে। উল্লেখ্য যে, দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে তথা সরকারি-বেসরকারি মিলে প্রায় ১৯ লাখ মে.ট. খাদ্য মজুদ আছে বলে জানা গেছে। উপরন্তু আগামী এক মাসের মধ্যে নতুন করে বোরো ও ইরি ধান কাটা শুরু হবে। তাই খাদ্যের অভাব হবে না। সমস্যা শুধু মূল্য নিয়ে। তাই মূল্য কমানো আবশ্যক। অপরদিকে, সব ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ওয়ান স্টপ সিস্টেম চালু, উৎপাদনশীল সব খাতে সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। অন্যদিকে, কৃষি ও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোন্নয়নে এবং আইটি খাতের উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। ঘোষিত প্রণোদনা এবং সুবিধাসমূহ যেন সঠিকভাবে ব্যবহার হয়, কোনো প্রকার যেন অনিয়ম-দুর্নীতি-দলীয়করণ ইত্যাদি না হয়,সেদিকে কড়া নজর রাখা দরকার। সেবাখাতসমূহে ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধি এবং এডিপির অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দেওয়া প্রয়োজন। সর্বোপরি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর ঋণ-অনুদান সমন্বিতভাবে ব্যবহার করা দরকার। ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাংক ১০ কোটি ডলার, আইএমএফ ৭৫ কোটি ডলার এবং এডিবির ১০ কোটি ডলারের ঋণ নিশ্চিত হয়েছে বলে জানা গেছে। এভাবে আরও সহায়তা আসতে পারে। সব সহায়তা সমন্বিত ও সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া, সব সরকারি শূন্য পদে অবিলম্বে নিরপেক্ষভাবে নিয়োগ দেওয়া হলে সংশ্লিষ্ট পরিবার রক্ষা পাবে। অন্যদিকে, মানুষের সব ধরনের চিকিৎসায় যেন কোনো প্রকার ত্রুটি না হয়, সেদিকে কড়া নজর রাখা দরকার। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, চিকিৎসা ব্যবস্থা শুধুমাত্র করোনাভিত্তিক হয়ে পড়েছে। কিন্তু এই বাইরে তো বিপুল সংখ্যক মানুষ নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত যাদের চিকিৎসা জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন