শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বিশেষজ্ঞদের অভিমত ‘পরীক্ষা’ ছাড়া সঠিক চিত্র আসছে না

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ২৯ মার্চ, ২০২০, ১২:০১ এএম

ব্যবহার করা হচ্ছে না সক্ষমতাসম্পন্ন বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে : গড়ে প্রতিদিন মাত্র ৫১টি পরীক্ষা হচ্ছে
সারাবিশ্বে আতঙ্কের নাম মরণঘাতি করোনাভাইরাস। গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম তিন জনের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। এর পর ইতোমধ্যে ২১ দিন চলে গেছে। ১৭ কোটি লোকের বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত সন্দেহে পরীক্ষা করা হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৬৮ জনের। প্রতিদিন গড়ে মাত্র ৫১ জনের পরীক্ষা করেছে বাংলাদেশ। অথচ ডবিøউএইচও জানিয়ে দিয়েছে, করোনা থেকে বাঁচার একমাত্র পথ ‘পরীক্ষা, পরীক্ষা, পরীক্ষা’। একই কথা বলছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরাও। অথচ করোনাভাইরাস সংক্রমন রোধে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টিতে অঘোষিত লকডাউন করা হলেও পরীক্ষার পর্যাপ্ত প্রস্তুতি চোখে পড়ছে না।

আইইডিসিআর’র সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আইইডিসিআর ও চট্টগ্রামের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকসাস ডিজিজে (বিআইটিআইডি) মিলে গত ২৪ ঘন্টায় মাত্র ৫০টি পরীক্ষা করেছে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডবিøউএইচও) থেকে শুরু করে দেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা দ্রæত রোগী সনাক্তের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। একই সঙ্গে তাগিদ দিয়েছেন ল্যাবরেটরি বাড়ানোর। কিন্তু কোনভাবেই বাড়ছে না পরীক্ষার হার। তাই তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের শনাক্তের পরীক্ষা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ যেন পরীক্ষার ব্যাপারে অনেকটা উদাসীন। আর তাই করোনা সনাক্তের পরীক্ষা না হওয়ায় দেশে এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সঠিক তথ্য উঠে আসছেনা বলেও মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি মানুষের মধ্যে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন তারা। এমনকি সক্ষমতা সম্পন্ন বেসরকারি হাসপাতালগুলোকেও দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে না করোনা রোগীদের সেবা এবং পরীক্ষার জন্য। এদিকে আইইডিসিআর’র তথ্য মতে, এ পর্যন্ত ৪ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। অনেক চিকিৎসকই ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) ছাড়াই ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। অথচ চিকিৎসকদেরও করোনা সনাক্তকরণ পরীক্ষা করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক চিকিৎসক।

সূত্র মতে, প্রতিদিন ২০ হাজারের মতো করোনাভাইরাস সনাক্তের পরীক্ষা করে বিশ্বে রোলমডেল হিসেবে সীকৃতি পেয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। আর এ কারণে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হারের দিক দিয়েও অনেক নিচের দিকে এই দেশটি। অথচ বাংলাদেশে একদিনে সর্বোচ্চ গত বুধবার ১২৬ টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।

আইইডিসিআর পরিচালক প্রফেসর ডা. সেব্রিনা ফ্লোরা গতকাল জানান, গত ২৪ ঘন্টায় আইইডিসিআরে করোনা সংক্রান্ত ৩ হাজার ৪৫০টি কল এসেছে। এদের মধ্যে মাত্র ৪২ জনের পরীক্ষা করেছে আইইডিসিআর। তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ৮২ জনের মধ্যে একজনকে পরীক্ষা করা হয়েছে। এছাড়াও এই ভাইরাসের লক্ষণ নিয়ে দেশে হাজার হাজার রোগী আছেন যারা কল করতে পারেননি। বা আইইডিসিআরে যোগাযোগ করতে পারেননি। তাই দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের সঠিক তথ্য আসছে না বলে মত দিয়েছেন অনেকই।

এদিকে দেশে করোনায় ইতোমধ্যে ৪৮ জন রোগী সনাক্ত হলেও এখনও প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ নেওয়া হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য তথ্য ইউনিটের পরিচালক ডা. মোহাম্মাদ হাবিবুর রহমান গতকালও বলেছেন, ৬৪টি জেলা ও ৬১টি উপজেলায় সব ধরনের ল্যাব টেকনিশিয়ানদের প্রশিক্ষণ দেওয়ানো হচ্ছে। ঢাকায় আইইডিসিআর ছাড়াও আইপিএস, আইসিডিডিআরবি, শিশু হাসপাতাল প্রস্তুত করা হয়েছে। শিগগিরই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, আর্মড ফোর্সেস ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজি, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে পিসিআর ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হবে। ঢাকার বাইরে প্রত্যেকটি বিভাগে পিসিআর টেস্ট স¤প্রসারণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের বিআইটিআইডিতে নমুনা পরীক্ষা করা শুরু হয়েছে। রংপুর ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজে পিসিআর মেশিন বসানোর কাজ চলছে। এ ছাড়া, গতকাল ময়মনসিংহে অভিজ্ঞদের পাঠিয়েছি। তারা সেখানে পিসিআর মেশিন স্থাপনকাজের তদারকি করছেন। আগামী ৭-১০ দিনের মধ্যে অন্য বিভাগগুলোতেও পিসিআর টেস্ট হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

হাবিবুর রহমান বলেন, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে অতিরিক্ত ১৬টি ভেন্টিলেটর বসানো হয়েছে। শেখ রাসেল ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডায়জেস্টিভ ডিজিসেস, সেখানেও আটটি ভেন্টিলেটর বসানোর কাজ চলছে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, করোনা প্রতিরোধের প্রস্তুতি হিসেবে বাড়ছে নমুনা সংগ্রহের পরিসর। সব কার্যক্রমের সফলতা নির্ভর করবে, সাধারণ মানুষ কতটুকু স্বাস্থ্য সতর্কতা পালন করছে, তার ওপর। এ থেকেই বুঝা যায়, গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনের উহান থেকে শুরু হওয়া এ মহামারী রোধে বাংলাদেশের এতাদিনের প্রস্তুতি।

অপরদিকে রাজধানীর সক্ষমতাসম্পন্ন বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করলে জানানো হয়, তাদেরকে সরকার থেকে করোনা রোগীদের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। তবে কেউ কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগ থেকে আইসোলেশন ইউনিট, টেলি-মেডিসিন সেবাসহ বিভিন্ন কাজ করছেন বলে উল্লেখ করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ডা. কামরুল হাসান খান ইনকিলাবকে বলেন, প্রতিদিনই পরীক্ষা বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। কারণ লাখ লাখ মানুষ বিদেশ থেকে এসেছেন। তাদের পরীক্ষা না করালে সঠিক চিত্রটা উঠে আসবে না। সংক্রমণের সঠিক সোর্সও চিহ্নিত হবে না। প্রফেসর ডা. কামরুল হাসান বলেন, আইইডিসিআর দায়সারাভাবে কাজ করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বার বার পরীক্ষা বাড়ানোর কথা বললেও কর্ণপাত করছেনা তারা।

প্রফেসর ডা. কামরুল হাসান বলেন, করোনার চেয়ে বড় সঙ্কট আর হতে পারে না। করোনা মোকাবেলায় আমাদেরকে সমস্ত সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। সরকারি অন্যান্য হাসপাতালের পাশাপাশি আইসিডিডিআর’বিসহ বেসরকারি এ্যাপোলো, ইউনাইটেড, স্কয়ার, বিআরবি, সমরিতা, স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ইসলামী ব্যাংক হাসাপাতালসহ যাদের সক্ষমতা আছে তাদেরকে এক্ষেত্রে কাজে লাগানো যেত পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন সাবেক ভিসি প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম আশঙ্কা প্রকাশ করে ইনকিলাবকে বলেন, কয়েক লাখ বিদেশ ফেরত দেশের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে পড়েছে যা আমাদের জন্য অত্যন্ত হুমকির। তাই অবশ্যই আমাদেরকে পরীক্ষা বাড়ানোয় জোড় দিতে হবে। তিনি বলেন, করোনার টেস্ট ঠিকমতো না করতে পারলে করোনা নিয়ে কারো কথা বলাই উচিত নয়। একই সঙ্গে টেস্ট না করে তারা (আইইডিসিআর) কী করে বলে, রোগী সংখ্যার কথা? আইইডিসিআরে যেসব ফোন কল যায়, তার মধ্যে থেকে নমুনা শুনে বিশ্লেষণ করে টেস্ট করে, কিন্তু যারা কল করেন না তাদের কী করবে না?

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়া থেকে বৈশ্বিক মহামারিতে রূপ নেওয়া পর্যন্ত আইইডিসিআর একটানা মিথ্যাচার করে আসছে। কর্তৃত্ব ধরে রাখতে গিয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কোভিড-১৯-এর পরীক্ষা করার ব্যবস্থা থাকার পরও সেসব জায়গায় পিসিআর করতে দিচ্ছে না। এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ টেস্টিং উল্লেখ করেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান সাইফুল্লাহ মুন্সি বলেন, বিদেশ ফেরত প্রবাসী বাংলাদেশীরা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই নমুনা পরীক্ষার হার বাড়ানোর কথা বলেন তিনি।

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন