করোনাভাইরাস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত আসা প্রবাসীদের অধিকাংশই হোম কোয়ারেন্টাইন মানছে না। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার জন্য যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তাও অনেকে মানছে না। করোনা প্রতিরোধে এ দুটি উদ্যোগ অত্যন্ত ফলপ্রসূ বলে প্রমাণিত হলেও আমাদের দেশে এর অমান্যতা ও লংঘন সঙ্গত কারণেই ব্যাপক উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করেছে। দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত এক খবরে জানানো হয়েছে, এক মাসে ৬ লাখের বেশি প্রবাসী এসেছে। সারাদেশে তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। এখন এদের অধিকাংশেরই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্য মতে, মার্চ মাসে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ১ হাজার ২৪০ জন বিদেশ থেকে ফেরত এসেছে। তাদের মধ্যে ৫৯২ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে নেয়া হয়েছে। বাকী ৬৪৮ জনের কোনো পাত্তা নেই। এটা শুধু ঢাকা দক্ষিণ সিটির চিত্র নয়, সারাদেশেরই চিত্র। ওদিকে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা নিশ্চিত করতে ঢাকা থেকে গ্রামে যাওয়াদের ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শ দেয়া হলেও প্রায় কেউই এটা মানছেনা। তারা প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা ও মেলামেশা করছে, আড্ডা দিচ্ছে, হোটেল রেস্তোরায় বসে গল্পগুজব করছে। তাদের এই যথেচ্ছাচার ও স্বেচ্ছাচার করোনাভাইরাস ব্যাপক আকারে সংক্রমিত হওয়ার আশংকা বাড়িয়ে দিয়েছে। মানুষের মধ্যে সাবধানতা ও সচেতনতার অভাব কতটা প্রকট এবং আইন ও নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার প্রবণতা কত বেশী, এ ঘটনা তারই নজির ও প্রমাণ।
স্বাস্থ্য অধিদফতর করোনা বিস্তারের প্রেক্ষাপটে ২০১৮ সালে প্রণীত সংক্রমণ রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন প্রয়োগ করার জন্য একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। আইনটির বিধান না মানলে ৩ মাস পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড হতে পারে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বিদেশফেরত ও তাদের সংস্পর্শে আসাদের অনেকে কোয়ারেন্টাইনে থাকার শর্ত পালন করছে না। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে মিথ্য তথ্য ও গুজব ছড়িয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে। কথিতদের এ আইনের আওতায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। দু:খজনক হলেও বলতে হচ্ছে, আইন-বিধি ও নিয়ম-নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে এপর্যন্ত তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। নেয়া হলে বিদেশফেরত ও ঢাকাফেরতরা এরকম বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারতো না। জানা গেছে, গ্রামেগঞ্জে আইনশৃংখলাবাহিনী সতর্ক করার পরও গ্রামের মানুষ তা কমই পাত্তা দিচ্ছে। এ মুহূর্তে সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি জরুরি হলেও তারা দলবেধে হাটবাজারে যাচ্ছে, চা’র দোকানে আসর জমাচ্ছে। এক খবরে জানা গেছে, এর মধ্যেই ঢাকা থেকে এক কোটি ১০ লাখ মোবাইলগ্রাহক গ্রামে চলে গেছে। তারা গ্রামে কী করছে, প্রকাশিত-অপ্রকাশিত খবরাখবর থেকে তা কমবেশি জানা যাচ্ছে। গ্রামে করোনা বিস্তারের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে তারা। দু’চার দিন বা কয়েকদিন পর তারা ঢাকায় ফিরে এলে কী হবে বা হতে পারে, সহজেই অনুমান করা যায়। তাদের এবং বিদেশফেরতদের এখনই রুখতে হবে। যে কোনো মূল্যে তাদের ঘরে আটকাতে হবে এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কোয়ারেন্টাইনে রাখতে হবে। একই সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে আরো কঠোরতা অবলম্বন করতে হবে।
বিশ্বের দু’শ দেশে করোনার বিস্তার ঘটেছে। এর ক্রম বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। আবার আক্রান্তদের সুস্থ্য হওয়ার সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী। চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুর করোনা মোকাবিলায় অসাধারণ সাফল্য প্রদর্শন করছে। তাদের এই সাফল্যের পেছনে ব্যাপকহারে কোয়ারেন্টাইনে রাখা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা নিশ্চিত করা প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। এছাড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের পর্যাপ্ত যোগান, দ্রুত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা, লকডাউন, শাটডাউন ইত্যাদিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাদের এই সাফল্য অন্যান্যের জন্য অনুসরণীয়। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার, ওইসব দেশের সরকার করোনার সংক্রমণকে অত্যন্ত সিরিয়াসলি নিয়েছে এবং রাষ্ট্রের সম্পদ ও শক্তি, যতটা প্রয়োজন, এক্ষেত্রে ব্যবহার করেছে। সমন্বিত পরিকল্পনা ও কার্যব্যবস্থার আওতায় তারা এটা করেছে বলে এত কম সময়ের মধ্যে সফল্য চয়ন করতে সক্ষম হয়েছে। পক্ষান্তরে যেসব দেশ করোনাকে উপেক্ষা করেছে, তেমন একটা পাত্তা দিতে চায়নি, তারা এখন কড়ায়-গন্ডায় মাসুল গুনছে। আমাদের জন্য এটা অবশ্যই আশার খবর যে, কমিউনিটি লেভেলে করোনার বিস্তার এখনো ব্যাপকভাবে হয়নি। আমাদের কেবল সর্তক ও সাবধান হলেই চলবে না সর্বোচ্চ কঠোর হতে হবে। মনিরামপুরের এসি ল্যান্ড তিনজন বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে শোভন আচরণ করেননি। ক্ষমতার অতিরেক ব্যবহারও হয়তো হয়েছে। এজন্য তার বিরুদ্ধে প্রাথমিক ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। আমাদের দেশে, মনে রাখতে হবে, এক শ্রেণীর মানুষ আছে, যাদের মধ্যে আইন অমান্য ও লংঘন করার একটা প্রবণতা দেখা যায়। তাদের ব্যাপারে কঠোরতা প্রদর্শনের কোনো বিকল্প নেই। তবে এই কঠোরতা যেন সীমা অতিক্রম করে না যায়। আবার এও মনে রাখতে হবে, মাঠ প্রশাসনে কর্মরতদের বিরুদ্ধে এত দ্রুত কঠিন ব্যবস্থা নিলে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়াও হতে পারে। মনে হয়, আইন ও ক্ষমতার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা হলেই লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে। এ মুহূর্তে দরকার আমাদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা। এজন্য আইন-বিধি ও নিয়ম-নির্দেশনা বাস্তবায়নে নেয়া ব্যবস্থা অবশ্যই কঠোর হতে হবে। মাঠ প্রশাসন এদিকে খেয়াল রাখবে, সর্তক থাকবে, এটাই প্রত্যাশিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন