ড. আশরাফ পিন্টু ও আজাদ এহতেশামের
চিরসবুজ শ্যামলীমায় ছায়া সুনিবিড় মমতা দিয়ে ঘেরা গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী পদ্মাবিধৌতকর ফুরফুরে নরম বাতাস ও ¯িœগ্ধ আলোয় স্বপ্নজড়িন শান্ত প্রকৃতির অবারিত ¯েœহের আঁচলে তিল তিল করে বেড়ে ওঠা অতি সাদামাটা এক নিভৃতচারী কবির নাম ওমর আলী। যিনি আপন সৃষ্টির আয়নায় ভাস্বর; আধুনিক বাংলাসাহিত্যে স্থান করে নেওয়া ষাটের দশকের অন্যতম কবি কুশীলবে গ্রোথিত এক স্বীকৃত কবিসত্তা। এত বড় একজন কবি এবং তার জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে রচিত গ্রন্থের ওপর আলোচনা করা কঠিনতর একটি বিষয়। তবু কর্মব্যস্ততাসহ নানাবিধ বাধা-বিপত্তির দেয়াল পাড়ি দিয়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যে যেটুকু আমার সীমাবদ্ধ জ্ঞানদর্পণে ধরা পড়েছে সেটুকুই পাঠক সমীপে নিবেদিত হলো।
গুণীজন, শিল্প-সাহিত্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি, বিন¤্র মানবতাজড়িন উদারতা ও সখ্যতা সুঋদ্ধ সৃজনশীলতা অধিকতর উন্নত মন-মননের প্রগাঢ়তা যে স্বয়ং বিশ্ব¯্রষ্টার অপার অনুগ্রহ বা দান একথা যেমন নির্দ্বিধায় স্বীকার করা যায় তেমনি আরেক জোরালো স্বীকৃতিও জরুরি যে, উক্ত গুণগুলো অর্জনের সুতোয় গাঁথা আরো কিছু অবিচ্ছেদ্য শর্তসূত্র অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত থাকে আর তা হলোÑ কাম্যপন্থায় মনোনিবেশপূর্বক লক্ষ্য স্থিরকরণ। গুণবাচক এসব দিকের বিধিবদ্ধ বিচারে আজাদ এহতেশাম সম্পর্কে ধারণা অস্পষ্টতর হলেও ড. আশরাফ পিন্টু সম্পর্কে আমার ধারণা স্পষ্টতর। ছড়াকার ও লোকসাহিত্য গবেষক আশরাফ পিন্টু সমকালীন বাংলাসাহিত্যে নতুনমাত্রা সংযোজনকারী অনুগল্পের সার্থক কথাকার। এই সব্যসাচী লেখকের কয়েকটি গ্রন্থ আমি ইতোপূর্বেও আলোচনা করেছি যা জাতীয় দৈনিকসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সুখের কথা হলো, আমার আলোচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে থেকে দুটি গ্রন্থ “ক্ষেপুউল্লাহ বয়াতির জীবন ও সাহিত্যকর্ম” এবং “বাংলাসাহিত্যে প্রবাদের ব্যবহার” রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বস্তুত এ দুর্বলতা থেকেই “ওমর আলী : জীবন ও সাহিত্যকর্ম”-এ আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ করা।
“ওমর আলী : জীবন ও সাহিত্যকর্ম” গ্রন্থখানিতে গবেষকদ্বয় বিষয়বদ্ধ দিকগুলোকে নিয়ে অধ্যায়ভিত্তিক আলোচনায় তাদের শৈল্পিক হাতের কারুকার্যের নৈপুণ্যতা দেখাতে সচেষ্ট হয়েছেন। প্রথম অধ্যায় থেকে শুরু করে পঞ্চম অধ্যায় পর্যন্ত পাঁচটি ধাপের মধ্যে কবি ওমর আলীর জীবনাবয়ব, কাব্যবৈশিষ্ট্য, ঐতিহ্যচেতনা, শিল্পপ্রকরণ ও কবির সাহিত্যকর্মের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরেছেন। এ ছাড়া পরিশিষ্ট সাজিয়েছেন কবির ও কবির পরিবারের ছবি এবং অনেক দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থের প্রচ্ছদের ছবি দিয়ে।
“ওমর আলী : জীবন ও সাহিত্যকর্ম” তিনটি আলাদা শব্দের মধ্যে যেন এক একটি আলাদা জগৎ সুবিস্তৃত হয়ে আছে। প্রথম অধ্যায়ে কবির জীবন পরিচিতি অতি সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হয়েছে। তবে এটি আরো বিস্তৃত হলে ভালো হতো। ওমর আলী মূলত একজন প্রেমের কবি। তার অধিকাংশ কবিতা ও কাব্যগ্রন্থ রচিত হয়েছে নারীপ্রেমকে কেন্দ্র করে। তীব্রতর আবেগজড়িন ভালোবাসার সুচধার কণ্টক ফুটে আছে তার প্রেমের কবিতায়। গ্রন্থটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে নারী স্পর্শকামী কবি ওমর আলীর কাব্যবৈশিষ্ট্যের সাথে যৌনতত্ত্ববিদ ফোয়েলের যৌন-আবেদনমূলক একটি উক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে। ফোয়েল বলেছেন, খড়াব রং ঃযব ঢ়ৎরসরঃরাব ংবহংব ড়ভ ঃযব ড়িৎষফ রং ংবী রহংঃরহবঃ মঁরফবফ নু ঃযব নৎধরহ, ঃযব ড়ৎমধহ ড়ভ ঃযব ংড়ঁষ.
আর ওমর আলী বলেছেনÑ
একটি চুমোর মতোই সেই নাম, সে নাম তোমার
দেহের কোথাও আছে লুকানো বা আচ্ছন্ন যেমন
সযতেœ জামার নিচে ঢাকা থাকে মেয়েদের স্তন
এবং দেহের ¯িœগ্ধ সৌন্দর্যের প্রচুর সম্ভার।
প্রেম মহাপবিত্র সুধা। বিশ্ব¯্রষ্টা এ মহাবিশ্বকে প্রেমের মাধ্যমেই সৃষ্টি করেছেন। তাই প্রেমকে বাদ দিয়ে সৃষ্টি ও ¯্রষ্টার অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। একটি বহুল পরিচিত গানের কথায় আছেÑ
প্রেমেই সৃষ্টি জগৎ-সংসার
সৃষ্টি আদম হাওয়া
প্রেম করো না দেহের সাথে আত্মার সাথে ছাড়া।
কবি ওমর আলী যেহেতু আত্মা ছেড়ে দেহকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন সে কারণে গবেষকদ্বয় প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে ওমর আলীর সমকালীন কবিদের কবিতার সাথে তার কবিতার বৈশিষ্ট্য, বিষয় ভাবনা, ভাব উপলব্ধি প্রভৃতির সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। প্রেম ছাড়াও কবি ওমর আলী ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ তথা দেশপ্রেম সংবাদ ও সংলাপধর্মিতা প্রভৃতি বিষয়ের সমকালীন চিত্রের তুলনামূলক অলোচনা করেছেন।
গ্রন্থটির তৃতীয় অধ্যায়ে ঐতিহ্যচেতনায় উঠে এসেছে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বিভিন্ন রাজন্যবর্গের নানা প্রসঙ্গ। এ ছাড়া প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য পুরাণের ব্যবহার, লোককথা, লোকছড়া, লোকসংস্কার, লোকভাষা বিচিত্র উপাদান আলোচিত হয়েছে। গবেষকদ্বয় আলোচনার মাঝে বিশিষ্টজনের উদ্ধৃতি যুক্ত করে গ্রন্থটিকে ঋদ্ধ করে তুলেছেন।
চতুর্থ অধ্যায়ে ওমর আলীর কবিতার শিল্পরূপের অন্বেষণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়Ñ কবি ছন্দের চেয়ে অলংকারে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে তার দুর্বলতা লক্ষ্য করা যায় যা গবেষকদ্বয়ের দৃষ্টি এড়ায়নি।
মাথু আর্নল্ড বলেছেন, “কাউকে যদি বড় কবি বলতে চাও তাহলে তার কবিতাগুলো অন্য কবিদের সাথে তুলনা করে দেখ, তাহলে এর সমাধান খুঁজে পাবে।” এ দৃষ্টিকোণ থেকেই ড. আশরাফ পিন্টু ও আজাদ এহতেশাম পাশ্চাত্য কবি উইলিয়াম শেকসপিয়র, এস.টি কোলরিজ, জন কিটস, ওয়ার্ড ওয়ার্থ প্রমুখ কবির সাহিত্যকর্মের সাথে ওমর আলীর সাহিত্যকর্মের তুলনামূলক আলোচনা করেছেন।
“ওমর আলী : জীবন ও সাহিত্যকর্ম”-এ ওমর আলীর অতি শৈশবে মাতৃবিয়োগের অসহ্য যন্ত্রণা ও আত্মিক বোবাকান্না কবিকে কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত করে গবেষকদ্বয়ের এমনতর যুক্তি সত্য হলেও পুরোপুরি যথার্থ নয়। কারণ ওমর আলীকে কবি সত্তায় দাঁড় করাতে আরো এক অপ্রিয় সত্য ঘটনার সন্ধান মেলে তার অতীত জীবনের পাতা থেকে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়Ñ ওমর আলী দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় চাকরিকালীন ঢাকায় জনৈক কবির বাসায় লজিং থাকেন। তখন উক্ত কবির ষোড়শী মেয়েকে পড়ানোর সূত্র ধরে তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সম্পর্ক জানাজানি হলে ভালোবাসার অপরাধে গৃহচ্যুত হন কবি। মনের দুঃখে গ্রামে ফিরে আসেন কবি; এরপর আর কখনই শহরমুখো হননি। এর ছায়া দেখি তার প্রথম উপন্যাস “খান ম্যানসনের মেয়ে” (১৯৬২)-তে। এ ক্ষেত্রে গবেষকদ্বয়ের তথ্যবদ্ধ গবেষণায় কিছুটা অপূর্ণতাই পরিলক্ষিত হয়। এমন অনেক তথ্যই দৃষ্টিসীমার অন্তরালে লুকায়িত রয়েছে যেগুলো তুলে আনা জরুরি। অবশ্য গ্রন্থের ভূমিকায় গবেষকদ্বয় দায় স্বীকার করেছেন যে, তারা খুব স্বল্প সময়ে গ্রন্থটি রচনা করেছেন। অতএব এ কথার বিচারে এমন মহৎ কর্মের জন্যে সাধুবাদ জানাই ড. আশরাফ পিন্টু ও আজাদ এহতেশামকে, যারা এক নিভৃতচারী ও দারিদ্র্যপীড়িত কবি ওমর আলীকে অমরত্বের দ্বারে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন।
ওমর আলী : জীবন ও সাহিত্যকর্ম
প্রচ্ছদ : সিকদার আবুল বাশার
মূল্য : ২০০ টাকা
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৬
প্রকাশনা : গতিধারা।
স আমিনুল ইসলাম সৌরভ
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন