বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

‘অবাজি- আল্লাহয় মিলায় দের’

করোনায় চট্টগ্রামে গরিব-দুস্থরা হাতে কিছু পাচ্ছেন যেভাবে

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ৩১ মার্চ, ২০২০, ১:২৩ পিএম

‘অবাজি- আল্লাহয় মিলায় দের। ন খাই এনে থাকন ন পড়ের। পাইর। কিছু কিছু পাই। আল্লাহর দুনিয়াত আইজও ভাল মানুষ আছে।” আবদুল মজিদের ওই কথাগুলোর শুদ্ধ বাংলা অর্থ হলো- ‘বাবাজি। এসব সাহায্য সহযোগিতা আল্লাহর পক্ষ থেকেই মিলছে। না খেয়ে থাকতে হচ্ছে না। এভাবে কিছু কিছু তো পাচ্ছি। কারণ আল্লাহর এ পৃথিবীতে এখনও ভালো মানুষেরা তো আছেন’।
আজ মঙ্গলবার সকাল ১০টা। চট্টগ্রাম নগরীর স্টেডিয়াম পাড়ার অল্পদূরের সিআরবি মোড়। হঠাৎ করেই এক লোক তার প্রাইভেট গাড়ি থামিয়ে নেমে বের হলে এলেন। আর কিছু টাকা, চাল-ডালের একটি পোটলা বয়োবৃদ্ধ আবদুল মজিদ ও আরও কয়েকজন হাতগুলো বাড়িয়ে তুলে নিলেন। আর দাতারা চলেও গেলেন প্রায় নিঃশব্দে।


তখন ওই জায়গায় ছিলাম। যাবার আগে বাড়ির ছাদের উপর দাঁড়িয়ে চোখ যতদূর ফেরানো গেল, চারদিকে রাস্তাঘাট মোড়, সার্কিট হাউসের আশপাশ সবই ফাঁকা। চাপাকান্না বুকে চট্টগ্রাম মহানগরী যেন খাঁ খাঁ করছে। তবে মাঝে-মধ্যে কিছু লোকজনের চলাচল। কারও মাঝে তাড়াহুড়া নেই। আর দুয়েকটা রিকসা, প্রাইভেট গাড়ি, পুলিশের গাড়ি, চসিকের কিছু গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্সের আসা-যাওয়া চোখে পড়লো। তখন মাস্ক ও হ্যান্ড গ্ল্যাভস, হাঁটার কস্টিউম পরেই সেদিকে এগুতে থাকি। তখনও রাস্তায় মানুষজন একদম কম। চৈত্রের রোদের তেজ বাড়ছে বোঝা গেল।
আউটার স্টেডিয়াম, সার্কিট হাউস মোড়ে ট্রাফিক বক্সের আশেপাশে কয়েকজন গরিব রিকশাচালক এদিকে সেদিকে দাঁড়িয়ে আছে। এ সময় দেখা গেল ‘চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ’ লেখা একটি মাইক্রোবাসে আরোহী দুই ব্যক্তি নামলেন। হাতে শপিং ব্যাগের মতোই কিছু পোটলা। তারা মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা রিকশা চালক ও কয়েকজন মহিলা ভিখারীর হাতে একেকটি পোটলা তুলে দিলেন। আরও দিলেন কিছু মাস্ক। তেমন কথাবার্তা না বলেই চলে গেলেন আরেকদিকে।
কী আছে পোটলায়? জয়নাল খুলে দেখালেন, কয়েক কেজি চাল, এক কেজি ডাল, লবণ, এক বোতল সয়াবিন তেল আর এক কেজির মতো আলু। জয়নাল আবেদীনের বাড়ি ফেনীর ফুলগাজি। চট্টগ্রাম শহরে আজ তিন বছর ধরে চালান রিকশা।
বললেন, গ্রামের বাড়িতে এখন কোনই কাজকর্ম নেই। বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে জীবন চালানো কঠিন অবস্থা। তাই টানা দশ দিনের সরকারি ছুটি থাকলেও উপায় নেই। শহরেই থেকে গেলাম। কিছু তো রুজি রোজগার হবে এই আশায়।
জয়নালের পাশের জন আবদুল মুমিন। লাকসাম বাড়ি। শহরে রিকসা চালান। তবে তিন দিন আগে রিকশা রেখে হকার্স মার্কেট থেকে অল্পদামে বেশ কিছু মাস্ক কিনে এনে ফুটপাতে বিক্রি করেন, তাতে ভালো লাভও হয়। মুমিন বললেন, গত সোমবার নিউ মার্কেট মোড়ে কিছু লোকজন খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করতে দেখি।
ওদের জিজ্ঞাসা করেই জানতে পারি, সেগুলো বিক্রি করছে তারাই যারা এখানে সেখানে দানশীল লোকদের বিলি-বন্টন করা চাল, ডাল, তেল, নুন, সাবান, মাস্ক ইত্যাদি পেয়েছিলেন। এগুলোই সেখানে বিক্রি হচ্ছিল কম দামে। এই সুযোগে মুমিন ৪শ’ ৩০ টাকা দিয়ে তার ভাষায় এক প্যাকেজ কিনে নেন। প্যাকেজে ছিল চাল, মসুর ও ছোলার ডাল, সয়াবিন তেল এবং সাবান। তবে গ্রামের বাড়িতে কিভাবে পাঠাবেন তাই এখন ভাবছেন। যানবাহন তো বন্ধ। মাঝেমাঝে নাকি যাত্রী নিয়ে পিকআপ, ভ্যান, মিনি ট্রাক এ ধরনের গাড়িগুলো চলে। তখন নিজেই নিয়ে যাবেন।
স্টেডিয়াম পাড়া হয়ে সিআরবি মোড় পর্যন্ত এক হাঁটায় মাঝেমধ্যে আরও চোখে পড়লো মাঝেমধ্যে দু’চারজন দরিদ্র লোক দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন দান-সাহায্যের আশায়। কেউ কেউ হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে দিচ্ছেন। দিনমজুর, গরিব-দুস্থদের হাতে বিলিয়ে দিচ্ছেন এটা ওটা খাদ্যসামগ্রী। কিছু নিত্যপণ্য আর নগদ টাকা। ওসব হাতে পেয়েই ওরা দোয়া মোনাজাতে কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করছেন।
অবশ্য করোনাভাইরাস মহামারী সঙ্কটকালে গত কয়েকদিন খোঁজ-খবর আসছিল, চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে মানবিকতার তাগিদ থেকে স্বচ্ছল ও ধনীরা এভাবে দান-সাদকা সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। তাছাড়া সোমবার রাতে পেশাগত কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে এমনটি দৃশ্য চোখে পড়ে নগরীর জুবিলি রোড, লাভ লেইন মোড় এবং ওই সার্কিট হাউস-আউটার স্টেডিয়াম-পুলিশ বক্সের আশপাশে। দান-সদকার আশা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি ১০ কী ১২ জন পুরুষ ও মহিলাকে। দলবেঁধে বা একত্রে নয়। এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন তারা। ‘উড়ন্ত সাহায্য’ হাত বাড়িয়ে নিতেও দেখি।
বলতে গেলে ঝটিকা বেগেই চলছে এই দান-সাহায্যের পালা। যা একেবারেই ব্যতিক্রম দৃশ্য। দাতারা গাড়িতে করে ঝটিকা বেগে এসে দিয়েই চলে যাচ্ছেন। ফটো সেশন নেই। মোবাইল ফোনেও তারা নিজের ‘দানবির’ হওয়ার রেকর্ড ধারণ করছেন না।
অবশ্য বহু প্রাচীনকাল থেকেই চট্টগ্রামবাসীর দান-সাদকা-সাহায্য এবং আতিথেয়তার সুনাম বলার অপেক্ষা রাখে না। চাটগাঁবাসীর দান-সাহায্যের বদৌলতে সরকারি হাসপাতাল, ভার্সিটি, দাতব্য প্রতিষ্ঠান এমনকি রাস্তাঘাট আজও দাতাদের নামগুলো বহন করে চলেছে।
চট্টগ্রাম মহানগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে প্রায় ৭০ লাখ বাসিন্দা। করোনার টানা ছুটিতে বেশিরভাগই এখন বাড়িঘরে থাকছেন। সতর্ক ও স্বাস্থ্য সচেতন জীবনযাপনের অভ্যাস গড়ে তুলছেন। অনেকেই গ্রামের বাড়ি গিয়ে ছুটি কাটাচ্ছেন।
এ পরিস্থিতিতে বাণিজ্যিক নগরী ও বন্দরনগরীর প্রায় সবকিছুই অচল ও স্থবির। শাটডাউন। লকডাউন। শহরে মানুষ খুবই কম। এ কারণে রিকসা চালকরা পাচ্ছেন না তেমন যাত্রী। ঠেলাগাড়ি ও ভ্যান চালকরা বসে আছেন। হতদরিদ্র দিনমজুর দিনে এনে দিনে খাওয়া অগণিত গরিব মানুষের আয়-রোজগার প্রায় থেমে গেছে। কীভাবে দিনযাপন করছেন তারা? তাদের পরিবার-পরিজন?
তবে করোনা বৈশ্বিক মহামারীর দুর্যোগ পরিস্থিতিতে স্বচ্ছল পরিবারের হৃদয়বান মানুষেরা এগিয়ে এসে সমাজের হতদরিদ্রদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। দিন দিন এদের দেখা মিলছে বেশিহারে। ভয়াল করোনার প্রভাবে হয়তো অনেক ধনী বা উচ্চবিত্তের মনের কঠিন পাথর গলছে। যারা কখনই গরিবদের দুঃখ-দুর্দশার দিকে আগে ফিরেও তেমন তাকাননি। কিংবা ফুরসৎ পাননি। মানবিকতা ধর্মের সুবাতাস তাদের গায়েও লেগেছে।
এখন করোনার মহাদুর্দিনে চট্টগ্রামের গরিব-দুস্থদের হাতে হাতে কিছু না কিছু খাবার-দাবার, সাহায্য সামগ্রী, নগদ টাকা-পয়সা ইত্যাদি উড়ে এসে যেন পড়ছে। যা কিনা পেটের ক্ষুধার আগুনে পানি পড়ার মতোই তো।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন