শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সারাবিশ্ব শ্রমজীবী মানুষদের অবস্থা চরমে

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ২ এপ্রিল, ২০২০, ১২:০১ এএম

অদ্ভুত রোগ। অদ্ভুত তার নাম। করোনাভাইরাস। এক সময় দেশে একটা কথা বহুল প্রচলিত ছিল, যার হয় যক্ষ্মা তার নেই রক্ষা। সে যক্ষ্মাও এখন সারে। কিন্তু করোনাভাইরাসের এখনও কোনো ওষুধ আবিষ্কার হয় নাই। রোগটি প্রথম দেখা দেয় চীনে। চীনে দেখা দিলেও অচিরেই এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে আধুনিক উন্নত মহাদেশ হিসাবে পরিচিত ইউরোপে। প্রথম দিকে ইতালিতে এই অদ্ভুত রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা দিলেও পরবর্তীকালে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশে। এমন কি ইউরোপের মূল ভূখন্ডের সীমা ছাড়িয়ে ঢুকে পড়ে এমন এক দেশে যে দেশটি একদা প্রধান সাম্রাজ্যবাদী দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। সে দেশটি সম্পর্কে বলা হতো তার বিশাল সাম্রাজ্যে কখনো সূর্য অস্ত যায় না। প্রিয় পাঠকবৃন্দ, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমরা কোন দেশের কথা বলছি। সে দেশটি ছিল বৃটেন, যার শাসন চলে আমাদের এ উপমহাদেশেও। পৌনে দুইশত বছর ধরে সে শাসন অব্যাহত থাকে।

আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত বৃটিশ শাসনাধীন থাকার পর প্রথম স্বাধীন হয় পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের মাধ্যমে। পরে প্রথমে ভাষা আন্দোলন পরে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন প্রভৃতির পথ বেয়ে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে স্বাধিকার চেতনার সমর্থক আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলেও পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্বাচনে বিজয়ী দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্যোগ গ্রহণের পরিবর্তে ১৯৭১ সালে জনগণের স্বাধিকার চেতনা ধ্বংস করে দেয়ার লক্ষ্যে বাঙালি হত্যায় মেতে ওঠে। এই প্রেক্ষাপটেই দেশের জনগণ মরণপণ লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং মাত্র নয় মাসের মধ্যে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।
একাত্তর সালের ২৫ মার্চ এই সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু এবং শেষ হয় ঐ বছরের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তারিখের কালরাতে যারাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ধানমন্ডির বাসভবনে গেছেন, তাদেরকে অবিলম্বে দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেও তিনি নিজে তাঁর বাসভবনেই থেকে যান এবং স্বেচ্ছায় পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হাতে ধরা দেন। ফলে তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের পুরা সময়টাই পাকিস্তানে কারাবন্দি হিসেবে থাকতে হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থনে প্রতিবেশী দেশ ভারত এগিয়ে আসে এবং এই যুদ্ধে ভারতের সেনাবাহিনীও পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে। তবে তাদের এই অংশগ্রহণের পিছনে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন শক্তিশালী দেশ হিসাবে দেখার লক্ষ্য কতটা আন্তরিক ছিল, সে প্রশ্ন থেকেই যায়, ভারতের কিছু আচরণের কারণে। বিষয়টা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরও কিছু সংখ্যক ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে থেকে যাওয়ায় এ নিয়ে বাংলাদেশের জনমনে একটা সংশয় সৃষ্টি হয়।

আগেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আহবায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি হিসেবে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে তিনি লন্ডন যান। লন্ডন যেয়েই তিনি প্রথম জানতে পারেন, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও কিছু ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে অবস্থান করছে। সাথে সাথে তিনি তাঁর ইতিকর্তব্য ঠিক করে ফেলেন। লন্ডন থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনকালে দিল্লি বিমান বন্দরে স্বল্পবিরতির সুযোগে তিনি সরাসরি তদানীন্তন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে প্রশ্ন করে বলেন, ম্যাডাম, আপনি কখন বাংলাদেশ থেকে আপনার বাহিনী ফিরিয়ে আনবেন? জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, আপনি যখন বলবেন, তখনই। বলা বাহুল্য, তখন সারাবিশ্বে বঙ্গবন্ধুর এমন ব্যাপক জনপ্রিয়তা যে, অন্য কোনো জবাব দেয়াই সম্ভব ছিল না।
এবার আমরা যে বিষয় নিয়ে এ লেখা শুরু করেছিলাম, সে বিষয়ে ফিরে যাচ্ছি। সে বিষয়টা হলো করোনাভাইরাস নামের অদ্ভুত রোগ এবং এ রোগের অস্বাভাবিক স্বপ্ল সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া। আশ্চর্যের বিষয়, চীনে শুরু হওয়া এ অদ্ভুত রোগ ইউরোপের মূলভূন্ডে ছেড়ে ইল্যাংন্ডেও প্রবেশ করেছে। এ রোগের ভয়ে প্রাসাদ ছেড়ে রাণী এলিজাবেথের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার খবর ইতোমধ্যেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মাধ্যমে দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু তারপরও নাকি তিনি রেহায় পাননি, শেষ পর্যন্ত রাণীও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। চীনে শুরু হওয়া, যে রোগ ইতোমধ্যেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশকে বিপন্ন করে সুদূর আমেরিকায় হানা দিয়েছে, সে রোগ কি বাড়ির কাছের বাংলাদেশে বা ভারতীয় উপমহাদেশে কাউকেই স্পর্শ করেনি? স্পর্শ করেনি এমনটা বলতে পারলে খুশিই লাগতো। কিন্তু সে সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোকপাত করার আগে অন্যান্য দেশের অবস্থার উপর কিছুটা বলার প্রয়োজন অনুভব করছি। গত সোমবারের নয়া দিগন্ত পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটা সংবাদ প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে তার শিরোনাম ছিল, এবার করোনায় প্রাণ গেল স্পেনের রাজকুমারীর। ঐ পত্রিকায়ই আরেকটি সংবাদ প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ভয়াবহ সংক্রমণ ঝুঁকিতে ভারত, লাখো লাখো লোক মারা যাবে অভাবে। ঐ একই পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, নিউইয়র্ক সিটিতে প্রতি মিনিটে এক জনের মৃত্যু। ঐ একই পত্রিকায় শেষ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত এক খবরের শিরোনাম ছিল, ভারতে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের ঢাকায় আনা হচ্ছে।

যারা এই অদ্ভুত রোগের রোগীদের চিকিৎসার জন্য মানবিকতাবোধে এগিয়ে এসেছেন, তাদের জন্য দুঃখজনক একটা সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক ইনকিলাবের গত সোমবারের সংখ্যায়। প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত এ প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ইতালিতে অর্ধশতাধিক ডাক্তারের প্রাণহানি। এর পাশাপাশি ঐ একই পত্রিকায় প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, করোনা সংকটে অবসাদ, জার্মান অর্থমন্ত্রীর আত্মহত্যা। দৈনিক ইনকিলাবের গত সোমবার শেষ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত আরেকটি খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে, যার শিরোনাম ছিল, বিপাকে শ্রমজীবী মানুষ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যাত্রাবাড়ীর পাইকারী বাজারে দিনমজুরের কাজ করেন সোবহান মিয়া। খুচরা বিক্রেতাদের ভ্যান বা রিকশায় মালামাল তুলে দিয়ে ১০/১৫ টাকা করে সারাদিনে যা উপার্জন হয় তা দিয়ে কোনোমতে সংসার চলে। করোনার কারণে ঢাকা এখন অঘোষিত লকডাউন। পাইকারী বাজার খোলা থাকলেও মালামাল কেনার মানুষ কম। সেজন্য কাজও নেই। সোবহান মিয়া বলেন, পাইকাররা কিছু সাহায্য করছেন। তাতে নিজের খাওয়ার টাকা হলেও সংসার চলে না। কয়েকদিন কোনো মতে চলেছি। সামনের দিনগুলো যে কীভাবে কাটবে, আল্লাহই জানেন।

এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গতকাল রোববার এর দুপুরে জুরাইনে কথা হয় রিকশা চালক লিয়াকতের সাথে, দুুপুর গড়িয়ে বিকাল হলেও দুপুরের ভাত খাওয়ার টাকা জোগাড় হয়নি বলে জানালেন পঞ্চাশোর্ধ রিকশাচালক লিয়াকত। তিনি বলেন, ভেবেছিলাম রাস্তায় মানুষজনের দেখা মিলবেই। গাড়িও ভালো। কিন্তু রিকশায় ওঠার মানুষই পাচ্ছি না। যারা বাইরে বেরুচ্ছেন তাদের অধিকাংশই পায়ে হেঁটে চলছেন। লিয়াকত বলেন, এক বেলায় যা পেয়েছি তাতে নাস্তার টাকাও হয়নি। গ্রামের বাড়িতে না গিয়ে ভুল করেছি। এখন যাওয়ারও উপায় নেই। সোবহান মিয়া ও লিয়াকতের মতো রাজধানীতে বহু ছিন্নমূল ও শ্রমজীবী মানুষ এখন বিপাকে। বিশ^ব্যাপী করোনাভাইরাসের কারণে আতঙ্কিত মানুষ। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া প্রায় সব কিছুই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জনসাধারণকে বাসা-বাড়িতে থাকতে বলা হয়েছে। কিন্তু যাদের ঘরই নেই, তারা কীভাবে ঘরে থাকবে, এমন প্রশ্নও দেখা দিয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন